সৌদী থেকে মার্কিনীদের প্রস্থানে আশার আলো দেখছে মুসলিম বিশ্ব

মধ্যপ্রাচ্যে মূলত ইসরাইলের স্বার্থ সুরিক্ষিত করে আন্তর্জাতিক তেলের বাজারে নিজেদের আধিপত্য বজায় রাখতে সৌদি আরবে এতদিন অবস্থান করছিল মার্কিন সেনা। তবে বর্তমান পরিস্থিতিতে তাদের প্রস্থান আমেরিকার জন্য যতটা না সুবিধাজনক তার থেকে অনেক বেশি কল্যাণকর হতে পরে মুসলিম বিশ্বের জন্য। লিখেছেন সাইফুল্লা লস্কর।

১৯২৩ সালে আরবদের বিদ্রোহ এবং প্রথম বিশ্বযুদ্ধের মিত্রশক্তি গুলোর চক্রান্তে সালতানাতে ওসমানিয়া বা অটোমান সাম্রাজ্যের পতনের পর থেকে মক্কা ও মদিনার দুই পবিত্র মসজিদের দায়িত্ব তুর্কিদের হাত থেকে চলে আসে সৌদিদের হতে এবং স্বাভাবিকভাবেই তারা মুসলিম বিশ্বে গুরুত্বপূর্ণ স্থানের অধিকারী হয়ে যায়। সেই সময় থেকেই আল সাউদ পরিবারদের নেতৃত্বে সৌদি আরব মুসলিম বিশ্বের অভিভাবকের ভূমিকা পালন করে আসছে বা পালেনের চেষ্টা করে আসছে। যদিও তারা মুসলিম বিশ্বের অবিভাবক হয়েও মুসলিম বিশ্বের শত্রু পশ্চিমা দেশগুলোর মন যুগিয়ে চলার চেষ্টা করেছে সব সময় কারণ রাজ পরিবারের নিরাপত্তার দায়িত্ব বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পশ্চিমা দেশগুলোর নিরাপত্তা রক্ষী ও গুপ্তচর বাহিনীগুলোর হাতে ন্যস্ত রাখতে ভালোবাসতো আল সাউদ গোষ্ঠীর সদস্যরা। যদিও ভূরাজনৈতিক সমীকরণ পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে মাঝে মাঝে এই প্রবণতার ব্যাতিক্রম ও লক্ষ করা গিয়েছে।

মার্কিনী সৈন্য দল সৌদি আরবে আগমনের বিশেষ কিছু সুস্পষ্ট কিন্তু অঘোষিত কারণ ছিল। যার মধ্যে মধ্যপ্রাচ্যে তাদের প্রতিষ্ঠিত অবৈধ রাষ্ট্র ইসরাইলের স্বার্থ সুরক্ষিত রাখা, মধ্য প্রাচ্যে অবস্থান করে তেলের বাজারের ওপর নিজেদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত করা বজায় রাখা। মার্কিন মুলুকের অনেক সরকারি ও বেসরকারি সংস্থা সৌদি আরবে তেল উত্তোলনের কাজে নিয়োজিত রয়েছে, তাদের নিরাপত্তার বিষয়টিও তাদের মধ্যপ্রাচ্যে অবস্থানের অন্য কারণ হিসেবে মনে করা হয়। আরো একটি মূল কারণ ছিল মুসলিম বিশ্বের তথাকথিত অবিভাবক দেশ সৌদি আরব ও তার দোসর আরব দেশ গুলোকে নিয়ন্ত্রণ করা।

সৌদি আরবের রাজ পরিবার নিজেদের নিরাপত্তার জন্য মার্কিনীদের ওপর চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করতো এত দিন।বিশ্বব্যাপী করোনা ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার পর থেকে বিশ্ব বাজারে তেলের চাহিদা ব্যাপক ভাবে কমে যাওয়ায় তেলের দাম ও তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। অন্যদিকে সৌদি আরব থেকে তেলবাহী বহু ট্যাংকার এই সময়ের মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পৌঁছালে আমেরিকার বাজারে তেলের দাম ১ ডলারের ও নিচে নেমে যায় যা ট্রাম্প প্রশাসনের জন্য চিন্তার কারণ হয়ে দাড়ায়। অভ্যন্তরীণ চাপের মুখে ট্রাম্প কয়েকসপ্তাহ আগে যুবরাজ সালমানকে ফোন করে তেল উত্তোলন কমানোর জন্য চাপ সৃষ্টি করেন এবং অন্নথায় সৌদি থেকে তারা যে চলে যাবে তাও জানিয়ে দেন। সে হুমকি যে মিথ্যা ছিলনা তার প্রমাণ পাওয়া গেলো অবশেষে।

গত বছর সৌদি আরামকোর তেলক্ষেত্রে ইরানের মদতপুষ্ট হুথি বিদ্রোহীদের মিসাইল হামলার পর আমেরিকা সেখানে তাদের পেট্রিয়ট মিসাইল ডিফেন্স সিস্টেম মোতায়ন করে। কিন্তু বর্তমানে করোনা জর্জরিত আমেরিকা ইরাক থেকে সেনা প্রত্যাহারের পর এখন সৌদি থেকেও তাদের পেট্রিয়ট সিস্টেম ও দুই স্কোয়াড্রন যুদ্ধবিমান সরিয়ে নিচ্ছে। বিশেষজ্ঞদের মতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এখন মধ্য প্রাচ্য থেকে সরে গিয়ে ভারত ও  প্রশান্ত মহাসাগর এলাকায় প্রভাব বিস্তারে প্রচেষ্টারত চীনের দিকে মনোযোগ দিতে চায়। কারণ মধ্য প্রাচ্যে ইসরাইল এখন স্বনির্ভর এবং শক্তিশালী একটা রাষ্ট্র তাই তাদের চিন্তা এখন আর যুক্তরাষ্ট্রকে ভাবায়না আবার মুসলিম বিশ্ব এখন সম্পূর্ণরূপে ছন্নছাড়া অবস্থায় তাই তাদের থেকে আমেরিকা এখন তেমন কোনো হুমকি প্রত্যাশা করেনা।

এমতাবস্থায় সৌদ আরব অসমাপ্ত ইয়েমেন যুদ্ধে হুথিদের থেকে নিজেদের কৌশলগত সম্পদগুলোর এবং রাজ পরিবারের নিরাপত্তার জন্য সবার প্রথমে তাদের একান্ত অনুগত সঙ্গী পাকিস্তানের দিকে দেখবে এবং সামরিক সরঞ্জাম আমদানির জন্য রাশিয়া চিন এবং তুরস্কের দিকে নজর দেবে।  আবার হুথি বিদ্রোীহ দের মতো অন্য ইরানের প্রক্সি শক্তিগুলোর হাত থেকে বাঁচার জন্য সৌদি আরব ইরানের সঙ্গে সরাসরি কথা বলতে প্রায় বাধ্য হবে যা ছিন্নবিচ্ছিন্ন মুসলিম বিশ্বের দেশগুলোর জন্য একত্রিত হওয়ার এক সুবর্ণ সুযোগ করে দেবে। পাকিস্তান বহুদিন থেকে সৌদি ও ইরানের মধ্যে সম্পর্কের টানাপোড়েন হ্রাস করার চেষ্টা করছে। এখন সৌদি আরবে পাকিস্তানের প্রাসঙ্গিকতা বাড়লে পাকিস্তান অবশ্যই ইরান ও সৌদির মধ্যে উত্তেজনা কমানোর সর্বতো চেষ্টা করবে তা একপ্রকার নিশ্চিত। কিছুদিন আগে পাকিস্তান ইরান মালোয়াশিয়া তুরস্ক এবং ইন্দোনেশিয়ার মধ্যে তৈরি ইসলামিক বিশ্বের একটা জোট সৌদি আরবের বিরোধিতার জন্য দুর্বল হয়ে গিয়েছিল যা আবার নতুন উদ্যমে এগিয়ে যেতে পারবে সৌদি ও তাদের মিত্র আরব দেশগুলো এই বিষয়ে একমত হয়ে জোটে যোগ দিলে। ৫৭ সদস্যের ওআইসি এবং জেনারেল রাহিল শরিফ এর নেতৃত্বে ৩৪ সদস্যের মুসলিম বিশ্বের সামরিক জোট এখন আরো বিস্তৃত হতে পারবে এবং মুসলিম বিশ্বে ফলপ্রসূ ভূমিকা পালন করতে পারে। ইরান সৌদি বৈরিতা শেষ হলে মধ্য প্রাচ্যে অস্থিরতা অনেকটাই হ্রাস পাবে বলে মনে করছেন অনেক মধ্যপ্রাচ্য গবেষক। সৌদি আরব বিষয়টিকে কেমন ভাবে নেয় এবং আমেরিকা এই সমগ্র প্রেক্ষাপটে কোন ভূমিকা গ্রহণ করে তার ওপর নির্ভর করবে অনেক কিছু। কিন্তু আপাতত অস্ত্রের ঝনঝনানি তে অভ্যস্ত মধ্য প্রাচ্য শান্তির পথ একটা যে পেতে পারে তা বলাইবাহুল্য, অবশ্য সামনে পিছনে অনেক ‘যদি’, ‘তবে’ রাখতে হবে এখনও।

Back To Top