বাংলা সিরিয়ালে মুসলিম ইমেজ: কুরুচিকরভাবে মুসলমানদের উপস্থাপন করছে কালারস বাংলা ও জি বাংলা

#মতামত

~Samrat Amin

 

এমনিতে হিন্দিই হোক বা বাংলা কোন ধারাবাহিকই আমি দেখি না। কিন্তু ইদানিং দুটি ধারাবাহিক নিয়মিত দেখতে শুরু করেছি। কালার্স বাংলায় “জাহানারা” আর জি বাংলায় “নক্সী কাঁথা”। দুটিরই উপজীব্য বাংলার মুসলিম সমাজজীবন। সেই আগ্রহের জায়গা থেকেই বাড়ির সবাই মিলে টিভির সামনে বসে পড়ি। রাত্রি ৯ টায় “জাহানারা” আর ৯টা ৩০ এ “নক্সী কাঁথা”। শুরুর দিকে ভেবেছিলাম বাংলার মুসলিম সমাজ জীবনের সত্যিকারের প্রতিফলন দেখতে পাব। কিন্তু কোথায় কি ? সেই থোড় বড়ি খাড়া, খাড়া বড়ি থোড়। ছত্রে ছত্রে অজ্ঞতা ও ষ্টিরিয়োটাইপের প্রতিচ্ছবি।

পুরুষেরা সবাই প্রায় খলনায়ক। উগ্র রক্তচক্ষু। প্রায় সবার মাথায় ফেজ টুপি, পরনে লুঙ্গি আর থুতনি আলো করা ছাগল দাড়ি। বাংলা কথার ফাঁকে ফাঁকে অযাচিত আরবী ও উর্দু শব্দের ভিড়। নারীরা স্বাধীনতারোহিত, সাংঘাতিক রকমের নির্যাতিত, অবহেলিত ও পদদলিত। অবস্থাপন্ন মুসলিম পরিবারের নারী হলে ঝকমকি চুমকিবসানো চুড়িদার, মাথা ঢাকা। নিম্নবিত্ত হলে আটপৌরে ঘরানার ময়লা শাড়ি, মাথা ঢাকা। সমাজটা কৌমভিত্তিক, মৌলবী উলেমা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। এদের মাথা দুষ্টুবুদ্ধির আঁতুড়ঘর। সাধারান মুসলিমদের সর্বদা কুবুদ্ধি দেয়। তারা যা বলে ভেড়ার মতো সেই সব কথা পুরো সমাজ মেনে চলে। ঘুরেফিরে এই চিত্র গুলোই ধরা দেয় এসব ধারাবাহিকে। বদ্ধমূল ষ্টিরিয়োটাইপিক ধারনার প্রতিফলন ছাড়া আর কিছু নেই।

নিন্দুকেরা বলবে, “এতই যদি খারাপ ধারাবাহিক, তাহলে দেখিস কেন?” হুম দেখি তো, কমেডি শো হিসাবে। ঠিক যে মানসিকতা নিয়ে মীরের মীরাক্কেল দেখতে বসি, ঠিক একই মানসিকতা থাকে ধারাবাহিক গুলোর ক্ষেত্রেও। কি কি ষ্টিরিয়োটাইপ এদের মনে বদ্ধমূল হয়ে আছে এই সব ধারাবাহিক গুলো তো পুরো খনি। তাছাড়া বাংলার সোপ অপেরা ও চলচ্চিত্র জগতে অন্ত্যজ হিন্দু, মুসলিম বা আদিবাসীদের সমাজসংস্কৃতির জায়গা তো তেমন হয় না। অতীব দয়াপরবশ হয়ে ধারাবাহিক নির্মাতারা মুসলিম সমাজ জীবন তুলে ধরার “মহান ব্রত” গ্রহন করেছেন। এটাই বা কম কিসের ?

কিছুদিন আগে “ইষ্টি কুটুম” বলে একটা ধারাবাহিক হত। কেন্দ্রীয় চরিত্রে একজন আদিবাসী নারী। নাম বাহা। সে কলকাতায় এসে উচ্চশিক্ষিত হয়েও ছোটবড় সবাইকে “তুই-তোকারি” করছে। এমন এক ভাষায় কথা বলছে যে ত্রিভূবন তন্ন তন্ন করে খুঁজেও সেই ভাষার হদিস পাওয়া যায় না। পুরো কার্টুন। আসিবাসী বা মুসলিম সমাজ সম্পর্কে তিল পরিমান ধারনা না রেখেও এসব ধারাবাহিকের নামে পেঁয়াজী গুলো করা যায়। আবার বাঙালী দর্শক সেগুলো হাঁ করে গেলেও। বাব্বাহ! বিশেষ সমাজ বা সমাজের প্রতিনিধি সম্পর্কীয় বিকৃত উপস্থাপন একটা ক্রাইম। অস্বচ্ছ আবছা ধ্যানধারণা বা অচলাধ্যাস নিয়ে এসব ধারাবাহিক বানানো যায় না। এদের কেউ বোঝাও প্লিজ।

কিছু বছর আগের বাংলা সিনেমার গল্প গুলো মনে আছে ? বনেদি হিন্দু পরিবারের একটা পারিবারিক বন্ধু থাকত মুসলিম। অবিকল আব্দুল মাঝি। তার ছাগল দাড়ি, মাথায় ফেজ টুপি, গলায় তক্তি, কাঁধে গামছা, পরহেজগার। সে ঐ পরিবারের জন্য “জান কুরবান” দেবে কিন্তু “মান” দেবে না। সে বাংলার বদলে বাংলা-উর্দু আরবী মেশানো “গুলাবি উর্দু” ভাষায় কথা বলছে, মাঝেমধ্যে হাত তুলে “আল্লা মেহেরবান” বলছে, ব্যাকগ্রাউন্ডে বাজছে আজানের শব্দ। আবার খলনায়ক মাথায় ফেজটুপি লাগিয়েই মাফিয়াগিরি করছে। মুসলিম মানে, হয় এরকম চরম ধার্মিক, নয়ত মাথায় ফেজ টুপিধারি চোখে সুরমা লাগানো স্মাগলার, মাফিয়া। হয় চরম সাদা, নাহলে চরম কালো। মাঝখানে কিছু নেই। হ্যাঁ হিন্দুদের মতো মুসলিমদের মধ্যেও স্মাগলার আছে, তাই বলে সে ফেজ টুপি পরে স্মাগলিং করবে নাকি ? অদ্ভোদ!

মুসলিমদের সমাজজীবন পুরোটাই যেন ধর্মের নিগড়ে বাঁধা। ঘর থেকে মাজার-মসজিদ, মাজার-মসজিদ থেকে ঘর। এর মধ্যেই তাদের গোটা জীবনটা চক্কর কাটে। মুসলিমদের আলাদা করে সমাজজীবন বলে কিছু হয় না। পুরোটাই ধর্মীয় জীবন। কোন সেকুলারিত্ব নেই। এরা সিনেমা দেখতে যায় না, বিকেল বেলা পার্কে যায় না, লাইব্রেরিতে যায় না, বই পড়ে না, ফেসবুকে আঁতলামিও করে না। এরা ব্যবসাপাতি বা চাকরি বাকরিও করে না, শুধু ধর্মের বেড়াজালে আটকে থাকে। এরা নিরেট নির্বোধ, ধর্মবোধ ছাড়া আর কিছুই নেই। এরা বেপরোয়া। হাতে লাঠি আর চাপাতি ধরেই থাকে। হুটহাট বিয়ে থা করে নেয়। হুটাহাট তালাকও দিয়ে দেয়। কি দারুন চিত্রপট! তাই না ?

আমরা এখন ইমেজ নির্ভর যুগে বাস করছি। এই ইমেজ কখনও ব্যাক্তির বা কখনও ধর্মসামাজিক গোষ্ঠীর। ইমেজ নির্মানের এই রাজনীতি অতীব বিপজ্জনক। যার প্রধানতম নিয়ন্তা হল মিডিয়া। মিডিয়া বা চলচ্চিত্র জগতে বাংলার মুসলিমদের সেভাবে অংশগ্রহন না থাকায় সংখ্যাগুরু চলচ্চিত্রনির্মাতার সাদাকালো চোখ দিয়েই সাধারান জনমানস ব্যক্তি-মুসলিম ও মুসলিম সমাজকে দেখেছে। মুসলিম ইমেজের দৌলতেই বাংলায় বসবাসকারী “মুসলমান জাত” বলতে সাধারন জনমানস অবচেতনে ছক কেটে নেয় — আধুনিক শিক্ষার প্রতি বিমুখ, বিরিয়ানী-মাংস খেকো, দাঙ্গাবাজ, লাঠিলাদনা নিয়ে হাঙ্গামাকারী, রক্তচক্ষু, উগ্র, নিয়মনীতিহীন, গুন্ডাবৎ মাংসল প্রানী। সেই আঁকের উপর আঁক বুলিয়ে ছবিটা দিনের পর দিন আরও ভয়ংকর হচ্ছে। পোক্ত হচ্ছে সাধারন জনমানসে বদ্ধমূল থাকা অচলাধ্যাস।

সাধারন মুসলমান যে সাধারন হিন্দুর মতোই সুখ দুঃখ প্রেম বিচ্ছেদ নিয়ে স্বাভাবিক জীবনযাপন করে, পরিবার নিয়ে রেস্তোরায় যায়, সিনেমা দেখে, গল্প করে, ডালভাত- সবজী (শুধু বিরিয়ানী নয় ) খায় — এই বাস্তব চিত্রটা জনমানসে ভাসে না। ইমেজ ও বাস্তবতার এই অমিল দুই প্রতিবেশী সম্প্রদায়ের মনোসামাজিক জীবনে সব থেকে বড় ক্ষতিকর। এই নির্মিত ইমেজটা এতটাই কায়েমি যে চোখের সামনে স্বাভাবিক দৈনন্দিন জলভাতের মুসলমান দেখেও সাধারন জনমানসে গেঁড়ে বসে থাকা নেতিবাচক ইমেজটির বিনির্মান ঘটে না। এই নেতিবাচক ইমেজ যতদিন না ভাঙবে ততদিন মনোসমাজ আমরা-ওরা থেকে নির্বান পেয়ে শুধু “আমরা” হয়ে উঠতে পারবে না।

© Samrat Amin

(মতামত লেখকের নিজস্ব। লেখকের সাথে ফেসবুকে যোগাযোগ করতে পারেন এখানে ক্লিক করে।) 

Back To Top