হিন্দুবিদ্বেষী’ ঔরঙ্গজেবের এক-তৃতীয়াংশ কর্মচারী ছিলেন হিন্দু – পর্ব ১

বাংলা প্রবাদে আছে — দশচক্রে ভগবান ভূত । সম্রাট ঔরঙ্গজেবের ক্ষেত্রেও খানিকটা সেরকমই ঘটেছে। ডিভাইড এন্ড রুল অর্থাৎ ভাগ করে শাসন করার নীতি যাদের শাসন ব্যবস্থার গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ ছিল, সেই ব্রিটিশের প্রসাদজীবী কিছু ঐতিহাসিক ঔরঙ্গজেবের চরিত্রকে শুধুমাত্র বিকৃতই করেননি, কিছু ক্ষেত্রে তাঁর চরিত্রের বিপরীত-চিত্র অঙ্কন করেছেন। তাঁর বিরুদ্ধে এমন অভিযোগও তোলা হয় যে,তাঁর দরবার বা প্রশাসনের দরজা হিন্দুদের জন্য পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু আধুনিক তথ্য-প্রমাণে দেখা যাচ্ছে, বাস্তব ঘটনা ছিল ঠিক উল্টোটা।

১৬৫৮ সালের ৩১ জুলাই তিনি যখন পিতা শাহজাহানকে আগ্রা দুর্গে অবরুদ্ধ রেখে সিংহাসনে আরোহন করেন তখন তাঁর হিন্দু রাজকর্মচারীর হার ছিল ২১.৬ শতাংশ। পরবর্তীকালে তা কমে যাওয়া তো দূরের কথা, ক্রমশ বাড়তে বাড়তে ওই হার ৩১.৬ শতাংশে পৌঁছে যায়। কারও কারও মতে, তাঁর হিন্দু কর্মচারীর হার শেষ পর্যন্ত ৩৪ শতাংশে পৌঁছেছিল। যাই হোক, ‘হিন্দুবিদ্বেষী’ এক সম্রাটের প্রশাসনিক মহলে হিন্দু কর্মচারীর সংখ্যা কমবেশি এক-তৃতীয়াংশ — এ কি কম কথা!

শুধু তাইই নয়, তাঁর সাম্রাজ্যের (state) নীতিনির্ধারকদের মধ্যেও হিন্দু রাজকর্মচারীদের ভূমিকা ছিল সমধিক গুরুত্বপূর্ণ। এমনকি তাঁর রাজস্ব তথা অর্থ বিভাগ বা কোষাগারের (treasury) শীর্ষে বসিয়েছিলেন দুজন হিন্দুকে। এ ধরনের উচ্চপদে হিন্দুদের বসানো নিয়ে সংস্কারগ্রস্ত বিদ্বিষ্ট মনের কোন কোন উচ্চাকাঙ্ক্ষী মুসলিম কর্মচারীর মধ্যে অসন্তোষ যে ছিল না তা অবশ্য নয়। তাঁরা সে বিষয়ে সম্রাটের কাছে যথারীতি নালিশও করেছিলেন। কিন্তু তাতে বিশেষ সুবিধা হয়নি। ধর্মপ্রাণ মুসলমান হিসেবে তিনি শরীয়ত তথা ইসলামী আইনের সাহায্যেই অভিযোগকারীদের কুপোকাত করেন। শরীয়তেই বলা আছে সুযোগ্য ব্যক্তিকে তার যোগ্য পদে নিযুক্ত করার কথা। এই যোগ্যতা নির্ধারণের ক্ষেত্রে ধর্মীয় পরিচয় কখনও প্রাধান্য পায়নি ঔরঙ্গজেবের কাছে। অথচ তাঁকেই ধর্মীয় গোঁড়ামির দায়ে অভিযুক্ত করা হয়েছে ইতিহাসে! ঔরঙ্গজেবের দীর্ঘ প্রায় ৫০ বছরের শাসনামলে যে সমস্ত হিন্দুরা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন তাঁরা হলেন যশোবন্ত সিং, জয় সিং, রাজা রাজরূপ, কবীর সিং, অর্ঘ্যনাথ সিং, প্রেম দেব সিংহ, রসিকলাল ক্রোড়ি, দিলীপ রায় প্রমুখ। যশোবন্ত সিং ও জয় সিং ছিলেন অত্যন্ত উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন সেনাপতি। এঁরা ছাড়াও আর যাঁরা ২ থেকে ৫ হাজার পর্যন্ত সৈন্যের সেনাধ্যক্ষ ছিলেন, তাঁরা হলেন রাজা ভীম সিং (উদয়পুর), ইন্দ্র সিং, অচলাজি এবং আরজুজি। এঁরা ধর্মে হিন্দু বলে এদের প্রতি বিশ্বাসে যদি বিন্দুমাত্র ঘাটতি থাকতো তাহলে সম্রাট ঔরঙ্গজেব কি সেনাবাহিনীর শীর্ষপদে বসাতে পারতেন?

একজন সেনাধ্যক্ষের সামান্য বিশ্বাসঘাতকতা বা বিদ্রোহের ফলশ্রুতিতে যুদ্ধের জয়-পরাজয় কিভাবে নির্ধারিত হয় তার ভুরি ভুরি দৃষ্টান্ত ইতিহাসের পাতায় পাতায় ছড়িয়ে রয়েছে। ১৭৫৭ সালে নবাব সিরাজউদ্দৌলার সেনাপতি মীর জাফর আলী খাঁর বিশ্বাসঘাতকতায় পলাশীর প্রান্তরে নবাবের পরাজয় ঘটে। অস্তমিত হয় ভারতের স্বাধীনতার সূর্য। যদিও ওই যুদ্ধেই শেষ পর্যন্ত বিশ্বস্ত থেকেছেন ‘বিধর্মী’ মোহনলাল। পলাশী যুদ্ধের পুনরাবৃত্তি ঘটে ১৭৯৯ সালে শ্রীরঙ্গপত্তমে টিপু সুলতান বনাম ইংরেজদের যুদ্ধে। টিপুর সেনাপতি মীর সাদিকের বিশ্বাসঘাতকতায় ইংরেজরা জয়ী হয়। উভয় ক্ষেত্রেই বিশ্বাসঘাতকরা বিধর্মী ছিলেন না। তাঁরা ছিলেন নবাবের বিশ্বস্ত সেনাপতি এবং আত্মীয়ও ! ‘ধর্মান্ধ’ হিসেবে আখ্যায়িত সম্রাট ঔরঙ্গজেবের কাছে ‘স্বধর্মী’ বা ‘বিধর্মী’র চেয়ে যোগ্যতা বা অযোগ্যতার প্রশ্নটিই যে গুরুত্বপূর্ণ ছিল তা বোধকরি সুধী পাঠক মাত্রই উপলব্ধি করতে পারছেন। আসলে রাজনীতির একটি নিজস্ব ধর্ম (characteristic) রয়েছে। রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে শাসকের ব্যক্তিগত ধর্মবিশ্বাস (faith on religion) বহু ক্ষেত্রেই গৌণ হয়ে পড়ে। যার জন্য আরবের রাজাকে দেখা যায় মুসলমান বিদ্বেষী ডোনাল্ড ট্রাম্পের বক্ষলগ্ন হতে, দেখা যায় গুজরাট দাঙ্গার রক্তমাখা হাতে নরেন্দ্র মোদিকে ইন্দোনেশিয়ার মসজিদে চাদর চড়াতে ‘ঘুষপেটিয়া’ (অনুপ্রবেশকারী) আখ্যা দিয়ে এনআরসির মাধ্যমে মুসলমান তাড়ানোর প্রধান প্রবক্তা অমিত শাহের সন্তান জয় শাহের ব্যবসায়িক অংশীদার হতে পারেন পাকিস্তানের মুসলমান ব্যবসাদার। আসলে যেকোনও শাসকই তাঁর শাসন ক্ষমতাকে নিরঙ্কুশ রাখতে চান। আর সেই জন্যই থাকে তাঁর নিজস্ব অর্থনৈতিক কার্যক্রম। কারণ, শাসন ক্ষমতা তথা রাজনীতির ভিত্তিই হলো অর্থনীতি। সুতরাং শাসকের ব্যক্তিগত ধর্মবিশ্বাস রাজনৈতিক কার্যক্রমে খুব বেশি প্রভাব ফেলে না।

একটি উন্মাদ হাতির সামনাসামনি রাজপুত্র ঔরঙ্গজেব

ধর্মভীরু সম্রাট ঔরঙ্গজেবই হতে পারেন এর জাজ্বল্যমান প্রমাণ। মুঘল যুগের সম্রাটদের মধ্যে ধর্মীয় উদারতা এবং অন্যান্য নানা কারণে সবচেয়ে গৌরবের অধিকারী ছিলেন ঔরঙ্গজেবের প্রপিতামহ সম্রাট আকবর (তাঁর সম্পর্কে পরবর্তীকালে পৃথকভাবে আলোচনা করা যাবে)। বিশিষ্ট বস্তুবাদী ঐতিহাসিক অধ্যাপক রামশরণ শর্মা তাঁর ‘মোগল সম্রাটদের ধর্মীয় কর্মকৌশল’শীর্ষক গ্রন্থে বিস্তারিত তথ্য সহযোগে দেখিয়েছেন যে, সম্রাট আকবরের শাসনামলে (১৫৫৬ — ১৬০৫) ‘এক হাজারি’এবং তার চেয়ে বেশি ক্ষমতা সম্পন্ন মনসবদারের মোট পদ ছিল ১৩৭টি। তার মধ্যে হিন্দু ছিলেন ১৪ জন। তাঁর পুত্র তথা ঔরঙ্গজেবের পিতামহ সম্রাট জাহাঙ্গীরের সময়কালে (১৬০৫ — ১৬২৫) তিন হাজারি এবং তদুর্দ্ধ মানের মনসবদার ছিলেন ৪৭ জন। তার মধ্যে মাত্র ৬ জন ছিলেন হিন্দু। ঔরঙ্গজেবের পিতা শাহজাহানের আমলে (১৬২৭ — ১৬৫৮) সর্বমোট মনসবদার ছিলেন আট হাজার, যার মধ্যে এক হাজারি ও তার বেশি ক্ষমতা সম্পন্ন মনসবদার ছিলেন ২৪১ জন। এই ২৪১ জনের মধ্যে ৫১ জন ছিলেন হিন্দু। আর ‘হিন্দুবিদ্বেষী’ ঔরঙ্গজেবের আমলে (১৬৫৮ — ১৭০৭) মনসবদারের মোট সংখ্যা বেড়ে হয় ১৪৫৫৬ জন। তাদের মধ্যে হিন্দু ছিলেন ১৪৮ জন। সম্রাট ঔরঙ্গজেবের বিরুদ্ধে আনীত একটি বহুল প্রচলিত অভিযোগ হলো এই যে, তিনি হিন্দু কর্মচারীদের প্রশাসন থেকে বিতাড়িত করেছিলেন। এই অভিযোগ সত্য হলে ১৪৮ জন মনসবদারকে (উচ্চপদস্থ কর্মী) বহাল রাখা সম্ভব কি ? সে যুগে মনসবদাররা একাধারে প্রশাসনিক গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করতেন এবং অধীনস্থ সৈন্যদের — এক হাজার,দু’হাজার, তিন হাজার ইত্যাদি — যার অধীনে যত সৈন্য থাকতো তা নিয়ে যুদ্ধেও যেতেন। বিভিন্ন ঐতিহাসিক অনুসন্ধানে প্রশ্নাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে যে, সম্রাট আকবরের রাজত্বকালে হিন্দু রাজকর্মচারী ছিলেন শতকরা ২২.৪ জন। ঔরঙ্গজেবের পিতা শাহজাহানের আমলে তা ছিল ২৪.৫ জন। আর আগেই বলেছি, সম্রাট ঔরঙ্গজেবের আমলে তা বেড়ে হয়েছিল অন্ততপক্ষে ৩১.৬ শতাংশ। এর পরেও তাঁর উপর থেকে তথাকথিত ধর্মান্ধতা ও হিন্দু বিদ্বেষের তকমা সরিয়ে নেওয়া যাবে না ? শুরুতে কথিত সেই প্রবাদটাই আবার মনে পড়ছে — দশচক্রে ভগবান ভূত ! (চলবে)

লেখকের সাথে ফেসবুকে যোগাযোগ করতে এখানে ক্লিক করুন।

6 thoughts on “হিন্দুবিদ্বেষী’ ঔরঙ্গজেবের এক-তৃতীয়াংশ কর্মচারী ছিলেন হিন্দু – পর্ব ১

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back To Top