রামমন্দিরের স্বপক্ষে বিচিত্র সাফাই / ৩

ধর্মপ্রাণ টিপু সুলতান সাম্প্রদায়িক ছিলেন না।


রামমন্দিরের শিলান্যাসের অনুষ্ঠানে ভাষণ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তাঁদের রামমন্দির আন্দোলনকে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের সাথে তুলনা করেছেন। অথচ তাঁদের গুরু গোলওয়ালকার (আরএসএসের দ্বিতীয় সরসঙ্ঘচালক) ব্রিটিশবিরোধী সমস্ত স্বাধীনতা সংগ্রামীদের ‘প্রতিক্রিয়াশীল’ বলে উষ্মা প্রকাশ করেছেন। আমার এই কথায় কারও সংশয় থাকলে গোলওয়ালকরের ‘Bunch of Thoughts’ পড়ে নিতে পারেন। তা যাদের কাছে গান্ধিজি, নেতাজী, দেশবন্ধু, মাস্টারদা সূর্যসেন, ভগৎ সিং প্রমুখ স্বাধীনতা সংগ্রামীরা ‘প্রতিক্রিয়াশীল’ হতে পারেন, তাদের কাছে টিপু সুলতান কি প্রতিক্রিয়াশীল না হয়ে পারেন, বিশেষত তিনি যখন ব্রিটিশবিরোধী এবং ধর্মে মুসলমান! যারা গান্ধীজীর ঘাতককে শহীদের মর্যাদা দিয়ে তাঁর চশমাটিকে ‘স্বচ্ছ ভারত অভিযান’ এর লোগো করতে পারেন, তারা যে কী পারেন আর কী পারেন না, তা সুস্থচিন্তার সমস্ত মানুষেরই কল্পনাতীত। গান্ধী-ঘাতক গডসে ছিলেন আরএসএস-এর সদস্য। গান্ধী হত্যার দায়ে আরএসএসকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন এবং তাদের বহু নেতাকে জেলে পুরেছিলেন ভারতের প্রথম স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার বল্লভ ভাই প্যাটেল। সেই প্যাটেলের উচ্চতম মূর্তি বানিয়ে দেশপ্রেমের পরাকাষ্ঠা দেখাচ্ছে আরএসএসের উত্তরসূরীরা! এসব কথা থাক। আসুন, স্বঘোষিত দেশপ্রেমিকদের চোখে ‘প্রতিক্রিয়াশীল’ এবং ‘হিন্দুবিদ্বেষী’ টিপু সুলতানকে আজ একটু দেখে নিই এক নজরে।
১৭৫৭ সালে পলাশীর প্রান্তরে নবাব সিরাজউদদৌলার পরাজয়ের মধ্য দিয়ে ভারতের স্বাধীনতার সূর্য যখন অস্ত যায়, তখন টিপু মাত্র ৭ বছরের শিশু। ইতিহাসের কী পরিহাস, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাত ধরে ‘বণিকের মানদণ্ড রাজদণ্ড রূপে’ দেখা দেওয়ার ৪২ বছর পরে সেই তাদের হাতেই ভারতের শেষ স্বাধীন নবাব হিসেবে টিপু সুলতান শহীদ হচ্ছেন শ্রীরঙ্গপত্তনমের যুদ্ধে।
আরও অদ্ভুত ব্যাপার, পলাশীর প্রান্তরে সিরাজউদ্দৌলার বিশ্বস্ত সেনাপতি মীর জাফর আলী যেভাবে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিলেন, ঠিক একইভাবে শ্রীরঙ্গপত্তনমের যুদ্ধে সেনাপতি মীর সাদিকের বিশ্বাসঘাতকতার পরিণামেই পরাজিত হন টিপু সুলতান। টিপু যুদ্ধক্ষেত্রে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন। গুলিবিদ্ধ হওয়ার পরেও শত্রুপক্ষের কয়েকজন সৈন্যকে তিনি হত্যা করেন। “ভেড়া বা শিয়ালের মতো দুশো বছর বাঁচার চেয়ে বাঘের মত দু’দিন বেঁচে থাকাও ভালো।” — এমন কথা কেবল তাঁর মুখেই শোভা পায়!
টিপু সুলতান মাতৃভাষা কানাড়ি ছাড়াও আরবি, ফারসি, উর্দু ও ইংরেজি জানতেন। তিনিই বিশ্বের মধ্যে প্রথম রকেট লঞ্চার এবং অন্যান্য আধুনিক সমরাস্ত্রের নির্মাতা। ১৭৮৬ সালে ৭২ কামানের কুড়িটি যুদ্ধজাহাজ, ৬২ কামানের কুড়িটি রণতরীতে সজ্জিত ছিল তাঁর নৌবাহিনী। অসম্ভব স্বাধীনচেতা, অনমনীয়, অসমসাহসী এই মানুষটিই প্রথম ব্রিটিশ শাসনের অবসান চেয়ে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। খুব স্বাভাবিক ভাবেই তাকে হত্যা করে ব্রিটিশ শাসকরা একদিকে যেমন হাঁফ ছেড়ে বাঁচেন, অন্যদিকে সেই হত্যাকাণ্ডের সাফাই হিসেবে তাঁর চরিত্রহননেরও প্রয়োজন হয়ে পড়ে। টিপু অত্যাচারী, নির্মম, নিশংস, হিন্দুবিদ্বেষী, গণহত্যাকারী ইত্যাদি ইত্যাদি বাছা বাছা বিশেষণে ভূষিত করা হয় তাঁকে। উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে টিপু সুলতানের উল্টো চরিত্র নির্মাণ করেছিলেন যেসব ব্রিটিশ ‘ঐতিহাসিক’ , তাদের মধ্যে ক্রিকপ্যাট্রিক ও উইলক অন্যতম। এরা সরাসরি ব্রিটিশ প্রশাসনের সাথে কেবল যুক্তই ছিলেন না, টিপুর বিরুদ্ধে যুদ্ধেও অংশগ্রহণ করেছিলেন। লর্ড কর্নওয়ালিস এবং রিচার্ড ওয়েলেসলির অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ছিলেন এরা। আধুনিক ঐতিহাসিক ইরফান হাবিব, ব্রিটলব্যাংক প্রমুখ খুব স্বাভাবিকভাবেই এদের টিপু-মূল্যায়নে আস্থা রাখতে পারেননি। তা না পারলে কী হবে,একাধারে ব্রিটিশপ্রেমী ও মুসলমান বিদ্বেষী আরএসএস যে এদের হাতেই তামাক খেয়ে টিপু বিরোধী প্রচারে আত্মনিয়োগ করবে তাতে আর বিচিত্র কী!
টিপু সুলতান ধর্মপ্রাণ মুসলমান ছিলেন, কিন্তু ধর্মান্ধ বা সাম্প্রদায়িক ছিলেন না মোটেই। তাঁর অন্যতম উপদেষ্টা ছিলেন পন্ডিত পুরনাইয়া। তিনি ১৫৬ টি হিন্দু মন্দিরে নিয়মিত নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ সাহায্য করতেন। সাহায্যপ্রাপ্ত মন্দিরগুলির মধ্যে শ্রীরাঙ্গাপাটনার রঙ্গন অষ্টমী মন্দির অন্যতম। ধর্মপ্রাণ মানুষ মাত্রই মৌলবাদী নন, কিন্তু মৌলবাদী মানুষ মাত্রই বিভেদ-বিদ্বেষে বিশ্বাসী, উগ্র এবং অসহিষ্ণু। এই ধরনের উগ্র-অসহিষ্ণু মানুষদের নিয়েই আমাদের দেশে যেমন গড়ে উঠেছে সংঘ পরিবার তেমনি বাংলাদেশে আনসারুল বাংলা ইত্যাদি।
টিপু সুলতান রাজ্য তথা দেশ রক্ষার লড়াইয়ে মারাঠা ও নিজামকে ইংরেজদের বিরুদ্ধে পাশে পেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর ডাকে সাড়া না দিয়ে তারা ইংরেজের সাথেই অক্ষজোট গঠন করে মহীশূর (বর্তমানে কর্ণাটক) আক্রমণের ছক কষেন। যারা ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিল অথবা তাঁর অবাধ্য ছিল এমন কিছু সম্প্রদায়ের ওপর টিপু সুলতান অবরোধ আরোপ করেন। এই অবরুদ্ধ সম্প্রদায়গুলি মধ্যে মালাবারের মাফিলা মুসলিম, মহাদেবী মুসলিম, সোহানুর এবং নিজামাবাদ জেলার নবাব ছিলেন। এসব তথ্যাদি সযত্নে চেপে গিয়ে হিন্দুত্ববাদীরা শুধুমাত্র ‘অশ্বত্থামা হত, ইতি – গজ’ মার্কা প্রচারের দ্বারা শুধুমাত্র কোরোগের হিন্দুদের ওপর অবরোধের কথাই বলেন! কারণ পূর্ণসত্য প্রকাশ করলে টিপু সুলতানের ‘হিন্দু বিদ্বেষ’ প্রমাণ করা যাবে না!
প্রসঙ্গত দরদী সাহিত্যিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের একটি কথা মনে পড়ছে। তিনি এক জায়গায় বলেছেন, অর্ধসত্য মিথ্যার চেয়েও ভয়ঙ্কর এবং বিপজ্জনক। টিপু সুলতান হিন্দু-মুসলমান-খ্রিস্টান নির্বিশেষে বিরুদ্ধবাদীদের ওপর অবরোধ আরোপ করেছিলেন। তার মানে সেই অবরোধের চরিত্র কখনোই ধর্মীয় বা সাম্প্রদায়িক ছিল না, তা ছিল সম্পূর্ণ রাজনৈতিক। (চলবে)

5 thoughts on “রামমন্দিরের স্বপক্ষে বিচিত্র সাফাই / ৩

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back To Top