দেশ ও সমাজ রক্ষার জন্য সংবিধানের ৪৪ ধারা বাতিল করা হোক।

~তায়েদুল ইসলাম

দেশ এখন যে কয়টি প্রধান ইস্যুতে উত্তেজিত তার মধ্যে একটি হল বিভিন্ন সম্প্রদায়ের দেওয়ানি (ব্যক্তিগত) আইনকে তুলে দিয়ে সকলের জন্য অভিন্ন দেওয়ানি আইন চালু করা। তার মধ্যে প্রথম ও প্রধান লক্ষ্য হল মুসলিম ব্যক্তিগত আইন তুলে দিয়ে অভিন্ন দেওয়ানি আইনকে (আসলে যা হিন্দু দেওয়ানি আইনের প্রায় সমতুল) চালু করা। এ ষড়যন্ত্র আইনও নয়, হঠাত করেও নয়। এ ষড়যন্ত্র হচ্ছে দেশের বর্তমান শাসক গোষ্ঠীর দীর্ঘদিনের। রাজনৈতিকভাবে পরাধীন ব্রিটিশ ভারতে ইংরেজরা এ দেশ থেকে মুসলিমদের যাবতীয় ইতিহাস ঐতিহ্য, শিক্ষা, মূল্যবোধকে চিরতরে বন্ধ করে বা বিকৃত করে দিতে চেয়েছিল। সেই লড়াইয়ে শেষ পর্যন্ত ইংরেজরা মুসলিমদের আইনি রক্ষা কবচ দিতে বাধ্য হয় যে মুসলিমরা ব্যক্তিগত, পারিবারিক বা সামাজিক ক্ষেত্রে নিজেদের আইন মেনে চলতে পারবেন। তারই ফলশ্রুতিতে তৈরি হয় ১৯৩৭ সালে মুসলিম পার্সোনাল ‘ল। বিষয়টা এইরকম যে মুসলিমদের সঙ্গে থেকে ইংরেজরা সমস্ত পোশাক জোর করে কেড়ে নিয়ে শুধুমাত্র গেঞ্জি ও জাঙ্গিয়া পরে বেঁচে থাকার অনুমতি দিল। আর মুসলিমরাও পরিস্থিতির কারণে বাধ্য হয়ে তাতে রাজী হয়ে কোন রকমে প্রাণে বেঁচে থাকতে চাইলেন। দেশের বর্তমান শাসক গোষ্ঠী যারা প্রথম থেকেই মুসলিমদের বিরুদ্ধে ইংরেজদের সাথে সহযোগিতা করে এসেছে তারা মুসলিমদের সেটুকুও দিতে চাইনি।

ফলশ্রুতিতে ৪৭ পরবর্তী সময় থেকেই তারা ষড়যন্ত্র করেই চলেছে। কী ভাবে মুসলিম পার্সোনাল’ল কে কেড়ে নেওয়া যায়! সেই পরিকল্পনার অংশ হিসাবেই ব্রাহ্মন্যবাদীরা সংবিধান পরিষদের মুসলিম ও অমুসলিম অব্রাহ্মন সদস্যদের জোরালো প্রতিবাদ সত্ত্বেও সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে সংবিধানের ৪৪ নং ধারা গ্রহন করা হয়। সেই ৪৪ নং ধারাকেই অজুহাত হিসেবে কাজে লাগিয়ে ইসলাম ও মুসলিম বিরোধী শক্তি বারবার মুসলিম পার্সোনাল’ল কে তুলে দেওয়ার জন্য পায়তারা কে জন সম্মুখে হাজির করে, কিন্তু কোন সময়েই তারা এই অপচেষ্টা থেকে বিরত হয় না। সব সময় চিন্তা, বুদ্ধি, কৌশল, ছক করেই চলে। মাঝে মধ্যে সেই অপচেষ্টাকে প্রকাশ্যে নিয়ে আসে। মাপার চেষ্টা করে কতটা নিজেদের সমর্থনে জনগণ বোঝাতে সক্ষম হয়েছে এবং মুসলিম সমাজের মধ্যে তৈরি করা দালালদের কতটা প্রকাশ্য থাকতে পারছে। মুসলিম সমাজকে ভিতর থেকে কতটা চেতনাহীন করতে পেরেছে। এই রকম একটা উদ্দ্যোগ তারা নিয়েছিল ১৯৮৫ সালে শাহবানু মামলার (কেস নং AIR1985 SC  945, মুহাম্মদ আহম্মদ খান বনাম শাহবানু বেগম। )  মাধ্যমে। ১৯৮৫ সালে সুপ্রিম কোর্ট মুসলিম ব্যক্তিগত আইন বিরোধী রায় দেয়। সেই রায় গোটা দেশকে তার শিকড় সুদ্ধ নড়িয়ে দেয়। মুসলিমরা ঘোষণা করেন , অভিন্ন দেওয়ানি আইন চালু হবে তাদের দেহের মৃত্যুর উপর। জনগণের চাপে পড়ে ঐ সময়ের কেন্দ্রীয় সরকার ১৯৮৬ সালে আইন করে সুপ্রিম কোর্টের রায় পরিবর্তন করে। ঐ আইন হল , (Muslim Women Protections of Right on Divorce Act). ঐ রায়ে ১৫ শতাংশ মুসলিম বিরোধী জনগণ দ্বারা সকল দেশবাসীর ইচ্ছার প্রতিফলন হয়েছিল। সবচেয়ে মজার খেলাটা দেখিয়েছিল শাহবানু নিজেই। তিনি ছিলেন একজন সাধারণ মুসলিম মহিলা। তিনি প্রমাণ করেছিলেন যে তিনি সুপ্রিমকোর্টের বিচারকদের চেয়ে বেশি প্রাজ্ঞ। তিনি এই বলে সুপ্রিমকোর্টের বিচারকদের প্রতি চপেটাঘাত মেরেছিলেন “I do not want what my beloved Prophet of Islam has denied to me”। শাহবানু মামলায় যে বিচারক মুখ্য ভুমিকা পালন করেছিলেন সে সময়ের প্রধান বিচারক Y.V. Chandra Chud অবসর গ্রহনের পর মুসলিমদের কাছে ভুল স্বীকার করে ক্ষমা চেয়েছিলেন।

তারপরেও তারা থেমে থাকেনি। ইসলামকে ধ্বংস করার কথা ভুলে যায়নি। তাঁরা সংখ্যা গরিষ্ঠ মানুষের গণতান্ত্রিক মতামতকে পাশে সরিয়ে রেখে নির্বাচিত সংস্থাকে পাত্তা না দিয়ে হিন্দুত্ববাদী মানসিক সম্পন্ন বিচারকদের দিয়ে সুপ্রিমকোর্টকে ব্যাবহার করেছে। অভিন্ন দেওয়ানি আইন চালু করার ব্যবস্থা তৈরী করছে। জনগণের মামলা Public Interest Litigation এর অপব্যবহার করার কৌশল আবিষ্কার করেছে।

সাম্প্রতিক কালে, কিছু মুসলিম বিরোধী উকিল হিন্দুত্ববাদীদের প্রতি সহানুভূতিশীল বিচারকদের কাছে অভিন্ন দেওয়ানি আইন নিয়ে জনস্বার্থের মামলা দায়ের করেন এবং অভিন্ন দেওয়ানি মামলার পক্ষে রায় পেয়ে যান। দুই জন বিচারপতি Vikramjit  এবং Shivkurti Singh গত বছর ১২ অক্টোবর (১২/১০/১৫) ৪৪ নং ধারার উপর বলেন। অভিন্ন দেওয়ানি আইনের কি হল ? তুমি যদি এটা করতে চাও, এটা তোমার করা উচিত। তুমি কেন এটা গঠন করছনা ও প্রয়োগ করছ না।  এটা তুমি কখন করছ। (Decant Herald-13/10/15). দুই সপ্তাহের মধ্যে ২৮ অক্টোবর (২৮/১০/১৫) অপর দুই বিচারপতি Anil R Dave এবং A.K.Goel  মুসলিম মহিলাদের জন্য বাড়া বাড়ি রকমের কৃত্রিম সহানুভূতি প্রকাশ করেন। অথচ মামলাটি ছিল অন্য বিষয়ের। তা ছিল Hindu Succession (Amendment) Act. (Decant Herald 29.10, 15).

দিল্লির এক বিজেপি নেতার দায়ের করা একই বিষয়ের অন্য একটি মামলায় ৯ ডিসেম্বর প্রধান বিচারপতি টি.এস. ঠাকুর এবং আর. বানুমাটি বলেন, মামলা টি গ্রহন করা যেতে পারে যদি মুসলিম মহিলাদের উপর বৈষম্য প্রকাশ্যে আসে। এটি ছিল জনস্বার্থের মামলাকারীদের জন্য সুস্পষ্ট প্রকাশ্য পরামর্শ যে, তোমরা মুসলিম মহিলা খুঁজে বের করো এবং তার নামে আবেদন কর।

প্রধান বিচারপতির সেই পরামর্শ মত শায়েরা বানু নামে একজন মুসলিম মহিলাকে আমদানি করা হয় ঐ দুই বিচারপতির এজলাসে। ঐ মহিলার হয়ে দুইজন উকিল অমিত সিং চাড্ডা এবং বালাজি শ্রীনিবাসন আদালতে দাবী জানান তিন তালাক ও বহুবিবাহ সৌদি আরব, পাকিস্তান, ইরাকসহ অনেক ইসলামিক দেশে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে, এবং ইসলাম ও কুরআনে এ সবের কোন ভিত্তি নেই।  অথচ ভারতীয় মুসলিম মহিলারা এ সবের ভুক্তভোগী, এসব বেআইনি, অসংবিধানিক, অইসলামিক এবং সংবিধান স্বীকৃত সমতা ও স্বাধীনতা নামক মৌলিক অধিকারের লঙ্ঘন।

শেষে গত মার্চ মাসের ২৮ তারিখ প্রধান বিচারপতি T.S. Thakur এবং বিচারপতি U.U. Lalit ৬ সপ্তাহের মধ্যে ২০১৫ High Level Committee Report জমা দেওয়ার জন্য কেন্দ্রীয় সরকারকে বলে। ঐ রিপোর্টে মুসলিম ব্যক্তিগত আইনে বর্ণিত তিন তালাক বহুবিবাহের উপর নিষেধাজ্ঞা করার সুপারিশ করা হয়।

৪৪ নং ধারা আদৌ কী?

এই সমস্যার উত্তম সমাধান হচ্ছে সংবিধানের ৪৪ নং ধারাকে মুছে ফেলার দাবী তোলা। এই পথেই মুসলিম আইন, সংস্কৃতি এবং ইসলামের বিরুদ্ধে সবসময় আসতে থাকা ষড়যন্ত্রের পরিসমাপ্তি ঘটবে। কোন সময় কেউ গাঁয়ের জোরে এসব চাপিয়ে দিলে দেশের ভিন্ন ভিন্ন ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, ব্যক্তিগত আইন অনুশীলনকারী সব জনগোষ্ঠী নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষায় পৃথক পৃথক রাস্তা বের করার প্রচেষ্টা শুরু করবে। এ ভাবে সমাজ ও দেশ ধ্বংসের পথে এগোবে। তাই সমাজ ও দেশকে ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচানোর জন্যই দেশের শত্রুদের হাত থেকে ৪৪ নং ধারাকে ছিনিয়ে নিতে হবে।

কি আছে এই ৪৪ ধারাতে?

গত কয়েক মাসে ৪৪ ধারার অধীনে অভিন্ন দেওয়ানী আইন চালু করার জন্য পর পর তিনটি রায় দেওয়া হয়েছে। রায় দান কালে বিচারপতি সচেতন ভাবে ভুলে গেছেন ৪৪ ধারা কোন আইন নয়। এটা নিছক নির্দেশাত্মক নীতি বা সরকারের প্রতি পরামর্শ।

এই ৪৪ ধারাটি সংবিধানের চতুর্থ অধ্যায়ে (Part-IV) আছে। এই অধ্যায়ে মোট ২০ টি ধারা আছে। অধ্যায়টি শুরু হয়েছে ৩৬ ধারা দিয়ে এবং শেষ হয়েছে ৫১ নং ধারা দিয়ে। ৩৯ক, ৪৩ক, ৪৩খ, ৪৮ক। ৩৭ নং ধারা শুরু হয়েছে এইভাবে “The Provision Contained in this part shall not be enforceable by any court)”। ৪৪ নং এর আগে ৯টি ধারা ৩৮, ৩৯, ৩৯ক, ৪০,৪১, ৪২, ৪৩, ৪৩ক, ৪৩খ এবং পরে ৮টি ধারা ৪৫, ৪৬, ৪৭, ৪৮, ৪৮ক, ৪৯, ৫০, ৫১ মোট ১৭টি ধারাকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে উদ্দেশ্য প্রনোদিত ভাবে ৪৪ ধারাকে নিয়ে মাতামাতি করছে। ইসলাম বিরোধী উকিল ও বিচারপতিরা পরপর ধারাগুলির উপর নজর না দিয়ে ইসলাম ও মুসলমানদের প্রতি বিদ্বেষ নিয়ে শুরুর ধারা ৩৬ থেকে লাফ দিয়ে ৪৪ এ পৌঁছেছে। এখানেই তাদের উদ্দেশ্য ও বদ মতলব সুস্পষ্ট হয়ে গিয়েছে। এখানে আমরা একটি ধারা বিশেষ করে ৩৯ নং ধারায় কী বলা হয়েছে তা দেখতে পারি। “But the principles therein laid down are _______ _______________fundamental in the government in the country and it shall be in the duty of the state to apply their principles in making laws.

৩৯ ধারায় বলা হয়েছেঃ

রাষ্ট্রের দায়িত্ব হল-

ক) সকল দেশবাসীকে উপযুক্ত পরিমাণে খাদ্য সরবরাহ করা।

খ) দেশের সম্পদের উপর নিয়ন্ত্রণ রক্ষা করা।

গ) দেশের সম্পদের মজুত রোধ করা।

ঘ) সমান কাজের জন্য সমান মজুরি প্রদান।

ঙ) শ্রমিকের স্বাস্থ্য রক্ষা করা।

চ) স্বাধীনতা ও মর্যাদার উন্নতি করা।

রাষ্ট্র বা সরকারের করণীয় এই সব বিষয়গুলিকে পরিস্কারভাবে লঙ্ঘন করা হচ্ছে অথচ জনস্বার্থ নিয়ে যারা উদ্বিগ্ন তারা এবং আদালত এসব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে চোখ বন্ধ করে থাকছে।

 

 

Back To Top