গত 5 ই আগস্ট সারা দেশে সাড়া জাগিয়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিজী অযোধ্যায় রামমন্দিরের শিলান্যাস করেছেন। ধর্মনিরপেক্ষ দেশের প্রধানমন্ত্রী সেই মন্দিরকে ‘রাষ্ট্রীয় ভাবনার প্রতীক’ হিসেবে অভিহিত করে বলেছেন, ‘সরযূর তীরে স্বর্ণযুগের সূচনা হল’। এই মন্দির নির্মাণের স্বপক্ষে-বিপক্ষে গণমাধ্যমে এবং সমাজমাধ্যমে বিস্তর লেখালেখি চলছে। শিলান্যাসের দিনই অমিতাভ প্রামাণিক নামে এক ব্যক্তি মন্দিরের সমর্থনে বেশ সুলিখিত সুদীর্ঘ একটি নিবন্ধ ফেসবুকে পোস্ট করেছেন। ঘটনাচক্রে ওই ভদ্রলোক ওই লেখাটির লিংক পাঠিয়ে আমাকে অনুরোধ করেছেন পড়ে দেখার জন্য। পড়তে পড়তে তাঁর চমৎকার বাক্যবিন্যাস এবং মনের কথার সুসংহত প্রকাশ দেখে সত্যিই আমি মুগ্ধ হলাম। লেখাটি যথেষ্ট সুসংহত, আবার সুকৌশলীও। যাদের মনের মধ্যে ইতিমধ্যেই রাম-রহিমের যুদ্ধ চলছে, তাদের কাছে এই লেখা অত্যন্ত উপাদেয়। উপাদেয় এই অর্থে যে, রামমন্দির নির্মাণের সুস্বাদ অর্থাৎ মনের যুদ্ধটাকে আরও তীব্রতর করে দেবে।অর্থাৎ মন্দির নির্মাণের অপরিহার্যতা সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে যাবেন।
লেখাটি থেকে বোঝা গেল তিনি একজন পিএইচডি করা বিজ্ঞান গবেষক। এও বোঝা গেল যে, একদা তিনি ঈশ্বর সম্পর্কে নিরাসক্ত এবং মন্দির সম্পর্কে সম্পূর্ণ নিস্পৃহ ছিলেন। লেখাটি শুরু করেছেন এইভাবে — “মন্দির নিয়ে আমার বিন্দুমাত্র ধারণা ছিলনা বছর বারো আগেও।” এর পরে তিনি বিবৃত করেছেন কিভাবে এক প্রবীণ তামিল অধ্যাপক রঘুনন্দনের সংস্পর্শে এসে মন্দির সম্পর্কে তাঁর ধারণা রাতারাতি 180 ডিগ্রী ঘুরে যায়। অধ্যাপকের এক আলাপচারিতাতেই মন্দির নির্মাণের আর্থসামাজিক গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে সম্যক জ্ঞানলাভ করেন! অধ্যাপকের বয়ানে পুরো যুক্তি সাজানোর পর উপসংহারে লেখেন, “এসব শুনে খানিকটা আইডিয়া করতে পারলাম অযোধ্যা নিয়ে দেশব্যাপী এই উন্মাদনার কারণ কী। তামিলনাড়ুতে যেহেতু রবীন্দ্রনাথ ছিলেন না, তামিলরা রবীন্দ্রনাথের মর্ম বোঝে না। পশ্চিমবঙ্গে যেহেতু পুরনো মন্দির নেই, বাঙালিরাই বা কী করে মন্দিরের মর্ম বুঝবে ?”
লেখাটি পড়তে গিয়ে অন্য পাঠকদের মন্তব্যগুলোও পড়ে নিলাম। স্বাভাবিকভাবেই মিশ্র প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করলাম। একজন পাঠক অত্যন্ত আপ্লুত হয়ে বলেছেন, “বুদ্ধুজীবীদের অবশ্যপাঠ্য।” একটানে পড়তে গিয়ে প্রথমে ভেবেছিলাম ‘বুদ্ধিজীবী’ লিখেছেন! খেয়াল করে দেখলাম, উনি সচেতনভাবেই মন্দির বিরোধীদের ‘বুদ্ধুজীবী’ বলে শ্লেষ করেছেন। সৌরভ ভট্টাচার্য্য নামে একজন যথার্থই লিখেছেন, “ফাইনালি ঝুলি থেকে বিড়াল বেরোল শেষ লাইনে।”
যাই হোক,শেষ থেকেই শুরু করা যাক। মাঝে রয়েছে গরুর রচনা। সে কথায় পরে আসা যাবে। শ্রী প্রামানিক লিখেছেন, “তামিলনাড়ুতে যেহেতু রবীন্দ্রনাথ ছিলেন না, তামিলরা রবীন্দ্রনাথের মর্ম বোঝে না।” তাহলে প্রকারান্তরে এটাই কি দাঁড়ালো না যে, তামিলনাড়ুতে রবীন্দ্রনাথ থাকলে তাদের মন্দির প্রেম মাটি হয়ে যেত, বিরাট ক্ষতি হয়ে যেত তামিলদের! এই ধরণের উক্তির দ্বারা কার্যত তামিলনাড়ুর জনসাধারণ এবং রবীন্দ্রনাথ উভয়েরই অবমাননা করা হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের অবমাননা হতো না যদি না প্রামানিক মশাই রঘুনন্দনের এক বক্তৃতাতেই রামমন্দিরের উপযোগিতা বুঝে ফেলতেন! এখানে তাঁর লেখার শেষ বাক্যটিতে প্রকাশিত আক্ষেপ থেকেই বোঝা যাচ্ছে মন্দিরের মর্ম উনি ভীষণভাবে বুঝে গেছেন, যা এখনও আমবাঙালি বুঝতে পারেনি! তবে কেউই যে বুঝতে পারেনি তা ভাবলে ভুল হবে। অনেকেই তাঁর লেখাটি পড়ে আহা-উহু করেছেন। কেউ কেউ নতুনতর মন্দির দর্শন তথা মন্দির সংস্কৃতির সন্ধান পেয়ে ভীষণভাবে উজ্জীবিত। ফেসবুকে নেই এমন বন্ধুদের কাছে পোস্টটি কপি করে হোয়াটসঅ্যাপে পাঠিয়ে কৃতার্থ বোধ করেছেন। এইরকম এক অদ্ভুত পরিস্থিতিকে শ্রী প্রামাণিকের এক বন্ধু ‘বাঙালির মননশীলতার পচন’ বলে অভিহিত করায় তিনি বড্ড বিরক্ত ও ক্ষুব্ধ হয়েছেন।
মন্দির সম্পর্কিত নবতর ভুয়োদর্শন লাভের পর রবীন্দ্রনাথ যে শ্রীপ্রামানিকদের কাছে অপাংক্তেয় হয়ে উঠবেন তাতে আর বিচিত্র কী! ঈশ্বরবিশ্বাসী হয়েও রবীন্দ্রনাথ নির্দ্বিধায় বলতে পেরেছেন — “ধর্মের মোহ মানুষকে নির্জীব করে রাখে। তার বুদ্ধিকে নিরর্থক জড় অভ্যাসের নাগপাশে অস্থিতে-মজ্জাতে নির্দিষ্ট করে ফেলে। বুদ্ধি যেখানে শৃঙ্খলিত, পুরষকার যেখানে গুরুভারগ্রস্ত, সে হতভাগ্য দেশে সর্বপ্রকার দৈহিক,মানসিক, রাজনৈতিক অমঙ্গল অব্যাখ্যাত, অচল হয়ে যায়।”
আমাদের তথাকথিত শিক্ষিত বাঙ্গালীদের বুদ্ধি কী পরিমাণে শৃঙ্খলিত হয়ে পড়েছে, তার প্রমাণ এখন প্রতি পদক্ষেপেই পাওয়া যাচ্ছে। কালান্তক করোনার অভূতপূর্ব আক্রমণে সারাদেশ যখন বিপর্যস্ত, চিকিৎসা পরিকাঠামোর অভাবে কার্যত বিনাচিকিৎসায় যখন বহু মানুষ মারা যাচ্ছেন, সে সময় হাসপাতাল নির্মাণ না করে মহা ধুমধাম সহকারে রামমন্দির নির্মাণ কেন ? এই প্রশ্নের উত্তরে এই রাজ্যের সর্বোচ্চ বিজেপি নেতা স্বনামখ্যাত দিলীপ ঘোষ অবলীলায় বলেছেন, “হাসপাতাল কালচারটা বন্ধ করে মন্দির কালচারটা আসা উচিত। কারণ মন্দির ভারতের সংস্কৃতির কেন্দ্র।” বিজ্ঞান গবেষক শ্রীপ্রামানিক এই ‘কেন্দ্রীয়’ চিন্তাটিকেই সুললিত ভাষায় পরিবেশন করেছেন। এককালে মন্দিরগুলিকে কেন্দ্র করে আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ঘটেছে কিভাবে, তার বিস্তারিত বিবরণ তিনি তামিল অধ্যাপক রঘুনন্দনের বয়ানে দিয়েছেন। কিন্তু সেটা যে ছিল ধর্মশাসিত সামন্তী ব্যবস্থার যুগ, সে খেয়াল তাঁর হয়নি! সেখান থেকে বহুদূর এগিয়ে আধুনিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে দেশ চলছে, কেন্দ্রীয় শাসক দলের মধ্যমনি নিজেই মুখে অন্তত ডিজিটাল ইন্ডিয়ার কথা বলছেন, আর কাজে ফিরে যেতে চাইছেন সামন্তী যুগে।
বিভেদ-বিদ্বেষই যাদের রাজনীতির একমাত্র ধর্ম, সেই বিজেপির ঠাকুরদা হিন্দু মহাসভার জন্মকাল (1915) থেকেই রামমন্দির তাদের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক হাতিয়ার। এই মন্দির নির্মাণের সাথে ধর্মের কোন সম্পর্ক নেই। বর্তমানে কর্পোরেট পুঁজির আশীর্বাদ পুষ্ট বিজেপি দলের রাজনীতির মূলমন্ত্রই হলো যেকোনও উপায়ে — প্রয়োজনে দাঙ্গা বাঁধিয়েও — মানুষের মধ্যে বিভাজনের প্রাচীর নির্মাণ। রামমন্দির নির্মাণ সেই নীল নকশারই অঙ্গীভূত।
অন্যদিকে রবীন্দ্রনাথ ছিলেন এদেশে হিন্দু-মুসলমানের মিলনসেতু নির্মাণের অন্যতম প্রধান কারিগর। যৌবনকালে শিলাইদহ-পাতিসর পর্বে হিন্দু-মুসলমানের আলাদা বসার জাজিম তুলে দিয়েই মিলন-সাধনার সূত্রপাত তাঁর। অতঃপর 1905 সালে বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনের নেতৃত্ব স্বেচ্ছায় কাঁধে তুলে নিয়ে প্রাচীন ধর্মীয় রাখি উৎসবকে সামাজিক আন্দোলনে রূপান্তরিত করেন। রক্ষাবন্ধন বা রাখিবন্ধনের একগাছা সুতোকে হিন্দু-মুসলমান মিলনের সূত্র করে তোলেন। সেই সময়েই লেখেন বাংলার বায়ু বাংলার জল, ও আমার দেশের মাটি, যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে,যে তোরে ছাড়ে ছাড়ুক আমি তোমায় ছাড়বো না মা ইত্যাদি 23টি অবিস্মরনীয় দেশাত্মবোধক গান। আজ থেকে প্রায় 100 বছর আগে 1329 বঙ্গাব্দে কালিদাস নাগকে এক চিঠিতে লেখেন — “ধর্মকে কবরের মতো তৈরি করে তারই মধ্যে সমগ্র জাতিকে ভূতকালের মধ্যে সর্বতোভাবে নিহিত করে রাখলে উন্নতির পথে চলবার উপায় নেই, কারও সঙ্গে কারও মেলবার উপায় নেই।” তিনি আরো লিখেছেন, “সকল প্রকার মিলনের পক্ষে এমন সুনিপুণ কৌশলে রচিত বাধা জগতে আর কোথাও সৃষ্টি হয়নি। এই বাধা কেবল হিন্দু-মুসলমানে তা নয়। তোমার আমার মত মানুষ যারা আচারে স্বাধীনতা রক্ষা করতে চাই, আমরাও পৃথক, বাধাগ্রস্ত।” এই রবীন্দ্রনাথ তো খুব স্বাভাবিক ভাবেই সংকীর্ণচিত্ত, কূপমন্ডুক হিন্দুত্ববাদীদের কাছে অপাংক্তেয় হবেনই। তিনি তো স্পষ্ট ভাষাতেই বলেছেন — “হিন্দুযুগ হচ্ছে একটা প্রতিক্রিয়ার যুগ — এই যুগে ব্রাহ্মণ্যধর্মকে সচেষ্ট ভাবে পাকা করে গাঁথা হয়েছিল। দুর্লঙ্ঘ্য আচারের প্রাকার তুলে একে দুষ্প্রবেশ্য করে তোলা হয়েছিল।” অন্যত্র তিনি লিখেছেন, “আমরা মুসলমানকে কাছে টানতে যদি না পেরে থাকি তার জন্য যেন লজ্জা স্বীকার করি।”
লজ্জা স্বীকার তো দূরের কথা, আরও নির্লজ্জ আস্ফালনে মুসলিম বিদ্বেষের মাত্রা দিনকে দিন আরও বাড়িয়ে তোলা হচ্ছে! ধর্মকে রাজনীতির হাতিয়ার করে নিয়ে আজ যারা জাতের নামে বজ্জাতিতে লিপ্ত, তাদের পক্ষে রবীন্দ্রনাথের এসব উক্তি হজম করা দুঃসাধ্য। সেই কারণেই ‘রবীন্দ্রনাথের জাতীয়তাবাদী চিন্তাধারা ভারতীয় ভাবধারার সাথে মেলেনা’ বলে পাঠ্যপুস্তক থেকে রবীন্দ্রনাথকে বিদায় করার পক্ষে সওয়াল করছেন একদা ব্রিটিশপ্রেমিক তথা বর্তমানের স্বঘোষিত দেশপ্রেমিকরা।
তামিলনাড়ুতে রবীন্দ্রনাথ ছিলেন না বলেই সেখানে আজও মন্দির সংস্কৃতি বিরাজ করছে বলে শ্লাঘা বোধ করেছেন প্রামানিক মশাই। আজ এ পর্যন্তই থাক। তাঁর লেখার মধ্যবর্তী অংশের গরুর রচনা নিয়ে আরেকদিন আলোচনা করা যাবে। (চলবে)
It is very comforting to see that others are suffering from the same problem as you, wow!
Thank you so much!
It is very comforting to see that others are suffering from the same problem as you, wow!
It is very comforting to see that others are suffering from the same problem as you, wow!
Thanks for thr great article!
It is very comforting to see that others are suffering from the same problem as you, wow!
It is very comforting to see that others are suffering from the same problem as you, wow!
It is very comforting to see that others are suffering from the same problem as you, wow!
Thanks for thr great article!
Thank you so much!
Thank you so much!
Thank you so much!
Thanks for thr great article!
Thank you so much!
It is very comforting to see that others are suffering from the same problem as you, wow!
Thank you so much!
Thanks for thr great article!
It is very comforting to see that others are suffering from the same problem as you, wow!
Thanks for thr great article!
Thanks for thr great article!