নাম পরিবর্তনের হিড়িক….

~মুহাম্মদ হেলালউদ্দিন

‘হিন্দু- মুসলমানের মধ্যে যে একটি পার্থক্য আছে তাহা ফাঁকি দিয়া উড়াইয়া দেবার জো নাই। প্রয়োজন সাধনের আগ্রহবশত সেই পার্থক্য কে যদি আমরা না মানি তবে সেও আমাদের প্রয়োজনকে মানিবেনা’। – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

মুসলিমরা আজও স্বতন্ত্র অস্তিত্বের জানান দিয়ে চলেছেন, আজও ইসলামের সংস্কৃতি ভারত সংস্কৃতির দ্বারা আত্মীকৃত হয়নি। তবে বলা চলে, ভারতীয় ব্রাহ্মন্য সংস্কৃতির প্রভাব কিছুটা ইসলামে  পড়েছে। সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ লিখেছেনঃ

পরিবর্তিত ইসলাম ভারতে সপ্তদশ শতাব্দী পরে পারিপার্শ্বিক ধুলো-ময়লায় মলিন হয়ে উঠেছে। হিন্দু জাত-পাত , গুরুবাদ এবং আরও অনেক প্রায় পৌত্তলিক লোকাচার সদগুনে বা দোষে ইসলাম ধর্মেও অনুপ্রবিষ্ট হয়েছে। ( মুসলিম সমাজ ও এই সময় পৃষ্ঠাঃ ৭৬)

মুসলিম স্বতন্ত্র, বৌদ্ধ অস্তিত্বের মতই , ব্রাহ্মণ্য  আদর্শের নিকট অসহনীয়। তা ব্রাহ্মণ্য সুবিধাভোগীদের বিরূদ্ধে যেমন চ্যালেঞ্জ তেমনী ব্রাহ্মণ্যতন্ত্রের চিরায়ত অবনতদের চোখ খুলে দেওয়ার পক্ষে এক সহায়ক বিপজ্জনক উপস্থিত আর এজন্যই এদেশের ব্রাহ্মণ্যতন্ত্রের সুবিধাভোগীরা শ্রমজীবী হিন্দুদের সর্বদা মুসলিমদের বিরুদ্ধে দাঙ্গায় প্ররচিত করেছেন। এই প্ররোচনা সর্বদাই রাজনৈতিক, অরথনইতিক,কখনই ধর্মীয় নয়। ‘ব্রাহ্মণ্যতন্ত্র আসলে কোন ধর্ম নয় , এটা হল ব্রাহ্মণ্য স্বার্থ রক্ষাকারী অর্থনীতি মাত্র।

তাই বদলের রাজনীতির হিড়িক পড়েছে বিজেপির জমানায়। গুড়গাও এখন গুরুগ্রাম, মুঘলসরায় জংশন দ্বীনদয়াল উপাধ্যায় স্টেশন, এলাহাবাদ প্রয়াগরাজ।

নাম বদল নিয়ে কিছু নয়। নাম বদলের পিছনে শাসকের অভিসন্ধি থাকে নিজের সাংস্কৃতিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করা। এই নামকরণ হিড়িকের বৈশিষ্ট্যই হল হিন্দু ভারতের পুনরুজ্জীবন।

হ্যারিসন রোড হয় মহাত্মাগান্ধী রোড , ধর্মতলা স্ট্রিট হয়ে যায় লেলিন সরনী , মওলা আলি হয়ে গেছে মৌলালী , নিয়ামততুল্লা ঘাট হয়েছে নিমতলা ঘাট। সেকালের একমাত্র বাজারটির নাম ছিল সুবাহ বাজার ( পরবর্তী কালে নামটি বিকৃত হয়ে দাঁড়ায় শোভা বাজার ) অর্থাৎ বাঙ্গালার সুবাহ (সরকারের) বাজার। হিন্দু শব্দের উৎপত্তি ইরান থেকে এবং চতুর্দশ শতাব্দীর আগে সংস্কৃত ভাষায় এর কোন অস্তিত্ত্ব ছিল না। হিন্দুরা যাকে ধর্ম গ্রন্থ বলে মনে করেন তাতে ‘হিন্দু’ শব্দের কোন উল্লেখ নেই। হিন্দু নামটি বিদেশী ইরানী ( পারসিক) ও মুসলমানদের দেওয়া।

‘হিন্দু’ নামটি একটি বৈদেশিক নাম । ‘হিন্দু’ শব্দটি মুসলমানদের দেওয়া, স্থানীয় অধিবাসী এবং মুসলমানদের মধ্যে স্বাতন্ত্র বোঝাবার জন্য মুসলমানরাই স্থানীয় অধিবাসীদের ’হিন্দু’ নামে অ্ভিহিত করেছিল’।( জাত ব্যবস্থার বিলুপ্তি, আম্বেদকর, ৬ষ্ট অধ্যায়)

‘তাহাদের (ভারতীয়দের) দেশের ইন্ডিয়া এবং দেশবাসীর ‘হিন্দু’ নাম ঠিক নয়। উহা বিদেশীদের উদ্ভাবিত। তাহাদের দেশের প্রকৃত নাম ‘ভারত’ ( স্বামী বিবেকানন্দ, বাণী ও রচনা, ১০ খন্ড , উদ্বোধন কার্যালয়)।

ভারতের সংবিধানের ১ নং আর্টিকেলে বলা হয়েছে ‘ইন্ডিয়া দ্যাট ইজ ভারত’। আমাদের দেশের নাম হিন্দুস্থান বলা সংবিধান বিরোধী এবং বেআইনি। দেশটির নাম ভারত । ‘গরব সে কহ হম ভারতীয় হ্যায়’ কারণ এটা সকলেই বলতে পারবে। হিন্দু মুসলমান, বোদ্ধ, খ্রিষ্টান, শিখ সকলেই বলতে পারবে, ব্রাহ্মণ, কায়স্থ, ধোপা, নাপিত, তেলী সকলেই বলতে পারবে ‘হম হিন্দু হ্যায়’। মুসলিমরা বলতে পারবে না ‘হম হিন্দু হ্যায়’, শিখ-বোদ্ধরা বলতে পারবেনা ‘হম হিন্দু হ্যায়’, মতুয়ারা বলতে পারবেনা ‘হম হিন্দু হ্যায়’, কারণ সকলেই ব্রাহ্মণ্য ধর্মের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেই ধমান্তরিত হয়েছেন।

(‘ঔপনিবেশিক যুগের আগে সংস্কৃত শাস্ত্রে হিন্দু এবং হিন্দু ধর্ম শব্দ দুটি অনুপস্থিত এবং ভক্তি আন্দোলনের কবিতায় একটি উল্লেখে তাদের অর্থের সীমিত পরিসর এতাই যে ভারতীয়রা নিজেদের জন্য কোন হিন্দু ধর্মীয় পরিচয় গঠন করেননি। এক হিন্দু আত্ম পরিচয়ের খোঁজে, দ্বিজেন্দ্রনারায়ন ঝা, পৃষ্ঠাঃ ১৫) ভারতে মুসলিম জমানার আগে পর্যন্ত কোন গ্রন্থে ‘হিন্দু’ কথাটি নেই। বেদ, বেদান্ত, আরণ্যক , ব্রাহ্মণ, উপনিষদ, মনুসংহিতা, বা অন্য কোন সংহিতায় , পুজো, বিবাহ-শ্রাদ্ধাদির মন্ত্রতন্ত্র, রামায়ন, মহাভারত, গিতা, কোন পুরাণে, বৌদ্ধদের, ত্রিপটক, কল্পসুত্র, কোথাও হিন্দু শব্দ নেই। সংস্কৃত অর্থাৎ তৎসম, তদ্ভব, দেশি শব্দ ভান্ডারে হিন্দু শব্দ নেই। সিন্ধু-হরপ্পার যুগ, বৈদিক যুগ, বৌদ্ধযুগ, বিন্দিসার, অজাতশ্ত্রু-বিন্দিসার-অশক-শুঙ্গ-গুপ্ত-পাল-সেন- হর্ষবর্ধন-শশাঙ্ক প্রভৃতি জমানায় হিন্দু শব্দের ব্যবহার কোন গ্রন্থে ছিল না। শব্দটি ফার্সি বা পারসি । এসেছে মুসলিম জমানায়। হিন্দু শব্দের দাবিদারদের মুসলমানদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানানো উচিৎ। হিন্দু শব্দের জন্মদাতা মুসলমান । ‘হিন্দু’ হিন্দুস্থান এ সব তো মুসলমানি । মুনি ঋষিরা কি হিন্দু ছিলেন? রাম কি হিন্দু? বিজেপি চায় রামরাজত্ব – হিন্দুরাষ্ট্র। এতো সব তুর্কি ,পাঠান, মোঘল তথা মুসলমানি শব্দ । নাম বদলের হিড়িকে থাকবে কি হিন্দুর হিন্দুয়ানী?

নাম বদলে কিছু আসে যায় কি? আরব, মিশর, ইরানে মুসলমানরা কোন নাম পরিবর্তন করে নি। প্রাক মুসলমান পর্বের নামই ছিল। নাম বদল নয় আদর্শ বদল-  মানবতার মন জয় করতে হয় সাম্প্রদায়িকতায় নয় । মুসলমানরা যেটা পেরেছিল।পারবে কি হিন্দুত্ববাদীরা ?

 

(লেখাটি ভালো লেগেছে আপনার? যদি ভালো লেগে থেকে তাহলে শেয়ার করুন আপনার বন্ধুদের সাথে এবং কমেন্টে জানান আপনার মতামত)।

Back To Top