আসামে NRC-র চক্রান্ত বন্দের দাবীতে সমাবেশ সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টি অফ ইন্ডিয়ার দেশকে আবার স্বাধীন করার আন্দোলনের ডাক দিলেন কেন্দ্রীয় সভাপতি এম. কে. ফাইজি

গতকাল বুধবার কলকাতার মৌলালি যুব কেন্দ্রে সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টি অফ ইন্ডিয়ার ডাকে আসামে ‘এনআরসি’ নামক চক্রান্তের মধ্যদিয়ে মানুষকে যেভাবে দেশ হীন করা চক্রান্ত ফ্যাসিবাদী শক্তি বা আরএসএস বা ভারতের বর্তমান সরকার চালাচ্ছে তারই প্রতীবাদে। বিজেপির ডাকা বনধকে উপেক্ষা করে যে সকল সাধারণ মানুষ সুদূর মুর্শিদাবাদ, ধুলিয়ান, বীরভূম, নদীয়া, উত্তর ২৪ পরগানা, দক্ষিণ ২৪ পরগানা থেকে এসেছেন তাদের সকলকে আন্তরিক ধন্যবাদ ও অভিনন্দন জানিয়ে সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টি অফ ইন্ডিয়ার রাজ্য সভাপতি জনাব তায়েদুল ইসলাম সভার সূচনা করেন। সভায় উপস্থিত ছিলেন সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টি অফ ইন্ডিয়ার কেন্দ্রীয় সভাপতি এম. কে. ফাইজি, কেন্দ্রীয় সহসভাপতি এডভোকেট সারফুদ্দিন আহাম্মেদ, জয়েন্ট অ্যাকশন কমিটি ফর বাঙালি রিফউজিস এর সভাপতি সুকৃতি রঞ্জন বিশ্বাস, পপুলার ফ্রন্ট অফ ইন্ডিয়ার পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সভাপতি ড. মিনারুল সেখ, বন্দিমুক্তি কমিটির রাজ্য সম্পাদক ছোটন দাস, অল ইন্ডিয়া ইমামস কাউন্সিল এর পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সভাপতি মৌলানা মিনারুল সেখ ও আরও আনেক সমাজকর্মী, বিশিষ্ট ব্যক্তি বর্গ।

 

রাজ্য সভাপতি তায়েদুল ইসলাম

জনাব তায়েদুল ইসলাম তাঁর বক্তব্যে বলেন, আসামে এনআরসি হল অআসামিয়া বাঙালিদের বিতাড়নের একটি অন্যতম চক্রান্ত। পূর্বে যখন দাসপ্রথা চালু ছিল তখন মানুষকে তার কর্মের কোন রকম মূল্য না দিয়েই তাদের দিনরাত পশুর মত কাজ করিয়ে নেওয়া হত। আজকের এই এন আর সি সেই দাসপ্রথারই পুনরাবৃত্তি ঘটাবে। মানুষ যখন দেশ হীন হয়ে পড়বে, কোনও দেশ তাদেরকে আশ্রয় দেওয়ার পক্ষে থাকবেনা তখন সেই সব মানুষকে ফ্যাসিবাদী শক্তি তাদের অনুগ্রহের শিকার বানিয়ে তাদেরকে দাসে পরিণত করবে এবং কোনোরকম মূল্য তাদেরকে না দিয়েই তাদের কাজ হাসিল করতে পারবে বলে তিনি মনে করেন। এই অপশক্তির বিরুদ্ধে দেশের স্বার্থে সমস্ত স্তরের মানুষকে একজোট হয়ে এই আন্দোলনে আসার জন্য ধন্যবাদ জানান।

 

বক্তব্য রাখছেন এডভোকেট সাইফুদ্দিন

এডভোকেট সারফুদ্দিন আহাম্মেদ তাঁর বক্তব্যে বলেন আজকের এই এনআরসি ভারতের সংবিধানের উপর হামলা। ভারত ধর্মনিরেপেক্ষ দেশ, এখানে ভাষাগত ভাবে, ধর্মীয় আচার আচরণের ভিত্তিতে কোন মানুষকে বিবেচনা করা হবেনা। ভারতে যারা বসবাস করে তারা সবাই জন্মসূত্রে ভারতের নাগরিক। সমস্ত সুযোগ সুবিধা তারা ভোগ করতে পারবে। কিন্তু আজকে ভাষাগত ভিতিত্তে, ধর্মীয় ভিতিত্তে ৪০ লক্ষেরও বেশি মানুষকে বিদেশী বলে অভিহিত করেছে। যেখানে পূর্বতন ভারতের রাষ্ট্রপতি ফখরুদ্দীন আহাম্মেদ, আসামের প্রাক্তম মুখ্যমন্ত্রী সায়েদ আনোয়ারা তাইমুর এর পরিবার, সেনাকর্মী, শিক্ষক, সীমান্ত বাহিনীর উচ্চপদস্ত কর্মীরাও এখন বিদেশী বলে গণ্য হয়েছে। ৩০ জুলাই গৃহমন্ত্রী রাজনাথ সিং জানান যারা নথিপত্র জমা দিতে পারেননি তাদেরকে আবারও সুযোগ দেওয়া হবে। কিন্তু এদিকে বিজেপি সভাপতি অমিত শাহ মুঘলসরায় স্টেশনের নাম বদলের অনুষ্ঠানে বললেন “আমরা ৪০ লাখ অনুপ্রবেশকারীকে আলাদা করতে পেরেছি যাদেরকে আমরা অতিশীঘ্রয় দেশ থেকে বের করে দেব, আমাদের বেঁচে থাকা মুশকিল করে দিয়েছে”। যারা মুসলিম তারা অনুপ্রবেশকারী আর যারা হিন্দু তারা শরণার্থী হিসাবে গণ্য করা হচ্ছে। তিনি আরও বলেন কোন মানুষের উপর যদি কোন ব্যক্তি  কোন ব্যক্তির উপর আরোপ লাগাই তাহলে আরোপকারীকে প্রমাণ করতে হয় যে তার অভিযোগ সত্য। কিন্তু এখানে উল্টো হচ্ছে। বলা হচ্ছে এখন তোমাকেই প্রমাণ করতে হবে তুমি ভারতীয়, যেখানে লাগবে তাদের মনমত কাগজপত্র লাগবে। কোন গরিব, অশিক্ষিত ব্যাক্তিকে সরকারের পক্ষ থেকে আইনি সাহায্য দেওয়া হয় কিন্তু সেটাও করা হচ্ছেনা। তারপর প্রচার করা হচ্ছে অনুপ্রবেশকারীদের জন্য আসামের জনসংখা বাড়ছে। অথচ আসামের মুসলিম জনসংখা বৃদ্ধির হার ১৪ শতাংশ, এই ১৪ শতাংশ ৮০ শতাংশ হিন্দুদের জন্য বিপদজনক বলে প্রচার করা হচ্ছে। ঝাড়খণ্ড রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীও দাবী করেছেন যে, ঝাড়খণ্ডেও এন আর সি করতে হবে। তাঁর ভাষায় ঝাড়খণ্ডে যে সমস্ত শহর, বিল্ডিং, প্রশাসনিক ভবন ইত্যাদি যাকিছু তৈরি করা হয়েছে তা সবই আদিবাসীদের বিতাড়ন করে তাদের জমি দখল করে করা হয়েছে। করুন এন আর সি এবং সঠিক ভাবে ন্যায়পরায়নাতার সহিত করুন এবং আদিবাসীদের তাদের সমস্ত কিছু ফিরিয়ে দেন। আমরা সঙ্গে আছি। এই সরকার পুঁজিপতিদের সরকার, বেকার যুবকদের কাজ না দিয়ে তাদেরকে ব্যাবহার করে দেশকে গৃহযুদ্ধের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। দেশের কোন জায়গা তারা বাকি রাখেনি তাদের কব্জাই আনতে। আজ যে বিচারপতি স্বামী অসিমানন্দকে জেল থেকে ছাড়া দিচ্ছেন কালকে সেই বিচারপতি বিজেপর হয়ে নির্বাচনে প্রার্থী হচ্ছেন। তিনি সবাইকে সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টি অফ ইন্ডিয়ার আন্দোলনে সামিল হওয়ার ডাক দিয়ে তাঁর মূল্যবান বক্তব্য শেষ করেন।

সর্বভারতীয় সভাপতি এম. কে. ফাইজি

কেন্দ্রীয় সভাপতি এম. কে. ফাইজি বলেন বর্তমান ভারতের পরিস্থিতি অত্যন্ত ভয়ঙ্কর। বর্তমান পুঁজিপতিদের সরকার সাধারণ জনগণের জন্য গত ৫ বছরে কিছুই করেনি, শুধুমাত্র ১৫ লাখের ভুয়ো প্রতিশ্রুতি এবং আচ্ছেদিনের স্বপ্ন দেখান ছাড়া। গত UPA সরকারের আমলে যা ছিল সেগুলিকে শুধুমাত্র ধ্বংস করেছে। আমরা যদি গত ৫ বছরের কাজ সম্পর্কে বিবেচনা করি তাহলে সেটা পরিষ্কার ভাবে বুঝতে পারব। গো-রক্ষার নামে মানুষ খুন এখন ট্র্যাডিশনে পরিণত হয়েছে। গুণ্ডাদের নিজের হাতে আইন তুলে নেওয়ার অধিকার দিয়েছে এই সরকার। কোন অপরাধী জেল থেকে ছাড়া পেলে তাকে স্বাগত জানাতে হাজির থাকছেন কেন্দ্রীয়মন্ত্রী পর্যন্ত। তারা হুমকি দিচ্ছে বিজেপির বিরুদ্ধে বললে এই রকমই হবে। সমস্ত মানুষ ভীত সন্ত্রস্ত, রাতে ঘুমাতে পারছেনা এই ভেবে যে কোন রাতে কে কখন কি বলে বসবে তার ঠিক নেই, কখন কোথায় লাইনে দাড়াতে হবে তার ঠিক নেই। নোট বন্দী কেন করেছেন দুর্নীতিবাজদের জন্য, কিন্তু প্রায় সমস্ত নোট ব্যাঙ্কে জমা পড়েছে। এদিকে নতুন নোট ছাপার খরচ, কিন্তু তবুও কালাধন দেশে ফেরাতে পারেননি। বরং অনেক সাদাধনকে দেশ থেকে পালিয়ে জেতে সাহায্য করতে পেরেছেন। বিজয় মালিয়া লন্ডন থেকে বলছেন আমি অরুণ জেটলিকে জানিয়ে এসেছি। আর এদিকে অরুণ জেটলি বলছেন “আমাকে পার্সোনালি বলেছে অফিসিয়ালি জানায়নি”। ইত্যাদি রকমের নাটক আমরা দেখতে পাচ্ছি। কোন মানুষ যদি কোন রকমের অপরাধ করে থাকে তাহলে তাঁর পাসপোর্ট সর্বপ্রথম বাজেয়াপ্ত করা হয়, কিন্তু অর্থমন্ত্রী জানছেন সে লন্ডন যাচ্ছে তবুও ব্যাবস্থা গ্রহণে সক্ষম হননি। বর্তমানে কিসান মরছে, সাধারণ মানুষের ব্যাবসা ধুঁকছে, দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা দিনদিন নীচে নামছে, সবজায়গাই ধর্ষণ-মারামারি-হানাহানি-কাটাকাটি চলতেই আছে। আর এইসবের দিকথেকে মানুষের মনকে অন্য দিকে ভাগ করে দেওয়ার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে আগামী লোকসভা নির্বাচনের প্রচারে কিছু বাক্য বলার জন্য। কারণ তাদের কাছে তো কিছুই নেয় নির্বাচনে বলার জন্য। অনেকের দাবী আসামে যে এন আর সি করা হয়েছে তা ভারতের সবজায়গাই করা। ফাইজি দাবী করেন যদি সঠিক ভাবে এন আর সি করা হয় তাহলে দেশের ৫০% এমপি দেশ ছাড়া হবে, এমনকি অমিত শাহ দেশে থাকবে কিনা সন্দেহ রয়েছে। দেশে অঘোষিত এমারজেন্সি চলছে,  আজকে যারা বিজেপির বিরুদ্ধে বলবে তারই দেশদ্রোহী, মিডিয়া তার বিরুদ্ধে বললে বিজ্ঞাপন পাবেনা। অর্থাৎ বিজেপি = দেশ এ পরিণত হয়েছে। ইংরেজদের কাছ থেকে ভারতকে একবার স্বাধীন করা হয়েছে, এদের হাত থেকে আবার ভারতবাসীকে এগিয়ে আসতে হবে। যাদের নাম এই এন আর সি তে আসেনি তাদের নাম অবিলম্বে তালিকাভুক্ত করতে হবে। সমস্ত স্যেকুলার দলকে রাজনৈতিক অহংকার ভুলে একজোট হতে হবে এবং একজোট হতে বাধ্য অরার জন্য সমস্ত মানুষকে একজোট হয়ে SDPI এর আন্দোলনে সাম্মিল হওয়ার আবেদন জানিয়ে তাঁর বক্তব্য শেষ করেন।

বন্দীমুক্তি কমিটি সম্পাদক ছোটন দাস

বন্দিমুক্তি কমিটির সম্পাদক ছোটন দাস তাঁর ছোট এবং মূল্যবান বক্তব্যে বলেন আসামে ১৯৭১ থেকে ২০০৩ পর্যন্ত ১১৬৩৬ জন মানুষকে অনুপ্রবেশকারী হিসাবে চিহ্নিত করেছিল তা এফিডেবিট করে জানিয়েছিল। কিন্তু আজকে ২০১৮ আসতে আসতে সেটা ৪০ লক্ষে পৌঁছে গেল কি করে? বাংলাদেশ থেকে যে অনুপ্রবেশকারীরা প্রবেশ করছে তা কি ভারত সরকার কোনদিন বাংলাদেশ সরকারকে অফিসিয়ালি জানিয়েছে? আথচ বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে চা খেতে খুব ভাল পেরেছেন। তিনি বলেন, ‘এই যে পশ্চিমবঙ্গের কিছু মানুষ যাদেরকে দিলিপ ঘোষ বা তাদের পাণ্ডা বলে চিনি তারা বলছে পশ্চিমবঙ্গেও এন আর সি করতে হবে। আমি চ্যালেঞ্জ দিচ্ছি চেষ্টা করে দেখাক”। আজকে এই সমস্ত কাজ তারা করছে, এটাই হচ্ছে দুরবলাতার লক্ষণ, তারা ভয় পাচ্ছে বলেই এই অপপ্রচার চালাচ্ছে। আজকের এই এন আর সি নিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ৮০ টি মানবাধিকার সংগঠন আন্দোলন করেছে। তিনি পিবি সেলির একটি কবিতার মধ্যদিয়ে তার বক্তব্য শেষ করেন-

“হে সিংহ জেগে ওঠ, নাড়া দাও তোমার শরীরকে, দেখবে চেনগুলি জঙের মতো ঝরে পড়বে, যা দিয়ে তোমাকে বাঁধা হয়েছিল ঘুমন্ত অবস্থায়, তুমি অনেক আর তারা সামান্য”

“Rise like Lions after slumber In unvanquishable number-, Shake your chains to earth like, dew, Which in sleep had fallen on you, Ye are many-they are few.”

পপুলার ফ্রন্ট অফ ইন্ডিয়ার রাজ্য সাধারণ সম্পাদক ড. মিনারুল ইসলাম

এছাড়াও বক্তব্য রাখেন পপুলার ফ্রন্ট অফ ইন্ডিয়ার পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সভাপতি ড. মিনারুল সেখ। তিনি বলেন আসামের যে পরিস্থিতি তৈরি তা পরিকল্পিত। একেরে পর এক সমস্যা যা তারা তৈরি করেছে তাকে ধামাচাপা দেওয়ার জন্য এই প্রচেষ্টা। জনগণকে বলা হচ্ছে তুমি ভারতীয় সন্তান তার প্রমাণ পত্র দেখাও। তিনি বলেন এল কে আদবানিও দেখাতে পারবেনা সঠিক ভাবে, কোন রকমের কারচুপি নাকরে। প্রমাণ করতে পারবেনা নরেন্দ্র মোদীও  তিনি ভারতীয় সন্তান হতে পারেন গোমাতার সন্তান। গণতন্ত্র যখন প্রতিষ্ঠিত ছিলনা তখন ১% মানুষ ৯৯% মানুষকে দাস বানিয়েছিল। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরেও সেই একই ১% মানুষের হাতে শাসন ক্ষমতা রয়ে গেল। বদলে গেল মাত্র বোতুলটি মদ কিন্তু রয়ে গেল একই। মানবাধিকার রক্ষার জন্য সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টি অফ ইন্ডিয়ার আয়োজিত সভার জন্য ধন্যবাদ জানান এবং মানবাধিকার রক্ষার্থে যেকোনো আন্দোলনে সামিল হওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে তাঁর বক্তব্য শেষ করেন।

বক্তব্য রাখেন সুকৃতি রঞ্জন বিশ্বাস মহাশয়ও। তিনি প্রাধান্য দেন সংবিধানের “১৪ এ’’ ধারা বাতিলের উপর। কারণ এন আর সি করার যে অধিকার তারা পাচ্ছে এখান থেকেই।

মজিদুল হক বলেন ভারতের আভ্যান্তরিন সম্পর্ককে বিনাশকারী যে রথযাত্রা আরএসএস আয়োজন করেছে তার বিরুদ্ধে রুখে দাড়াতে হবে।

পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য আফাতব আলম সকলকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করে সভা সমাপ্ত করেন।

 

Back To Top