রক্তাক্ত ঊনিশে মে : বাংলা ভাষা মুক্তির গৌরব অধ্যায়-৩

মহম্মদ রাকিবুল আহমেদ…

দ্বিতীয় প্রকাশের পর……

এত গেল সমসাময়িক প্রেক্ষাপট, ঘটনা, বাংলা ভাষার জন্য হৃদয় নিংড়ানো অপরিসীম ভালভাসা, আত্মত্যাগ। সমগ্র অসমে না হোক বরাক উপত্যকায় বাঙালি বাংলাকে সরকারী ভাষার মর্যাদা পেয়েছে। স্বপ্নের বিশ্ববিদ্যালয় ‘অসম কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়’ নির্মাণ করেছে। অসমের বাঙালির এত বড় আত্মত্যাগের ঘটনা আমরা অনেকেই জানিনা। বা জানার চেষ্টা পর্যন্তও করিনা। এতটায় নির্লজ্জ, আত্মাবিমুখ, আমরা। অথচ সব কাজে শিক্ষিত বাঙালি যোদ্ধার মত আঙুল তুলি, গলা উঁচিয়ে নাক বাড়িয়ে কথা বলি। শুধু মুখে বাংলা ভাষা বললেই ভাষা বাঁচেনা। বঙ্কিমচন্দ্রের কথায় –‘যতদিন না সুশিক্ষিত জ্ঞানবন্ত বাঙালিরা বাংলা ভাষায় আপন উক্তিসকল বিন্যস্ত করিবেন না, ততদিন বাঙালির উন্নতির কোন সম্ভাবনা নাই’।

এ প্রসঙ্গে প্রমথ চৌধুরীর কিছু রক্ত গরম করা বক্তব্য তুলে ধরা সমীচীন মনে করছি –‘…সুতরাং যারা মাতৃভাষার যথার্থ ভক্ত, তাদের পক্ষে যে ভাষাকে সাহিত্যের রাজপাটে বসাবার জন্য এখনো বহুদিন ধরে বহু চিন্তা বহু চেষ্টা করতে হবে। বঙ্গ স্বরস্বতীর চরণে পুষ্পাঞ্জলি দেওয়াই আমাদের একমাত্র কাজ নয়, তাতে ভক্তির পরিচয় দেওয়া হতে পারে কিন্তু জ্ঞানকর্মের হয়না। অতএব জীবনের সকল ক্ষেত্রে বাংলা ভাষার স্বত্বস্বামিত্ব সাব্যস্ত করবার জন্য প্রতিপক্ষের সঙ্গে আমাদের পদে পদে তর্ক করতে হবে। এক কথায় বঙ্গ সরস্বতীর সেবককে তাঁর সৈনিকও হতে হবে’। (বাংলার ভবিষ্যৎ’ তৃতীয় অনুচ্ছেদ, পৃষ্ঠা – ১২৭)

একষট্টি ভাষা আন্দোলনের ফলে বরাকের সরকারি ভাষা হিসাবে বাংলা স্বীকৃতি পেলেও আগ্রাসন থেমে থাকেনি। দিসপুর থেকে বিভিন্ন জনসংশ্লিষ্ট সরকারি বিভাগে যেসব পুস্তিকা, প্রচার পত্র, আবেদন পত্রের নমুনা প্রভৃতি প্রেরণ করা হয় তাতে অসমিয়া ভাষাই ব্যবহৃত হয়ে থাকে। সাম্প্রতিক কালে অসমে চালু হয়েছে ‘সর্বশিক্ষা অভিযান মিশন’। এই মিশনের মাধ্যমে বাংলা সংস্করণের পাঠ্যপুস্তকে অসমীয়া শব্দ ও বাক্যবন্ধ এবং কোন কোন অধ্যায় সম্পূর্ণভাবে অসমিয়াতেই ছাপিয়ে দিয়ে ‘শিকন পুথি’ নামক এই তথাকথিত পাঠ্যবইগুলির মাধ্যমে উপত্যকার তিন জেলার শিশু কিশোরদের উপর কূটকৌশলী চক্রান্ত শুরু করেছে। সর্বত্র প্রতিবাদের ঝড় উঠলেও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ নিরব ভূমিকা পালন করছেন। অসম সরকারী ভাষা আইন (১৯৬০) ও সরকারী ভাষা সংশোধনী আইন (১৯৬১) অনুযায়ী বরাক উপত্যাকার সমস্ত ধরণের অভ্যন্তরীণ যোগাযোগের মাধ্যম বাংলা হলেও, স্থানীয় আমলারা তা কার্যকর করছেন না। জেলা পরিষদ, পুরসভা, টাউন কমিটিগুলিরও একই দশা।

শুধুমাত্র আন্দোলন এবং বিদ্রোহের কথা শুনে তাৎক্ষণিক আবেগের আতিশয্যে ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠার কোন মূল্য নেই। বিদ্রোহের অগ্নি স্ফুলিঙ্গ থেকে, শহীদের রক্তপদ্ম থেকে মাতৃ ভাষাকে বাঁচিয়ে রাখার, শহীদ দিবস, পালন নয় –তাকে লালন করার দৃঢ় প্রতিজ্ঞা নিতে হবে তা না হলে একদিন পরমপ্রিয় বাংলা ভাষা কালের কৃষ্ণগহ্বরে পতিত হবে।

উইনেস্কো তার সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে সারা বিশ্বে প্রচিলিত ৬০০০ ভাষার মধ্যে ২৫০০ ভাষা নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার পথে। এই ভাষা বিপদের বার্তা যখন ছড়িয়ে পড়েছে তখন মনে পড়ে দু’হাজার বছর পূর্বে হিব্রু ভাষার মৃত্যু ঘটেছিল। কিন্তু ইসরাইল রাষ্ট্র সেই মৃত হিব্রু ভাষাকেই দেশের রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দিয়ে তাকে বিভিন্ন কাজে ব্যবহার করেছে। আয়ারল্যান্ডে মৃতপ্রায় ভাষাকে পুনর্জীবিত করে তাকে সব কাজে ব্যবহার করার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। ১৮১৪ সালে ডেনমার্কের অধীনতা থেকে ডেনমার্ক মুক্ত হয় এবং ১৮৪০ সাল নাগাদ একটি নতুন ভাষা তৈরি করে তাকে সব কাজে ব্যবহার করা শুরু করা হয়। ওই ভাষার নাম ‘ল্যান্ডসমল’। ষোলশ বছর আগে মিশরে যে ভাষার প্রাধান্য ছিল, ২৬তম রাজবংশের আমলে সেই ভাষাকে আবার পুনর্জীবিত করে তাকে ব্যবহার করা শুরু হচ্ছে। বিশ্বে বিভিন্ন ছড়িয়ে থাকা এরকম অনেক উদাহরণ লক্ষ্য করা যাবে। এক কথায় মাতৃভাষাকে যদি সর্বক্ষেত্রে প্রচার-প্রসার ঘটানো যায় তবেই ভাষা সফলতা পাবে। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ভাষাতাত্ত্বিক নোয়াম চমস্কির ১৯৫৫ সালে পেশ করা গবেষণাপত্রের শিরোনাম ছিল –‘Transnational Analysis’ সেখানে শিক্ষার ক্ষেত্রে মাতৃভাষার গুরুত্বের কথা উল্লিখিত ছিল এবং পরবর্তী সময়ে ১৯৬৮ সালে তাঁর রচিত ‘Language and Mind’ এবং ১৯৭৫ সালে প্রকাশিত গ্রন্থ ‘Reflection on Language’ এ মাতৃভাষার গুরুত্ব সবিস্তারে ব্যাখ্যা করেছেন।

ভারতীয় সংবিধানের অষ্টম তালিকায় স্বীকৃতভাষার সংখ্যা ২২ টি। এর মধ্যে ২০০৩ সালে সংবিধানের শততম সংশোধনের সাহায্যে ৪-টি ভাষা যথা – বোড়ো, সাঁওতালী, মৈথিলি এবং ডগরী যুক্ত হয়েছে। ভাষাভাষী মানুষের সংখ্যার বিচারে ভারতে হিন্দির পরেই বাংলার স্থান। বিশ্ববাসীর অর্ধেকের বেশি মাতৃভাষা ৮ টি, যথা চীনা, ইংরাজী, হিন্দি, স্পানিশ, রুশ, বাংলা, আরবী এবং পর্তুগীজ। ভারতীয় ভাষাগুলির মধ্যে একমাত্র বাংলা ভাষার ভাগ্যে মিলেছে নোবেল (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ১৯১৩ সালে) এই ভাষাতেই সত্যজিৎ রায় অস্কার বিজয়ী এবং এই ভাষা আজও তাই সাহিত্যসৃষ্টিতে পৃথিবীতে অন্যতম আলোকস্তম্ভ। বিজ্ঞান, দর্শন, ইতিহাস, রাষ্ট্রনীতি, অর্থনীতি, প্রভৃতির অস্তঃস্বর লালিত বাইরেখিক পরিচয় সোল এই ভাষার, তবু এই ভাষাকে পদদলিত করার চক্রান্ত প্রতি পদে পদে। তাই সাবধান বাঙালি। কপালে বলিরেখা পড়ার আগেই তার ব্যবস্থা করতে হবে।

যে বাঙালির রক্তে এত তেজ, দীপ্তি, তারুন্য—সেই বাঙালি কেন ঘরের কোনে বসে থাকবে, কেন তার মুখে প্রতিবাদের ভাষা হারিয়ে যাবে, কেন ভাষাপ্রেম মুখ থুবড়ে পড়বে? অসমের বাঙালিদের এখন ত্রি-স্তরের লড়াইয়ের সম্মুখীন হতে হচ্ছে। আন্তর্জাতিক স্তরে ইংরেজি ভাষার আক্রমনণ, রাষ্ট্রীয় স্তরে ইংরেজি ভাষার আক্রমণ, রাষ্ট্রীয় স্তরে হিন্দি ভাষার আক্রমণে বাঙালিদের নাভিশ্বাস। আমরা তো তাদেরই সহোদর। তাই তাদের জন্য কিছু ভাবা, কিছু করা একান্তই কর্তব্য। অতীতের কাহিনি থেকে শিক্ষা নিয়ে বর্তমান সময়ের পেক্ষাপটে আগে থেকেই নতুন বাংলার বীজ বপন করতে হবে। তা না হলে পশ্চিমবাংলার অবস্থাও একদিন বিহার, ঝাড়খণ্ড, ওড়িশা, মহারাষ্ট্র, আন্দামান, অন্ধ্রপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, উত্তরপ্রদেশ, উত্তরাখণ্ড, অসম হয়ে যাবে। মনে রাখতে হবে ১৯৪৭ সালের ক্ষমতা হস্তান্তরের পর থেকে মাতৃভাষার অধিকার লোপে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত বাঙালি সম্প্রদয়। তাই নিজের ভাষা ও সংস্কৃতি রক্ষা না করতে পারার অপরাধ – মাতৃভাষা রক্ষা না পাবার অপরাধের সমান। পাশাপাশি ইংরাজি ও হিন্দিদৈত্য থেকেও সচেতন থাকতে হবে।

সবচেয়ে, আবারও বলি -এই বাংলার জন্য, এই মাতৃভাষার জন্য, এই দুঃখিনী বর্ণমালার জন্য, এই মাতৃ দুগ্ধের জন্য উদার মন নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। ভাবতে হবে, ভাবাতে হবে, সচতন যেমন হতে হবে, তেমনী সচেতনা নিয়ে আসতে হবে। সর্বস্তরের মানুষকে আসতে হবে। কারণ – ‘চারিদিকে নাগিনীরা ফেলিতেছে বিষাক্ত নিঃশ্বাস’। -এ বিষাক্ত নিঃশ্বাসের প্রকোপে হয়তো বা একদিন পৃথিবীর চতুর্থ বৃহত্তম ভাষা ‘বাংলা’ ও ভেসে যেতে পারে। ভেসে যেতে পারে রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, রোকেয়া, সুকান্ত, হরিচাঁদ-গুরুচাঁদের মাতৃভাষা। গণতান্ত্রিক ভারতবর্ষে এখন ভাষার সাংবিধানিক অধিকার দেখলে লজ্জায় মুখ লুকাতে হয়। স্বভাব কবি পুতুল মুখোপাধ্যায়ের কথায় –“ভাষার অধিকার মানে কবিতা লেখার অধিকার মাত্র নয়’। -আমাদের তাই সচেতন থাকতে হবে ভাষা ক্ষমতায়ন, ভাষা-অর্থনীতি, ভাষা-সংস্কৃতি প্রসঙ্গে এখনি ঘুম ভাঙাতে হবে ঘুমন্ত বিবেককে। রক্তের ভিতর প্রতিটি অনুকে উজ্জীবিত করতে হবে। আমরা যেন কখনোই ভুলেও না ভুলি – ‘জানেন দাদা, ছেলের বাংলাটা ঠিক আসে না’ –তা হলে এ সোনার বাংলা, এ সাজানো সংসার সব শেষ হয়ে যাবে এক দিন –

“উম্মুক্ত মৃত্যু হা করে এগিয়ে আসছে

স্বাধীনতার নূপুর ছিনিয়ে নিতে –

যত প্রাত্যাশিত লোভ – বঞ্ছনা গীবত যৌনতা

যেন নিষ্ঠুর আক্রোশের মত প্রমত্ত

অথচ এই দেশ আমার সাজানো  সংসার

আতরের ঘ্রাণ …. ’’ (ভারতবর্ষ, মহম্মদ রাকিবুল আহমেদ)

হ্যাঁ, ঠিকই তো। এই ‘আতরের ঘ্রাণ যদি আপামোর বাঙালির স্বর্ণ শরীরে মাখিয়ে নেওয়া যায় তবেই বাঙালির বাংলা একদিন নির্মাণ করবে ‘পথের পাঁচালী’। আমরা বনফুলের কবিতার কয়েক্তি পঙক্তি দিয়ে প্রসঙ্গের ইতি টানতে পারি—

“মাতৃভাষার মান বাঁচাতে যারা প্রাণ দিয়েছো বীর, তোমরা যারা বুঝিয়ে দিলে প্রাণের চেয়ে মানবতা বহু বড় প্রণাম লহ, প্রণাম লহ, শোকাচ্ছন্ন বঙ্গ কবির,

ওরে অসাড় বঙ্গবাসী, ওদের লাগি অর্ঘ কর জড়ো।”

( ঊনিশে মে প্রণাম লহ)

সমাপ্ত…..

 

 

তথ্যসূত্রঃ

১। ‘আজকের চোখে ১৯৬১-র উনিশে মে’ -নীতিশ বিশ্বাস।

২। ‘ঐতিহাসিক ১৯ শে মে ও মাতৃভাষা’ –ড. জীবন কুমারদত্ত।

৩। ‘উনিশে মে বাঙালির আরও একটি মুক্তির পথ’ –ঐ।

৪। ‘বাঙালির মাতৃভাষা চর্চা – প্রসঙ্গ বহির্বঙ্গ’ –কপিলকৃষ্ণ ঠাকুর।

৫। ‘ভারতের ভাষানীতি ও বাংলা’ — অধ্যাপিকা এশা দে।

৬। ‘১৯ শের মের ইতিহাস’ ঐতিহাসিক ১৯শে মে’ -অমিতাভ চৌধুরী (সাংবাদিক)।

৭। ‘উনিশে মে – বাংলাভাষার ইতিহাসে একটি রক্তাক্ত অধ্যায়’ -মাশুক আহমদ।

৮। ‘বরাকের ভাষা আন্দোলনে একাদশ শহীদ কথা’ – নীতীশ বিশ্বাস।

৯। ‘আ-মরি বাংলাভাষা : এক উপেক্ষিত শহীদ কথা’ – নীতীশ বিশ্বাস।

১০। ‘মাতৃভাষার হীনমন্যতা : একটি ঝাড়খণ্ড চিত্র’ – মনিপুঞ্জক আচার্য।

১১। ‘ভাষা সম্পর্কে কয়েকটি কথা’ কান্তি বিশ্বাস।

১২। ‘প্রবন্ধ সংগ্রহ’ – প্রথম চৌধুরী।

১৩। ‘একটুকরো রোদ’ – মহম্মদ রাকিবুল আহমেদ।

১৪। ‘মাতৃভাষার অধিকার’ বিপন্ন বাংলাভাষা লুণ্ঠিত বাঙালির জীবিকা -১’ – অচিন্ত্য সুরাল ও নব দত্ত।

Back To Top