পুরীর মন্দিরে প্রবেশাধিকার

পুরীর জগ্ননাথ মন্দির

রামনাথ কোবিন্দ ভারতের রাষ্ট্রপতি, প্রধান নাগরিক। শূদ্র। তাই তিনি পুরীর মন্দিরে প্রবেশাধিকার পাননি। চৌকাঠে নমো নমো করে পূজার অর্ঘ দিয়ে ফিরে গেলেন। বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ব্রাত্য ছিলেন না। মন্ত্রহীনও নন। উপনিষদের মন্ত্রে দীক্ষিত ছিলেন। তাঁর নৈবদ্য দেবতার বন্দীশালায় পৌঁছায়নি। তাহলে কাদের নৈবদ্য পৌঁছাবে? বিশ্ব কবি তাঁর অন্তজ্বালার বহিঃপ্রকাশ –‘আমি ব্রাত্য, আমি মন্ত্র হীন / দেবতার বন্দীশালায় আমার নৈবদ্য পৌছালনা’।

অব্রাহ্মণের পূজার কোন অধিকার নেই। রবীন্দ্রনাথরা ব্রাহ্মণ কিন্তু পিরালী ব্রাহ্মণ। পির+আলি=পিরালী। মুসলমানি গন্ধে ভরা। তাই অস্পৃশ্য। ব্রাহ্মণ ধর্মের সমাজব্যবস্থা ভাঙতে তে পারেনি, যা দাড়িয়ে আছে বর্ণপ্রথার উপর। বেদ, উপনিষদ, পুরাণ ধর্মপ্রন্থ সমতুল্য মহাকাব্য রামায়ণ মহাভারত সর্বত্রই রয়েছে অস্পৃশ্যের স্বীকৃতি। রামরাজ্য নেই শূদ্র শম্বুকের বেদ পাঠের অধিকার নেই, মন্দিরে নেই প্রবেশাধিকার। পুরীর মন্দির দর্শনে গেলে, এই কারনে, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথকেও প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি জগন্নাথ মন্দিরে।

ভারতের ব্রিটিশ রাজ ভারত সমাজ বিষয়ে ব্রাহ্মণের মান্যতা দিত। ব্রিটিশ রাজের সরকারি বিজ্ঞপ্তিতে ১৮০৯ সালের রেজুলেসন -৪ সেকশন – ৮ সেকশন পুরীর মন্দিরে প্রবেশাধিকার যারা পাবেনা, তাদের মধ্যে পিরালিদেরও উল্লেখ রয়েছে। কারণ তারা অস্পৃশ্যের তালিকা, রবীন্দ্রনাথ পিরালীদের উত্তর পুরুষ। এই কারণে রবীন্দ্রনাথকে পুরীর মন্দিরে প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি। তারই কি অন্তজ্বালা –‘আমি ব্রাত্য, আমি মন্ত্র হীন / দেবতার বন্দীশালায় আমার নৈবদ্য পৌছায়না’। শ্রীচৈতন্যও ভাঙতে পারেননি ব্রাহ্মণ্যশাস্ত্র। তিনি কি তা চেয়েছিলেন? তাঁকে ব্রাহ্মণ পুরোহিতরা খুন করেছিলেন! মন্দির ভাঙ্গা গড়ার রাজনীতি অর্থনীতি এত জটিল সমীকরণ। ‘কোন কালে ভারত শান্তির নীড় ছিল’? ইসলাম ধর্মের আবির্ভাবের বহুকাল পূর্ব থেকেই ভারতে ছিল ধর্মীয় হানাহানি।

ভারতে মুসলমান শাসন সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের অসামান্য উক্তি –‘মুসলমান রাজত্ব ভারতবর্ষেই প্রতিষ্ঠিত ছিল। বাহিরে তাহার মূল ছিলনা। এই জন্য মুসলমান ও হিন্দু সভ্যতা পরস্পর জড়িত হইয়াছিল। পরস্পরের মধ্যে স্বাভাবিক আদান প্রদানের সহস্র পথ ছিল’।

প্রখ্যাত ঐতিহাসিক ডি এন ঝা ‘এগেইনস্ট দ্যা গ্রেন নোট্‌স অন আইডেন্টিটি, ইন্টলারেন্স অ্যান্ড হিস্ট্রি’ গ্রন্থে লিখেছেন ব্রাহ্মণ্যবাদীদের বহু প্রতিষ্ঠান। এমনকি পুরীর মন্দির গড়ে উঠেছিল বৌদ্ধ ধর্মের প্রতিষ্ঠানের ধ্বংসাবশেষের উপর অনন্ত বর্মণ ছোট গঙ্গা দেবার শাসন কালে দ্বাদশ শতাব্দীতে।

পুরীর মন্দির নিয়ে তর্ক থাকতে পারে। কিন্তু পূর্ণেশ্বরা, কেদারেশ্বরা, কান্তশ্বরা এবং পুরি জেলায় অঙ্গেশ্বরা যে বৌদ্ধ ধর্মের প্রতিষ্ঠানের ধ্বংসাবশেষের উপর গড়ে উঠেছিল তা নিয়ে বিতর্কের কোন অবকাশ নেই। বৌদ্ধ ধর্মের অন্তর্গত মাতারার মন্দিরগুলি –মাতারা তো বৌদ্ধ দেবী। বাংলার তারা মায়ের তারাপীঠ বৌদ্ধ মন্দির। আমার (এই লেখকের) মমতার, তারা মায়ের বাড়ি তারাপীঠ।

মুঘলরা ভারতবর্ষের প্রায় তিনশত বছর রাজত্ব করেছেন। মুঘল সম্রাট বাবর, হুমায়ূন, আকবর (১৫২৬ থেকে ১৬০৫ খ্রীঃ) প্রধানত আফগান সুলতানদের পরাজিত করে ক্ষমতাসীন হয়েছিলেন। তাদের হিন্দু –হিন্দু মন্দিরের অবমান ঘটার অবকাশই ছিলনা। বাবর যখন দিল্লি দখল করেন তখন দিল্লির সুলতান ছিলেন আফগান সুলতান ইব্রাহীম লোদী। অযোধ্যার রাম মন্দির মুঘল সম্রাট বাবরের নির্দেশে বাবরী মসজিদ গড়ার গড়ার সাম্প্রদায়িক উদ্দেশ্য প্রণোদিত মিথ্যা কল্পকাহিনী ঐতিহাসিক ভাবে ভিত্তিহীন হিন্দুত্ববাদী প্রচার। ইতিহাস সচেতন ব্যক্তি মাত্রই জানেন যে রামচন্দ্র কোন ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব নন, মহাকাব্যের কল্পিত ন্যক। অতএব রামচন্দ্রের জন্ম বা জন্মভুমি অলীক কল্পনামাত্র। কোন ঐতিহাসিক প্রমাণ নেই বাবর কোন হিন্দু মন্দির ধংস করে তার উপর মসজিদ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।

বাবরের জন্মের ১৬ বছর পূর্বে সুলতান হুসেন শাহ মারকী মসজিদটি তৈরি করেন ৮৭২ হিজরি সনে। বাবর জন্ম গ্রহণ করে ৮৮৮ হিজরি সনে। ঐতিহাসিক শেঠ সিং তাঁর “আর্কেয়লজী অফ বাবরী মসজিদ” গ্রন্থে তর্কাতিত ভাবে প্রমাণ করেছেন। সুতরাং রাম জন্মভূমি প্রচারিত কাহিনী কাল্পনিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত।

বাবরের সমসাময়িক গুরুনানক। গুরুনানক যখন যুবক তখন কবীরের সঙ্গে নানকের সাক্ষাৎ হয়। কবীর তখন বয়োবৃদ্ধ। গুরুনানক বাবরের সমালোচন করলেও বাবরের মন্দির ভাঙার কথা বলেননি। তুলসি দাস অযোধ্যায় রয়ে ‘রামচরিত মানস’ লিখেছেন। তিনি রামমন্দির ভাঙার কথা বলেননি। অযোধ্যায় ১৪ টি রাম মন্দির রয়েছে। প্রতিটি মন্দিরের মোহন্ত বলতেন রাম তার মন্দিরে জন্মেছে। কিন্তু রামের জন্মতো ১৪ বার হয়নি।

ইবন বতুতার ভ্রমন কাহিনী থেকে জানা যায় রাজকোষের আর্থিক সমৃদ্ধির জন্য কাশ্মীরের হিন্দু বৌদ্ধ মন্দিরের সোনা রূপোয় নির্মিত মূর্তিগুলি গুলিয়ে ফেলায় পরামর্শ দেন সুলতানের ব্রাহ্মণ মন্ত্রী। কাশ্মীরের সুলতান সিহাস আলাদিন রাজত্বকালে (১৩৫৫-১৩৭৭) দৃঢ় ভাবে প্রত্যাখ্যান করে, উপয়ুদ্ধ রুপে সুরক্ষিত করার নির্দেশ জারি করেন। কাশ্মীরের হিন্দু রাজা হর্ষ  ধনসম্পদের লোভে  বহু হিন্দু মন্দির লুণ্ঠন ও দেবীমূর্তি ধংস করে ইতিহাস খ্যাত হয়ে আছেন। ধর্ম নয় সম্পদই প্রয়বিতিত করত মন্দির লুণ্ঠনে মূর্তি ধংসে।

হিন্দু মন্দিরের সুরক্ষা ও রক্ষণাবেক্ষণে ভারতীয় মুসলিম রাষ্ট্রের ভূমিকা মুঘল সম্রাটদের আমলে প্রামাণ্য ঐতিহাসিক বিবরণে স্বীকৃত। বাবর, হুমায়ূন ও আকবরের পরে জাহাঙ্গীর, শাহজাহান ঔরঙ্গজেবের সময় পুরীর মন্দির ও রথযাত্রা অনুষ্ঠানে তদারকির কাজে বিশেষভাবে নিযুক্ত থাকতেন মুঘল সম্রাটদের প্রতিনিধি হিসাবে উড়িষ্যার জনমবদার, রথযাত্রার সময় মনসবদার সম্রাটের প্রতিনিধি হিসাবে জগন্নাথ মূর্তির পাশের রথে চড়ে অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করতেন। পুরীর মন্দিরের পুরোহিতরা মুঘল সম্রাটদের পুরীর মন্দিরের রক্ষক হিসাবে গণ্য করতেন –ঔরঙ্গজেবের আমলেও এটা লক্ষ্য করা যায়।

ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীরা ও তাদের দেশিয় অনুগামীরা যতই ঔরঙ্গজেবকে হিন্দু বিদ্বেষী হিসাবে কলঙ্কিত করুক না কেন আধুনিক গবেষণায় প্রমাণিত তিনি তার পূর্বসুরী মুঘল সম্রাটদের মতই হিন্দু মন্দিরগুলির সুরক্ষা রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব পালন করেছেন। বারানসির বাঙ্গালিটোলায় জদম বাড়ী মাঠে রক্ষিত ঔরঙ্গজেবের ফরমান থেকে জানা যায় তিনি মঠে অর্থদান, ভুমিদান ও পূর্বের অনুদানও চালু রাখেন। ইলাহাবাদের সোমেশ্বরনাথ মহাদেব মন্দির, উজ্জয়নির মহাকালের মন্দির, চিত্রকূটের বালাজি মন্দির, গুয়াহাটি উপনদ মন্দির এমন অসংখ্য মন্দিরের জায়গীর দান করেছেন। মহাকালেশ্বর মন্দিরে চব্বিশঘণ্টা ঘিয়ের প্রদীপ জালানোর জন্য ঔরঙ্গজেব দৈনিক চারসের ঘি বরাদ্ধ করেছিলেন।

ঔরঙ্গজেব এক চিঠিতে লিখেছেন ‘ইহজাগতিক বিষয়ের সঙ্গে ধর্মের কী সম্পর্ক? কী অধিকার আছে ধর্মের প্রশাসনের কাজে নাক গলানোর? তোমার ধর্ম তোমার জন্য, আমার ধর্ম আমার’। মেবারের রাজা রাজ সিংহকে প্রেরিত নিশানে লিখেছেন ‘যে রাজা অন্য ধর্মাবলম্বীদের প্রতি অসহিষ্ণুতা দেখায় সে ঈশ্বরের বিরুদ্ধেই অপরাধী’। ঔরঙ্গজেবের পত্রের ‘তোমার ধর্ম তোমার জন্য, আমার ধর্ম আমার’ কুরআনের উক্তি।

পট্টাভি সীতারামাইয়ার ‘দ্যা ফেদাস অ্যান্ড দ্যা স্টোন্স’ এবং বি এন পাণ্ডের ‘ইসলাম অ্যান্ড ইন্ডিয়ান কালচার’ বইটি বাংলা ভাষায় অনুবাদ হয়েছে কলকাতায়। গ্রন্থ দুটিতে হিন্দু মন্দির রক্ষণাবেক্ষণে ঔরঙ্গজেবের ভূমিকা বিষদে আলোচিত। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীদেরও তাদের অনুগামী সাম্প্রদায়িক মনভাবের ভারতীয় ইতিহাস লেখকদের ঔরঙ্গজেবের অপপ্রচারের বিরুদ্ধে বিপিনচন্দ্র, রমিলা থাপার, হরবনস মুখিয়া, সতিসচন্দ্র, ডেকে দত্ত, বরুন দে, প্রুমুখ প্রখ্যাত আধুনিক ইতিহাসবিদ গন তাদের তথ্য বহুল গবেষণায় ঔরঙ্গজেবের ‘হিন্দু বিদ্বেষের’ কল্পকাহিনী চূর্ণ করে লিখেছেন।

পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী পুরীর মন্দিরের প্রবেশে পথ আটকায়। সংঘীদের এই পথ ডিঙ্গিয়ে মুখ্যমন্ত্রী বন্দ্যোপাধ্যায় পুরীর মন্দিরে প্রবেশ করেন। আইনজীবী এবং বিচারপতিগণ বলেন সবার জন্য পুরীর মন্দিরের পথ খুলে দেওয়া হোক।

শাস্ত্রে কি তার অনুমোদন রয়েছে?

 

লেখকঃ মুহাম্মদ হেলালউদ্দিন,  

(ছবিঃ bing.com)

(মতামত লেখকের নিজস্ব)

 

Back To Top