নজরুলের গদ্য রচনা

বাংলা মুসলিম শাসনামলে শুরু থেকেই (১২০৪ সন) বাংলা ভাষার সাথে অসংখ্য গ্রন্থরাজিও রচিত হয়। মূলত উনবিংশ শতকের শুরুতে কলকাতার ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের ব্রাহ্মণ পণ্ডিতদের দ্বারা সংস্কৃত প্রধান আরবি-ফারসি-তুর্কি-উর্দু শব্দ বিবর্জিত কৃত্রিম বাংলা ভাষা চালু হবার পূর্ব পর্যন্ত এটাই ছিল প্রচিলিত বাংলা ভাষা। হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে সকল বাঙালি কবিই এই ভাষায় সাহিত্য চর্চা করেছেন। নজরুল সে সনাতন বাংলা ভাষাকেই আশ্রয় করেছেন। বলাবাহুল্য, নজরুলের কাব্য-ভাষা মধ্যযুগের বাংলা ভাষার সম্পূর্ণ অনুসৃতি নয়, নজরুলের অসাধারণ সৃজন প্রতিভার গুণে তা একান্ত ভাবে নাজরুলিক ও আধুনিক। কিন্তু নজরুলের গদ্য-রচনায় আশ্চর্যজনকভাবে এ বিশিষ্ট ভাষা-রীতির প্রায় অনুপস্থিত সচেতন পাঠককে আনেকটা বিস্ময়াবিভূত করে। বিশিষ্ট কবি-সমালোচক আব্দুল কাদিরের ভাষায়, “মুসলমানি বাঙ্গালায় তাঁর কোন গদ্য রচনা নেই”। আব্দুল কাদির তাই অনেকটা আক্ষেপের সুরেই বলেছেন, “নজরুল যদি তাঁর জবরদস্তি হাতে ‘আলালী’ গদ্যের বিকাশ সাধনে উদ্যোগী হতেন, তবে হয়তো বাংলা গদ্যের ক্ষেত্রেও মুসলমানী বাঙ্গালার প্রবেশ সুঠাম হতো, নজরুল সে প্রয়াস করেননি”। (দ্রষ্টব্যঃ আব্দুল কাদির : যুগ কবি নজরুল)।

‘মুসলমানী বাঙ্গালার ‘সুঠাম’ অবয়ব লাভ না করলেও নজরুলের গদ্য-ভাষা হয়েছে একান্তভাবে কবির ভাষা এবং তার বৈশিষ্ট্য চোখে পড়ার মত। প্রাজ্ঞ সমালোচক আব্দুল কাদিরের মতে, তাঁর গদ্যের ভাষা যেমন কবিত্বময় তেমনি ব্যাঞ্জনাময়। অনুপ্রাস ও উপমা এ গদ্যকে দিয়েছে লিরিক কবিতার লালিত্য ও সুরঝংকার। (দ্রষ্টব্যঃ আব্দুল কাদির : যুগ কবি নজরুল)।

এ কথাটাই অন্য একজন কবি-সমালোচক এভাবে বলেছেন, অর্থাৎ কবি নজরুলের গদ্য-রচনা তাঁর কবিতারই এক সম্প্রসারিত এলাকা, এক সম্পূরক প্রবাহ। এর ভাষা মূলত কবিতারই ভাষা। ফলত তাঁর ভাষা-সম্পর্কিত আলোচনা বলতে আসলে তাঁর কাব্য ভাষার আলোচনাকে বোঝায়। (মুহাম্মদ নুরুল হুদাঃ নজরুলের ভাষা-বিদ্রোহ; প্রস্তাবনা)।

নজরুলের এ অসাধারণ কবিত্বময় গদ্য ভাষার নমুনা : সে ছিল এমনি এক চাঁদনি-চর্চিত যামিনী যাতে আপনি দায়িত্বের কথা মনে হয় মর্মতলে দরদরে সৃষ্টি করে। মদির খুশবুর মাদকতায় মল্লিকা-মাতলীর মঞ্জুল মঞ্জুরীমালা, মলয়-মরুতাকে মাতিয়ে তুলেছিল। উগ্ররজনীগন্ধার উদাস সুবাস অব্যক্ত অজানা একটা শোক-শঙ্কায় বক্ষভরে তুলেছিল।

সে এল মঞ্জুরী মুখর চরণে সেই মুকুলিত লতা-বিতানে। তার বাম করেছিল চয়িত ফুলের ঝাঁপি। কবরী-ভ্রষ্ট আমের মঞ্জুরী শিথিল হয়ে তারই বুকে ঝরে পড়েছিল ঠিক সু?? পাঁপড়ি বেয়ে পরিমল ঝরার মতো। কপোল-চুম্বিত তার চূর্ণ কুন্তল হতে বিক্ষিপ্ত কেসর রেণুর গন্ধ লুটে নিয়ে আলস-লালস-ক্লান্ত সমীর এরই খোশ-খবর চারিদিকে রটিয়ে এল ওগো ওঠ, দেখ ঘুমের দেশ পেরিয়ে স্বপ্ন-বধূ এসেছে। ঘুমের ঘোরে, (ব্যাথার দান)

নজরুলের গদ্য ভাষায় অনেকটা বঙ্কিমচন্দ্র, মীর মোশাররফ হোসেন ও ইসমাইল হোসেন সিরাজীর ভাষায় প্রতিধ্বনি শোনা যায়। এ ভাষা সম্পর্কে বিশিষ্ট কবি, সমালোচক আব্দুল কাদিরের মন্তব্য, ‘এ ভাষা যেমন কবিত্বময় তেমনই ব্যাঞ্জনাময়। অনুপ্রাস ও উপমা এ গদ্যকে দিয়েছে লিরিক কবিতার লালিত্য ও সুর-ঝংকার। দরদ, খোশবু, খোশ-খবর প্রভৃতি দুচারটি বিরল উর্দু-ভাষী শব্দ এর অঙ্গে যেন মধু মাখিয়ে দিয়েছে। তাঁর ভাষার স্বচ্ছন্দ গতি ও মধুর বর্ণনা-ভঙ্গী পরম আনন্দদায়ক। তাঁর গদ্যের বিশিষ্ট রীতি আমাদের সাহিত্যকে করেছে সমৃদ্ধ। (আব্দুল কাদিরঃ নজরুল-প্রতিভার স্বরুপ, পৃ-৯০)

বাংলা সাহিত্য তথা বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি হিসাবে খ্যাতি অর্জন করলেও কাজি নজরুল ইসলাম সাহিত্যক্ষেত্রে পরধর্ম পরিচিতি অর্জন করেন প্রধানত গল্প-লেখক হিসাবে। গল্প-লেখক হিসাবেই তিনি প্রথমত পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। এ সম্পর্কে নজরুল ইসলাম তাঁর ‘আমার সুন্দর’ প্রবন্ধে লিখেছেন, আমার সুন্দর প্রথম এলেন ছোটগল্প হয়ে, ‘তারপর এলেন কবিতা হয়ে’।

এপ প্রসঙ্গ উল্লেখ করে বিশিষ্ট নজরুল-গবেষক শাবাবুদ্দিন হক বলেন, ‘নজরুল ইসলামের প্রকৃত সাহিত্য জীবনের শুরু কবিতার লেখক হিসাবে নয়, গল্পের লেখক হিসাবে। কিন্তু এই গল্প লিখিয়ে নজরুল যে খ্যাতি অর্জন করলেন সে খ্যাতিকে ছাড়িয়ে গেল তাঁর কবিতা লেখার খ্যাতি। গল্প লেখক নজরুলের চেয়ে, অনেক বড় হয়ে উঠলেন কাব্য-লেখক নজরুল বা কবি নজরুল’। (শাহাবুদ্দিন আহমদঃ ছোটগল্পে নজরুল)

এতে কোন সন্দেহ নেই যে, নজরুলের কবি-খ্যাতি তাঁর অন্যান্য সকল কৃতিকে ছাড়িয়ে গেছে। তাঁর প্রতিভার বর্ণাঢ্য উজ্জ্বল্য কাব্য-ক্ষেত্রের যেমন প্রদপ্ত সূর্যের ন্যায় বিকশিত তাঁর গদ্য-রচনা হয়ত ততটা নয় কিন্তু তাই বলে তাঁর অবদানকে অকিঞ্চিৎকর ভাববারও মোটেই কোন অবকাশ নেই। যদি নজরুল কাব্য-চর্চা না করে শুধু গদ্য রচনা করতেন, তাহলে এক্ষেত্রে তিনি তাঁর এ অবদানের জন্যই চিরস্মরণীয় থাকতেন বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস। সূর্যের পাশে চন্দ্রের কিরণ ঢেকে পড়ে না কিন্তু সূর্যের অবর্তমানে অন্ধকার নিঃসীম আকাশে চন্দ্রের স্নিগ্ধ কিরণ-প্রভা চারিদিক আলোকিত করে রাখে। নজরুলের সূর্য-সদৃশ কাব্য-কৃতির পাশে চন্দ্র-সদৃশ গদ্য-কৃতির অবস্থাও অনেকটা তাই।

নজরুলের গদ্য-রচনাকে মোটামুটি নিম্নোক্ত কায়েকটি ভাগে ভাগ করা যায়—-

একঃ গল্প ও উপন্যাস

দুইঃ নাটক

তিনঃ  প্রবন্ধ

চারঃ  কথিকা

পাঁচঃ সম্পাদকীয়

ছয়ঃ  অভিভাষণ

সাতঃ পত্র-সাহিত্য

ইতিপূর্বে নজরুলের গদ্য রচনার পরিমাণ সম্পর্কে একটি ধারণা দেওয়ার প্রয়াস পেয়েছি। উপরের শ্রেণি-ভাগ দেখে তাঁর গদ্য-রচনার বিষয়-বৈচিত্র ও বৈশিষ্ট্য সম্পর্কেও আমাদের একটা সুস্পষ্ট ধারণা হতে পারে এবং এ উপলব্ধি হওয়াই স্বাভাবিক যে, এক্ষেত্রে নজরুল মোটেই উপেক্ষণীয় নন। তাই নজরুলের গদ্য-রচনার সম্যক পরিচিতি তুলে ধরা ও তার যথার্থ মূল্যায়ণ হওয়া একান্ত প্রয়োজন। এর ফলে সমগ্র নজরুলকে বুঝতে, উপলব্ধি করতে এবং বাংলা সাহিত্যের প্রেক্ষাপটে নজরুলের অবদান ও স্থান নিরূপণ করা সহজ হবে।

যেকোন সৃজনশীল প্রতিভার বিচার তাঁর সামগ্রিক অবদানের নিরিখেই হওয়া বাঞ্ছনীয়। দুর্ভাগ্যবশত নজরুলের কাব্য-কৃতি  এত ক্ষুরধার ও চমক-সৃষ্টিকারী যে, তাঁর গদ্য-রচনার দিকে পাঠকের দৃষ্টি যথাযথ আকৃষ্ট হয়নি। কিন্তু নজরুলের সমগ্র ও যথাযথ পরিচিতি লাভের জন্য তাঁর গদ্য-রচনার প্রতিও আমাদের সাগ্রহ নিবন্ধ হওয়া প্রয়োজন। তাহলে দেখা যাবে তাঁর গদ্য-রচনার পরিমাণ, বৈচিত্র্য ও বৈশিষ্ট্য  পাঠককে রীতিমত বিস্ময়-পুলকে অভিভূত করবে এবং একথা নিঃসংশয়ে উচ্চারণ করা যায় যে, নজরুলের গদ্য রচনা বাংলা সাহিত্যের এক মূল্যবান ও অপরিমেয় সম্পদ। এক বিশ্লেষণ ও মূল্যায়ণ হওয়া সময়ের অপরিহার্য দাবি।

লেখকঃ অধ্যাপক মুহাম্মদ মতিউর রাহমান) 

(An Exclusive Partnership with Weekly Dunia Bangla)

Back To Top