শেষের পথে আমেরিকার দাদাগিরি !! উদীয়মান নয়া পরাশক্তি চীন, বলছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন

নব্বই এর দশকে সোভিয়েত রাশিয়ার বিভাজনের পর বিশ্বের একক পরাশক্তি হিসেবে নেতৃত্বের অঘোষিত দায়িত্ব গর্বের সঙ্গে স্বেচ্ছায় পালন করে আসছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু গত কয়েক বছরে বিভিন্ন সমস্যার ক্ষেত্রে আমেরিকাকে সেভাবে নেতৃত্ব দিতে দেখা যায়নি, তাহলে কি শেষ হতে যাচ্ছে আমেরিকার কয়েক দশকব্যাপী দাদাগিরি? লিখছেন সাইফুল্লা লস্কর।

যেকোনো দেশের মূল শক্তি এবং বহির্বিশ্বে তার প্রভাব মূলত তিনটি কারণের ওপর নির্ভর করে গড়ে ওঠে। অর্থনৈতিক শক্তি, সামরিক শক্তি এবং সাংস্কৃতিক প্রভাব। কেউ কেউ এক্ষেত্রে আরো কিছু বিষয়কে অন্তর্ভুক্ত করেন যেমন স্বাস্থ্য এবং পরিবেশগত দিক। তবে আমেরিকার মূল চালিকা শক্তি যা এতদিন তাকে এই বিশ্বের বেতাজ বাদশাহ হিসেবে সবার ওপরে স্থান দান করে ছিল তা হলো ওপরে উল্লেখিত তিনটি বিষয়। আমেরিকার এই তিন বিষয়ে বিশ্বের অন্য সব দেশের থেকে বহু যোজন এগিয়ে ছিল আমেরিকা তাই সোভিয়েত রাশিয়ার পতনের পর কেউ আমেরিকার দাদাগিরিকে চ্যালেঞ্জ করার সাহস দেখায়নি। নিজের ইচ্ছায় যেখানে খুশি আধিপত্য দেখিয়েছে, যাকে ইচ্ছা প্রতিষ্ঠিত করেছে, যে তার শক্তির কাছে মাথানত করেনি তার ধ্বংসের কারণ হয়েছে। লাখো নিরীহ মানুষের রক্তে রঞ্জিত এই সুপার পাওয়ারের হাত, তবে অতীতের অন্য সব পরাশক্তির মতো আমেরিকারও বাহাদুরি যে শেষ হবে সে বিষয়ে কারো কোনো সন্দেহ নেই তবে তা এত তাড়াতাড়ি যে হবে তা হয়তো মস্ত বড় আমেরিকা বিদ্ধেষীও আশা করেননি। এক জরিপ থেকে জানা যায়, বিশ্ব ব্যাপী আমিরিকার নেতৃত্বকে মঞ্জুরি দেয়া মানুষের সংখ্যা ২০১৬ তে ৪৮% থেকে কমে  , চীনের নিচে ৩০% এ পৌঁছেছে ২০১৮ তে।

নিজেদের ডলারের সাহায্যে বিশ্ব অর্থব্যবস্থাকে এতদিন নিয়ন্ত্রণ করে আসা অর্থনৈতিক মহাশক্তি আমেরিকার অর্থনৈতিক অবনয়েনের চিত্র পরিষ্কার করার জন্য একটা তথ্য দেয়া যেতে পারে। ১৯৭০ সালে যেখানে বিশ্বের মোট উৎপাদনের ২৫% এর বেশি আমেরিকার দখলে ছিল তা ২০১১ তে গিয়ে দাড়িয়েছে ১৯.১% এ। আমেরিকার উৎপাদন শিল্প ক্রমশ তার সুখের সময় পার করে দুঃসময়ের দিকে ধাবিত হচ্ছে। বাড়ছে শ্রমিক অসন্তোষ। যুক্তরাষ্ট্রে ১৯৬৫ সালে তাদের কোম্পানির সিইও এবং গড় শ্রমিকদের বেতনের অনুপাত ছিল যেখানে ২৪:১ যা ২০০৫ সালে গিয়ে থেমেছে ২৬২:১ এ। আমেরিকায় ধনী এবং নিম্নবিত্ত মানুষের মধ্যে সামাজিক ও অর্থনৈতিক ব্যাবধান বাড়ছে। বেকারত্বের সমস্যা বাড়ছে হুহু করে। মূল কারণ উৎপাদন শিল্পে পর্যাপ্ত পরিমাণ বিনিয়োগের অভাব। রিচার্ড ল্যাচ্মান মনে করেন, আমেরিকার অতিরিক্ত সামরিক ব্যয়ের চাপে মূল অগ্রাধিকার ক্ষেত্র যেমন বিনিয়োগ, স্বাস্থ্য ইত্যাদিতে বরাদ্দ কমেছে যা আমেরিকার অবনয়ের কারণ হতে পারে। পিউ রিসার্চ ইনস্টিটিউট এর চালনা করা এক জরিপে দেখা গিয়েছে, বেশিরভাগ মার্কিনী মনে করেন ২০৫০ সালের মধ্যে আমেরিকার অর্থনীতি অনেক দূর্বল হয়ে যাবে।

আমেরিকার অর্থনৈতিক অবক্ষয়ের পিছনে বেশিরভাগ বিশেষজ্ঞ তাদের যুদ্ধমূখি নীতিকে দায়ী করেছে যা তাদের তাদের দেশীও অর্থনীতিকে পঙ্গু করে দিয়েছে এবং অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করেছে অগ্রাধিকার ক্ষেত্র নির্ধারণের ক্ষেত্রে। ২০১১ সালে আমেরিকার মোট সামরিক খাতে খরচ বাকি বিশ্বের অন্যান্য সব দেশের মোট সামরিক বায়ের প্রায় সমান হয়ে গিয়েছিল। আফগানিস্তান এবং ইরাক যুদ্ধে আমেরিকার মোট ব্যয় হয়েছে ৪.৪ ট্রিলিয়ন ডলার, বিশেষজ্ঞদের মতে এটাই ওসামা বিন লাদেনের সাফল্য যে তিনি আমেরিকার অর্থ ব্যাবস্থাকে পঙ্গু করে দিতে বড়ো ভূমিকা পালন করেছিলেন।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী সংবাদ পত্রিকা দ্যা গার্ডিয়ান জানাচ্ছে, জার্মানিতে ইউরোপের বিভিন্ন দেশের বিদেশ মন্ত্রীদের এক সম্মেলনে ইউরোপীয় ইউনিয়নের বিদেশমন্ত্রী জোসেফ বোরিয়েল বলেন,  “চীন আন্তর্জাতিক শক্তিরূপে আমেরিকার স্থান নিচ্ছে, বিশেষজ্ঞরা যে এশিয়ার শতাব্দীর কথা অনুমান করছিল কোভিড -১৯ এর সময় তার সূচনা হয়ে গিয়েছে। চীনের ব্যাপারে ইউরোপীয় ইউনিয়নকে এখন এক মজবুত নীতি গ্রহণ করতে হবে, কয়েক দশক পর আমেরিকাকে আজ বিশ্বকে নেতৃত্ব দিতে দেখা যাচ্ছেনা। আমাদের ওপর কোনো এক পক্ষকে নির্বাচন করার জন্য চাপ বৃদ্ধি পাচ্ছে, ইউরোপীয় ইউনিয়নকে নিজের স্বার্থ সামনে রাখতে হবে এবং করো তাবেদার হওয়া থেকে বাঁচতে হবে।” আমেরিকার প্রেমে হোক বা ভীতিতে হোক এত দিন কানাডা, জাপান আর অস্ট্রেলিয়ার পর ইউরোপের দেশ গুলোই যুক্তরাষ্ট্রের সব থেকে বড়ো সঙ্গী ছিল কিন্তু তাদের গলার এই সুর নিঃসন্দেহে আমেরিকার চিন্তার কারণ হবে।

জোসেফ বোরিয়েলের বক্তব্যের যৌক্তিকতা যাচাই করা খুব কঠিন নয়। বিশাল বৈদেশিক ঋণে ডুবে থাকা, ক্রমশ চওড়া হওয়া বানিজ্য ঘাটতির ভরে এবং করোনার ভয়াবহ প্রভাবে বেসামাল আমেরিকার স্থান ধীরে ধীরে ছিনিয়ে নিচ্ছে উদিয়মান অর্থনৈতিক পরাশক্তি এবং সামরিক শক্তি চিন। আমেরিকা চীনের সঙ্গে সব ধরনের সম্পর্ক ছেদ করে তার সঙ্গীদের ও তাই করতে বলবে এটাই স্বাভাবিক তবে ক্রমশ পরিবর্তনশীল বিশ্বে আমেরিকা কতটা সফল হবে তা খুব বড়ো প্রশ্নের বিষয়। আমেরিকা করোনার দায় চীনের ঘাড়ে চাপিয়ে দেয় এবং হু’কে চীনেকে সমর্থন করার অভিযোগে হু থেকে সমর্থন প্রত্যাহার করে নেয় ডোনাল্ড ট্রাম্প। ওপর দিকে করোণাকে সম্পূর্ণ রূপে কাবু করা করোনার উৎসস্থল চিন এই দায় উল্টে আমেরিকার ঘাড়ে চাপাচ্ছে। আমেরিকার এই দুঃসময়ে চীন ধীরে ধীরে নিজের বন্ধুর সংখ্যা তার অর্থনৈতিক প্রভাবের সাহায্যে বাড়িয়ে চলেছে। দক্ষিণ আমেরিকা,  আফ্রিকা এবং এশিয়ার বিভিন্ন অংশে চীনের প্রভাব ক্রমশ বাড়ছে। চিন নিজের প্রতিবেশী এবং যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র ভারতেকে এই অঞ্চলে মূল শক্তি যে চিন বোঝানোর জন্য নিজের শক্তি প্রদর্শন করে চলেছে। অন্য দিকে চিন সাগরে নিজদের আগ্রাসনবাদী স্বার্থ, আমেরিকা এবং সব পশ্চিমা দেশের বিরোধিতা সত্বেও সুরক্ষিত এবং নিজেদের প্রভাব প্রতিষ্ঠিত করতে সব ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে তারা। চিন এখন শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ, জিবুতি, পাকিস্তান, মায়ানমার সহ বিভিন্ন দেশে নিজেদের সামরিক প্রভাব সৃষ্টি করেছে এবং প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলেও আমেরিকার শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠেছে।

বর্তমানে চীন, রাশিয়া, পাকিস্তান, ইরান, উত্তর কোরিয়া যে একটা নতুন শক্তি জোট তৈরি হয়েছে তাতে চিন যে নিজের অর্থনৈতিক এবং সামরিক প্রভাবের জেরে নেতৃত্বের ভূমিকা পালন করবে তা সহজেই আন্দাজ করা যায়। তাই বিশ্বের ক্ষমতার বিন্যাস যে নব সমীকরণ লাভ করছে ধীরে ধীরে তা আজ কোনো অলীক কল্পনা নয়। ধীরে ধীরে যুক্তরাষ্ট্রের ঘাড়ে নিঃশ্বাস ফেলা চিনা ড্রাগন যে নব পরাশক্তি হিসেবে করোনা পরবর্তী বিশ্বের নেতৃত্বের আসনের দাবিদার হবে সেটা সহজেই অনুমেয়। আমেরিকা চীনের এই উদয় রুখতে এখন কি করে সেটাই দেখার অপেক্ষায় গোটা বিশ্ব।

Back To Top