মেহেবুব সাহানা
নজরুল ইসলাম এর মতো একজন প্রাক্তন IPS অফিসার ও একজন সমাজ সংস্কারক শাসক গোষ্ঠীর গুন্ডাদের হাতে মার খাচ্ছেন আর এদিকে আব্বাস সিদ্দিকী মুসলিমদের নেতা হবে বলে ব্যারিস্টার আসাউদ্দিন ওয়াইসি সাহেবের সাথে মিটিং করছেন। আর কলকাতা, কলকাতার শহরতলীর এবং রাজ্যের অন্যান্য জনবসতির মধ্যবিত্ত মুসলিমরা ভাবছেন এটা কি করে হতে পারে একজন পীরজাদা ভাইজান, শুদ্ধ বাংলা বলতে পারেনা, পোশাক পরিচ্ছদে কোনো শিরি নেই, সে কি ভাবে মুসলমানদের নেতা হতে পারে?
১০% রেসেরভেশন পেয়ে যে গ্রামের ছেলেটা ডাক্তার, মাস্টার, প্রফেসর অথবা শহরের অফিসের একজন কর্মকর্তা হয়ে নিজেকে তার শিকড় থেকে ছিন্ন করে আসতে আসতে মুসলিম সমাজের ভদ্রলোক হয়ে উঠলো, তারাই প্রশ্ন করছে তার সেই ফেলে আসা নেড়ে মুসলমান গুলো কেন আব্বাস সিদ্দিকী অথবা AIMIM দিকে ঢোলে পড়ছে?
আসলে মূল সমস্যা হলো একটা রাজ্যের ২৭% জনগোষ্ঠী হয়েও আমরা না পারলাম একটা প্রেসার গ্রুপ হয়ে থাকতে, আর না পারলাম একটা আইডিওলজিক্যাল স্ট্যান্ডপয়েন্ট থেকে নিজেদের পলিটিকাল ভিউ ও নিজেদের দাবি দাবা কে প্রকাশ করতে। আমরা যখন কোনো পলিটিক্যাল পার্টির দিকে মাথা ঝুকিয়ে দি এমন ভাবে ঝুকিয়ে দি যে আমাদের মাথা বলে কিছু আছে সেটা বোঝাই যায়না। তখন আমাদের সামনে ইমাম ভাতা চাপিয়ে দিলেও আমরা বলি বাহ্ বাহ্ আমাদের জন্য অনেক কিছু করে ফেলেছে। আমাদের মধ্য থেকে কেউ মাথা উঁচু করে বলতে পারেনা, না ইমাম ভাতা আমাদের সমাজের উন্নতির চাবিকাঠি হতে পারেনা। শিক্ষিত মুসলিম সমাজের এক অংশ রাস্তায় নেমে মিছিল মিটিং করতে পারেনা যে মুসলিম সমাজের শিক্ষা স্বাস্থ্য এই, নারী কল্যাণের দিকে সরকার বেশি বেশি ধ্যান দিক। সাচার রিপোর্ট কমিশনে মুসলমানদের পিছিয়ে পড়ার যে দিক গুলো তুলে ধরা হয়েছে সেই দিক গুলোতে কাজ শুরু করা হোক।
এবার সমাজের নিচুতলার মুসলিমদের কে বা কারা আব্বাস সিদ্দিকী অথবা AIMIM দিকে ঠেলে দিচ্ছে সেই প্রশ্ন কি বেশি জরুরি নয়? পশ্চিমবঙ্গের নতুন মুসলিম মিডল ক্লাস সমাজ যদি নিচুতলার মুসলিমদের নিজেদের ছায়াতলায় নিয়ে আসতে না পারে তাহলে এই সমাজকে ধ্বংসের থেকে কেউ রক্ষা করতে পারবে না। যে কোনো ভাবে বিজেপি কে আটকাবো অথচ নিজেদের মধ্যে রাজনৈতিক ও সামাজিক কোনো রকম বিকাশ ঘটাবো না, সেটা হতে পারেনা। হয়তো চুপচাপ ফুলের ছাপ দিয়ে নো স্ট্যান্ড ওলা মুসলিম সমাজ ভেবে নেবে আমাদের কিছু হবে না। কিন্তু আব্বাস সিদ্দিকী অথবা AIMIM এর ভয়ে হিন্দু সমাজে যে পোলারাইজেশন হবে সেটা কি আটকাতে পারবে? হয়তো ২০২১ শে দিদি কোনো ভাবে বিজেপি কে আটকে নিলো। কিন্তু এই যে আসতে আসতে মুসলিম ধর্ম কেন্দ্রিক রাজনীতির বিকাশ ঘটছে সেই মুসলিম ধর্ম কেন্দ্রিক রাজনীতি কি আমাদের কে ভবিষ্যতে রক্ষা করতে পারবে? যদি আব্বাস সিদ্দিকীর হাজার হাজার জন সমাবেশের ভিডিও গুলার দিকে লক্ষ্য করি তাহলে দেখা যাবে তাদের সমাবেশের শুধু দর্শকই না স্টেজ এর মধ্যে যে মানুষ গুলো দাঁড়িয়ে আছে তাদের শিক্ষাগত যোগ্যতা, তাদের দূরদৃষ্টিটা, তাদের সমাজ ভাবনা কত দৃঢ়! তার মানে আব্বাস ভাই যে জায়গায় সভা করছেন সেখানের শিক্ষিত নরমাল জামা প্যান্ট পরা মুসলিম রাও তাদের সাথে নেই।
আমরা যদি আমাদের সমাজের প্রাক্তন IPS অফিসার নজরুল ইসলাম মতো মানুষের সম্মান রক্ষা করতে না পারি তাহলে ভেবে নিতে হবে ভবিষ্যতে আমাদের কি অবস্থা হতে চলেছে! এটা পরিষ্কার বর্তমান মুসলিম সমাজ দুই ভাগে বিভক্ত, একদল চাই যে TMC ছাড়া মোদের কোনো গতি নেই। আর একদল প্রকাশ্যে অথবা মনে মনে চাই আমরা আব্বাস সিদ্দিকী অথবা AIMIM হয়ে যাবো। হয়তো এই সংখ্যা খুবই নগণ্য কিন্তু আগামী কয়েক মাসে এই সংখ্যাকে এমন ভাবে দেখানো হবে যে এই সংখ্যাই আসলে বেশি।
এখন এই পরিস্থিতিতে আমাদের কি উচিত না সেই স্বল্প সংখ্যক মুসলিম ধর্ম কেন্দ্রিক রাজনৈতিক ভিড়কে একটা সোশালিস্ট ডেমোক্রেটিক স্বনির্ভর রাজনৈতিক চেতনার মধ্যে ফিরিয়ে নিয়ে আসা (ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা)। এর জন্য শিক্ষিত মুসলিম সমাজকে এগিয়ে আসতে হবে। যারা ১০% রিজার্ভেশন নিয়ে মুসলিম মধ্যবিত্ত হয়ে সুখের জীবন কাটাবে বলে ভেবে বসে আছে তাদের কে এগিয়ে আসতে হবে। তাদের কেই মাঠে নামতে হবে শিক্ষিত মুসলিম সমাজের নতুন মুখ হয়ে। ভারতের তথা পশ্চিমবঙ্গের সংখ্যালঘু মুসলিম সমাজকে ইউরোপের তথা অন্যান্য দেশের সংখ্যালঘুদের প্রতি নজর রাখতে হবে। কি ভাবে পাঞ্জাবিরা কানাডাতে পাঞ্জাবিদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধনে সক্ষম হচ্ছে। কিভাবে ইংল্যান্ড তথা ইউরোপের দেশগুলোতে আফ্রিকান ব্ল্যাক মানুষেরা তাদের অধিকারের রাজনীতিতে আসতে আসতে সফল হচ্ছে। আর যদি তারা না আসে তাহলে আগামী দিনে আমাদের মুসলিম সমাজের নিচু তলার গরিব মানুষেরা আরো বেশি বেশি করে ধর্ম কেন্দ্রিক রাজনীতির ছায়াতলে আশ্রয় নিয়ে বাঁচতে চাইবে। আর সেটার প্রভাব সমগ্র মুসলিম জনজাতির উপর পড়বে, আর আসতে আসতে ভারতীয় হিন্দুত্ব রাজনীতির চূড়ান্ত সফলতা যে ভারতীয় মুসলিম সমাজকে ধার্মিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক ভাবে একটা আলাদা জনগোষ্ঠিতে পরিণত করা সেই সফলতার দিকে তারা এগিয়ে যাবে। আমরা যদি রোহিঙ্গাদের ইতিহাস পড়ি তাহলে দেখবো তাদের ও ধর্মকেন্দ্রিক রাজনৈতিক পার্টি ছিল কিন্তু সেই পার্টি তাদেরকে ধ্বংসের হাত থেকে আটকাতে পারেনি। ভারতবর্ষের তথা পশ্চিমবঙ্গের মুসলিম সমাজ এমন একটা সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে যেখানে তাদের রাজনৈতিক পদক্ষেপে দূরদৃষ্টির অভাব তাদেরকে আরো অন্ধকারের দিকে ঠেলে দিতে পারে। আর এই সন্ধিক্ষণে আগামী দিনে যদি শিক্ষিত মধ্যবিত্ত মুসলিম সমাজ তাদের সমাজের রাজনৈতিক মুখ হয়ে বিকশিত না হয়, তাহলে তাদের সমস্যা আরো বাড়বে তো কমবে না।
মেহেবুব সাহানা, ইউনিভার্সিটি অফ ম্যানচেস্টার, ইংল্যান্ড। লেখকের সাথে ফেসবুকে যোগাযোগ করতে এখানে ক্লিক করুন।