হিন্দু রাজারাও মন্দির লুট করেছেন
প্রথম পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক করুন।
কেউই সবজান্তা নন। বিভিন্ন বিষয়ে বিভিন্ন জনের অজ্ঞতা থাকতেই পারে। কিন্তু যারা অন্ধত্বের বশবর্তী হন, তাদের অজ্ঞতা কোনদিনই দূর হওয়ার নয়। কেবলমাত্র অন্ধত্বের কারণেই কোন মানুষ ‘বেদ’- এর বিন্দুবিসর্গ না জেনেও অবলীলায় বলে দিতে পারেন — ‘সবই ব্যাদে আছে’ ! সদ্য বিলেতফেরৎ বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহাকে এমন কথাই বলেছিলেন চণ্ডীমণ্ডপের কূপমন্ডুককুলতিলক এক অর্বাচীন। তা স্থানিক উচ্চারণ বিকৃতিতে ‘বেদ’- এর ‘ব্যাদ’ হয়ে যাওয়ার ধ্বনি-সাদৃশ্যে ব্যাধ কথাটি মনে পড়ছে। এই ব্যাধ বা কিরাত এবং নিষাদরাই ভারতের আদি বাসিন্দা বা ভূমিপুত্র। বাকি সকলেই বহিরাগত। নৃতাত্ত্বিক দিক থেকে দেখলে অস্ট্রালয়েড ও মঙ্গলয়েড ছাড়া সবাই বিদেশি। আর্য থেকে শুরু করে এমনকি ক্ষাত্রকুলমনি রাজপুতরাও এদেশের আদিবাসী নন। মোগল ও ব্রিটিশরা তো ননই। কিন্তু সবার সাংস্কৃতিক সংশ্লেষ এবং পারস্পরিক আত্তীকরণ এর মধ্য দিয়েই গড়ে উঠেছে ভারতীয় সংস্কৃতি। সেই জন্যই তো রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, “শক-হুন-দল পাঠান মোগল এক দেহে হল লীন।’ এ এক বহুমাত্রিক মিশ্র সংস্কৃতির দেশ। যার জন্যই বলা হয় বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্য। কিন্তু যারা রাজনৈতিক মতলবে ভারতীয়ত্বকে হিন্দুত্বের সমার্থক করে দেখাতে চান, তাদের তো এই সত্য মানলে চলে না । তাদের কাছে বিদেশি কেবলমাত্র মুসলমানরাই !
১২০৬ সালে কুতুবউদ্দিন আইবকের রাজত্বকাল থেকে শুরু হয় সুলতানী আমল। সেখান থেকে ধরলে ৮০০ বছরের অধিক সময় ধরে বংশানুক্রমে বসবাস করেও মুসলমানরা সংঘ পরিবারের অভিধান অনুযায়ী ‘দেশি’ হতে পারলেন না ! যদিও প্রায় ২০০ বছর ধরে যারা ভারতকে লুট করেছে, সেই সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশরা ছিল তাদের প্রাণের দোসর। এদেশের বীর যোদ্ধারা যখন ব্রিটিশকে তাড়ানোর জন্য হাসিমুখে ফাঁসির দড়ি গলায় পরে নিচ্ছেন, স্বয়ং নেতাজি যখন আজাদ হিন্দ বাহিনীকে পুনর্গঠিত করছেন বিদেশের মাটিতে, তখন সংঘ পরিবারের বীর সাভারকর বারংবার মুচলেকা দিয়ে কারাগার থেকে বেরিয়ে ব্রিটিশ বাহিনীতে সৈন্য সরবরাহের পবিত্র কর্তব্য পালন করছেন!
এহেন সংঘ পরিবারের গোপন সদস্য হিসেবে জনৈক বিজ্ঞান গবেষক অমিতাভ প্রামানিক রামমন্দির নির্মাণের উপযোগিতা বোঝাতে গিয়ে মুসলমান শাসকদের ‘বিদেশি’ বলে বিদ্বেষ প্রচারের অপপ্রয়াস পেয়েছেন। এই অপপ্রয়াসই হলো সেই ‘গরুর রচনা’ , যা আমি আলোচনা করব বলেছিলাম আগের দিন। মুসলমান শাসনামলে এদেশের সামাজিক ইতিহাস কেমন ছিল, কেমন ছিল ধর্মীয় সম্প্রীতির কাঠামো সেসব বিষয়ের গভীরে যাওয়ার বিন্দুমাত্র মতি তাদের নেই। একদা মুসলমানরা এই দেশ শাসন করেছেন, এটাই তাদের বড় অন্যায়! মুসলিম বিদ্বেষ প্রচারের এই হল সহজতম উপায়। তার সাথে যদি মন্দির লুটের কিছু ঘটনাকে হিন্দু বিদ্বেষের সাথে জুড়ে দেওয়া যায় তাহলে তো সোনায় সোহাগা! সেই কাজটিই সুচতুরভাবে করতে চেয়েছেন ড. প্রামানিক। আর সেই কাজে শিখন্ডী দাঁড় করিয়েছেন তামিল অধ্যাপক রঘুনন্দনকে। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। চাতুরি ধরা পড়ে গেছে। রঘুনন্দনের বয়ানেই সত্য কথাটি বেরিয়ে এসেছে। কী সেই সত্য কথা ? সত্য কথাটি হলো, একদা এদেশের মন্দিরগুলো ছিল একেকটি রত্নভান্ডার। তামিলনাড়ুর ভেলোরে একটি মন্দিরের নামই হলো রত্নগিরি। মন্দিরটি দেখার সুযোগ আমার হয়েছে। বস্তুত কোন ধর্মীয় বিদ্বেষবশত নয়, ধনরত্ন লুণ্ঠনই ছিল তৎকালীন শাসকদের একমাত্র অভিপ্রায়।
এই অর্থনৈতিক কারণের পাশাপাশি রাজনৈতিক কারণও কাজ করেছে অনেক সময়। রাজা যখন সুলতান বা সম্রাটের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছেন, তখনই খুব স্বাভাবিক ভাবেই বিদ্রোহ দমন করেছেন মুসলিম শাসকরা। বহু ক্ষেত্রে মন্দিরগুলি ছিল রাজশক্তির পৃষ্ঠপোষক। শুধুমাত্র সেইসব ক্ষেত্রেই রাজাকে পরাভূত করার পর মন্দিরকেও ধ্বংস করা হয়েছে। সুবিখ্যাত ইতিহাসবিদ এম ইটনের হিসেবে ১২ শতক থেকে ১৮ শতক পর্যন্ত অর্থাৎ প্রায় ৬০০ বছরে এরকম ঘটনা ঘটেছে ৮০ টি। এই ধ্বংসকান্ড পুরোপুরি রাজনৈতিক, বিন্দুমাত্র ধর্মীয় নয়। আর একে যদি ধর্মীয় বলে চালাতে হয় তাহলে হিন্দু রাজাদের মন্দির ধ্বংসের ঘটনাকে কিভাবে ব্যাখ্যা করবেন হিন্দুত্ববাদীরা ? কাশ্মীররাজ হর্ষ তাঁর রাজত্বকালে (১০৮৯ — ১১০১ খ্রিষ্টাব্দ) সদম্ভে ধ্বংস করেছেন অন্তত চার হাজার বৌদ্ধ পুণ্যস্থান। কাশ্মীরের ইতিহাসকার কলহন তাঁর বিশ্বখ্যাত রাজতরঙ্গিনীতে হর্ষ সম্পর্কে লিখেছেন, শুধুমাত্র বৌদ্ধ ধর্মীয় স্থাপত্যগুলিই নয়, হর্ষর হাতে বিগ্রহ সহ হিন্দু মন্দির ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি এমন কোন গ্রাম-শহর ছিল না। মন্দির থেকে বিগ্রহ তুলে নিয়ে যাওয়ার জন্য ‘দেবোৎপাটননায়ক ‘ নামে একটি বিশেষ পদ সৃষ্টি করেছিলেন তিনি। কলহনের পিতা চম্পক ছিলেন হর্ষর মন্ত্রী। একা হর্ষ নন, রাজপুত পারমার বংশের শাসক সুভাত বর্মন গুজরাট আক্রমণ কালে বহু জৈন মন্দির লুট করেছেন। বৌদ্ধবিহার ধ্বংস ও বৌদ্ধভিক্ষুদের হত্যার ব্যাপারে শৈবশাসক মিহিরকুলের নাম স্কুল পাঠ্য ইতিহাসে কুখ্যাত হয়ে আছে। মুর্শিদাবাদের কান্দিতে রুদ্রদেব রূপে পূজিত হন যে মূর্তিটি, সেটি আদতে বুদ্ধমূর্তি। রুদ্রদেব শিবেরই অপর নাম। এটি কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। সারা বাংলা সহ সারা দেশেই এরকম অজস্র দৃষ্টান্ত ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। বৌদ্ধ ধর্মের উৎপত্তি স্থল ভারতে বৌদ্ধরা আজ বিলুপ্তির পথে কেন? কারণ একটাই, বর্ণহিন্দুদের অত্যাচার ও আগ্রাসনে বৌদ্ধরা দলে দলে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। ধর্মান্তরিত হওয়ার সাথে সাথেই পুরনো অভ্যাস কেউ ছাড়তে পারে না। ছাড়তে পারেননি বৌদ্ধরাও। তারা যথারীতি মাথা ন্যাড়া করতেন। সেজন্যই বিষাক্ত মনের হিন্দুরা এখনো মুসলিমদের ‘নেড়ে জাত’ বলে গালিগালাজ বা অবমাননা করে থাকে। যারা এরকম করেন তারা নিজেরাও জানেন না কেন এরকম করা হচ্ছে! (চলবে)