শিবাজীর অভিষেকের বিরোধী ছিল ব্রাহ্মণরা
বর্ণাশ্রম প্রথা অনুযায়ী হিন্দুরা যথাক্রমে চারটি বর্ণে বিভক্ত। ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র। হিন্দু ধর্মের সবচেয়ে মান্য অনুশাসন গ্রন্থ মনুসংহিতায় বলা হয়েছে, “প্রজাপতি ব্রহ্মার মুখ থেকে ব্রাহ্মণ, বাহু থেকে ক্ষত্রিয়, উরু থেকে বৈশ্য এবং পা থেকে শূদ্রের সৃষ্টি”। যেহেতু সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মার মুখ থেকে ব্রাহ্মণের সৃষ্টি, ব্রাহ্মণ তাই ‘বর্ণশ্রেষ্ঠ’! আর পা থেকে শূদ্রের সৃষ্টি বলে তারা সর্বদা অবহেলিত, পদদলিত। সবার পিছে সবার নিচে শূদ্র। উচ্চতর তিন বর্ণের সেবা করাই তাদের ধর্মীয় কর্তব্য। ‘বর্ণশ্রেষ্ঠ’ ব্রাহ্মণদের বিধান অনুযায়ী তারা আজও অবজ্ঞাত, লাঞ্ছিত ও নির্যাতিত। সেজন্যই তাদেরকে দলিত সম্প্রদায় বলা হয়। বর্তমানে ব্রাহ্মণ্যবাদী সংঘ পরিবারের রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের সুবাদে দলিতদের প্রতি নির্যাতনের মাত্রা আরও তীব্রতর হয়েছে। মুসলমানরা ব্রাহ্মণ্যবাদীদের জাতশত্রু, কিন্তু দলিতদেরকে তারা বাড়ির ঝি-চাকরের সমান জ্ঞান করেন। কোন কোন তথাকথিত শিক্ষিত পরিবারে যেমন নাবালিকা পরিচারিকার উপর বলাৎকার থেকে শুরু করে গরম হাতা-খুন্তির ছ্যাঁকা দেওয়ার মতো অবিশ্বাস্য নির্মমতাও ঘটতে দেখা যায় একবিংশ শতাব্দীর ডিজিটাল ইন্ডিয়ায়, তেমনি মরা গরুর (‘গো-মাতা’র) চামড়া ছাড়ানোর অপরাধে ‘হিন্দুত্বের পরীক্ষাগার’ গুজরাটের উনা শহরে মুচি তথা দলিত সম্প্রদায়ের মানুষের পিঠের ছাল তুলে নেওয়ার মতো নারকীয় ঘটনাও ঘটেছে। উচ্চপর্যায়ের হিন্দুত্ববাদীদের প্রবল ঘৃণা ও প্ররোচনার পরিণামে দলিত শ্রেণীর মেধাবী ছাত্র রোহিত ভেমুলার আত্মহত্যা তো ইতিহাস হয়ে থাকবে।
ব্রাহ্মণ্যবাদী সংস্কৃতিতে ব্রাহ্মণদেরকে ‘বর্ণশ্রেষ্ঠ’ ভাবা হয় বটে, কিন্তু ব্রাহ্মণদের মধ্যেই কি শ্রেণীগত সমতা বা সংঘবদ্ধতা রয়েছে? তারা নিজেরাও নানা উপশ্রেণীতে বিভক্ত । কারও কারও মতে এই শ্রেণি সংখ্যা কমপক্ষে দুই হাজার। তারা কেউ উঁচু, কেউ নিচু। কেউ বেশি উঁচু, কেউ বেশি নিচু ! উঁচু-নিচু নিয়ে ব্রাহ্মণদের মধ্যে বিস্তর আকচাআকচি আছে।যারা নিজেদের বনেদি ব্রাহ্মণ ভাবতে ভালোবাসেন, তাদেরই শাখার সংখ্যা ৪৬৯ টি! পশ্চিমবঙ্গের মুখোপাধ্যায়, বন্দ্যোপাধ্যায় , চট্টোপাধ্যায়, গঙ্গোপাধ্যায় ইত্যাদি পদবীধারী ব্রাহ্মণরা নিজেদের বনেদি ব্রাহ্মণ ভাবতে ভালোবাসেন। এরা ভট্টাচার্য্য, চক্রবর্তী, গোস্বামী ইত্যাদি পূজারী বা যযমানগিরি করা ব্রাহ্মণদেরকে নিজেদের সমগোত্রীয় ভাবতে পারেন না। চক্রবর্তী, ভট্টাচার্য, গোস্বামীরা আবার অগ্রদানী ব্রাহ্মণদের ব্রাহ্মণই মনে করেন না! ‘পেটেকাটা ব্রাহ্মণ’ বলে তাচ্ছিল্য করা হয় তাদের। একের পর এক খোলসের সমন্বয়ে যেমন পেঁয়াজ হয়, তেমনি কলাগাছেও থাকে অনেকগুলি পৃথকীকরণযোগ্য স্তর বা খোলস। এই খোলসকেই বলা হয় ‘কলার পেটে’ বা ‘পেটো’। হিন্দুদের পুজোআচ্চা এবং শ্রদ্ধাদিতে এই কলার পেটো অপরিহার্য। শ্রাদ্ধকর্মে মূল ব্রাহ্মণের পাশাপাশি ‘ধম্বলে বাড়ি দেওয়া’র জন্য একজন অনভিজাত ব্রাহ্মণের ডাক পড়ে। তিনিই হলেন অগ্রদানী ব্রাহ্মণ। কলার পেটোয় সাজিয়ে মৃতের আত্মার উদ্দেশে তন্ডুল জাতীয় যেসব দ্রব্য নিবেদন করা হয়, তার একটা অংশ যায় অগ্রদানীর ভাগে। এই জন্যই বোধ করি তাদেরকে ‘পেটে কাটা’ ব্রাহ্মণ বলে খানিকটা অমর্যাদার চোখে দেখার রীতি সমাজে চালু আছে। একইভাবে ভাট এবং পিরালি ব্রাহ্মণরাও হিন্দু সমাজে সমাদৃত নন। আচার্য বা গণক এবং শাকদীপি ব্রাহ্মণরাও ব্রাহ্মণ সমাজে অপাংক্তেয়।
প্রসঙ্গত মনে পড়ছে আমার অত্যন্ত শ্রদ্ধেয় অধুনা প্রয়াত একজন গুণী মানুষ বিশ্বনাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের কথা। তাঁদের বাড়ি ছিল বরিশালে। তাঁর বাবা ছিলেন আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের স্নেহধন্য একজন বিজ্ঞানী এবং সশস্ত্র বিপ্লবীদের পরোক্ষভাবে সাহায্যকারী একজন মানুষ। আর তাঁর কাকা ছিলেন স্বাধীনতা আন্দোলনের সশস্ত্র ধারার একজন সক্রিয়কর্মী। আত্মগোপন করে থাকার প্রয়োজনে মহারাষ্ট্রের সশস্ত্র বিপ্লবীরা তাঁদের বাড়িতে আসতেন। কিন্তু তাঁরা নিজেরা রান্না করে খেতেন। কারণ, তাঁরা নিজেদেরকে বাঙালি ব্রাহ্মণের চেয়ে উঁচু মনে করতেন। বাংলায় গঙ্গোপাধ্যায়রা নিজেদেরকে কুলীন ব্রাহ্মণ হিসেবে মনে করলেও মহারাষ্ট্রীয় ব্রাহ্মণদের কাছে কল্কে পেতেন না। ভাবুন একবার! দেশের জন্য জীবন দেবে, কিন্তু ছোট ব্রাহ্মণের হাতের খেয়ে জাত দেবে না কিছুতেই!
এহেন ছুতমার্গী মহারাষ্ট্রীয় ব্রাহ্মণরা অব্রাহ্মণ শিবাজীকে কী চোখে দেখতেন, অন্যদিকে শিবাজীই বা তাঁদেরকে কী চোখে দেখতেন তা বিশেষভাবে জানা দরকার। কারণ হিন্দুত্বের ধ্বজাধারী বিদ্বেষজীবী রাজনীতির পক্ষ থেকে শিবাজীকে শুধুমাত্র মুসলিম বিরোধী হিসেবেই তুলে ধরা হচ্ছে না, তাঁর উপরে ‘গরু ও ব্রাহ্মণদের রক্ষাকর্তা'(গো-ব্রাহ্মণ প্রতিপালক) খেতাবও আরোপ করা হচ্ছে। এ ব্যাপারে বিস্তারিত আলোচনা পরে হবে, আপাতত আমরা মুঘল আমল বিশেষজ্ঞ স্বনামখ্যাত ঐতিহাসিক যদুনাথ সরকারের শিবাজী নামক গ্রন্থটির শরণাপন্ন হই। গ্রন্থের এক জায়গায় তিনি লিখেছেন — “শিবাজীর অভিষেকের সময়ে ব্রাহ্মণেরা একজোটে মারাঠা জাতের ক্ষত্রিয়ত্ব অস্বীকার করিয়া, বৈদিক ক্রিয়া-কর্ম্মে ও মন্ত্র-পাঠে শিবাজীর কোন অধিকার নাই বলিয়া বসিল। তাদের এইরূপ অহংকার ও গোঁড়ামিতে উত্যক্ত হইয়া শিবাজী একবার(১৬৭৪ সালে) বলেন, ‘ব্রাহ্মণদের জাতিগত ব্যবসা শাস্ত্রচর্চা ও পূজা; উপবাস ও দারিদ্র্যই তাহাদের ব্রত; শাসন-বিভাগে চাকরি করা তাদের পাপ। অতএব, সব ব্রাহ্মণ মন্ত্রী ও আমলা, সেনাপতি ও দূতকে চাকরি হইতে ছাড়াইয়া দিয়া শাস্ত্রসম্মত কাজে লাগাইয়া রাখা হিন্দু রাজার কর্তব্য। আমি তাহাই করিব।’ তখন ব্রাহ্মণেরা কাঁদাকাটি করিয়া তাঁহার ক্ষমা পায়।” (চলবে)