রাজ্জাক বিন ইউসুফের ভারত ভ্রমণ এবং কিছু কথা

~আয়াতুল্লা খোমেনী

ফেসবুকে কয়েকটি পোস্ট দেখলাম, বাংলাদেশের একজন ধর্মপ্রচারক আব্দুর রাজ্জাক বিন ইউসুফ কে এপার বাংলায় ধর্মীয় সভায় আমন্ত্রণ জানানো নিয়ে বিতর্ক। কেউ তাঁকে চরমপন্থী বলে গালি, কটূক্তি করে বোঝাতে চাইছেন; তিনি আসলে এদেশের সম্প্রীতির আবহটা বিষাক্ত হবে। আবার কেউ তাঁর আগমনকে সমর্থন করছেন।

প্রথমত: আমার বলার বিষয় হলো, রাজ্জাক সাহেব একজন আলেম, তিনি হাদীসের ভালো অনুবাদক, তবে কোরাণের ব‍্যাখ‍্যা বিশ্লেষণে কতটা দক্ষ তা আমি তার আলোচনা থেকে অন্ততঃ শুনিনি। কথা হলো হাদীসে তিনি প্রজ্ঞাবান। তবে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গিতে একটা চরমপন্থী মানসিকতা কাজ করে। শুধু তিনিই নন আমাদের অনেক আলেমগণই ধর্মকে একটা সংকীর্ণ ‘কেতাবী বুলি’-হিসাবে বিবেচনা করে ব‍্যাখ‍্যায় সংকীর্ণতা নিয়ে আসেন। তাঁরা কোরান হাদীসের বিশ্লেষণ কে বাস্তবোচিত করে দূরদর্শিতার সাথে জ্ঞানের সমন্বয় সাধন করতে পারেন না।

ইউসুফ সাহেব কি নিজে হাদীস রচনা করে বলেন?
আর পাঁচজন আলেম যা বলেন তিনিও তাই বলেন,তবে তাঁর বলার পার্থক্য হলো, তিনি কর্কশ ভাষায়, কঠোর ভাবে, বেশ আত্মম্ভরিতার সাথে বক্তব্য উপস্থাপন করে থাকেন। কিন্তু ইসলামের আদর্শই হচ্ছে কঠিন বিষয়কে খুব সুন্দর, সহজতর করে বিনয়ের সাথে বলা। আমাদের মডেল নবী(সঃ) এঁর নসীহত ছিলো-কোমলতার সাথে, বিনয়ের সাথে। তিনি যদি কঠোরতা অবলম্বন করতেন তাহলে পথভ্রষ্ট মানুষগুলো তাঁর থেকে মুখ ফিরিয়েই থাকতো। ইসলামের বিধি বিধানকে বেশ প্রজ্ঞার সহিত কৌশলে দূরদর্শিতার দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে উপস্থাপন করতে হবে। আমাদের আলেমগণ যেখানে সেখানে ‘ফতোয়া’ মেরে দেন,কিন্তু বাস্তব প্রেক্ষাপটের প্রতি ভ্রুক্ষেপও করেন না। নবী সঃ শুধুমাত্র নির্দেশ দিতেন না, তার যথাসম্ভব সমাধানের পথও বাতলে দিতেন। একজন ভিখারিকে ভিক্ষাবৃত্তির পরিবর্তে স্বাবলম্বীর পথ নির্দেশ করে সমাধানের জন্য হাতে কুঠার তুলে দিয়েছিলেন।

দ্বিতীয়ত: ধর্মীয় সভা করতেই হয় ,তাহলে এদেশীয় অনেক প্রজ্ঞাবান আলেম রয়েছেন, তাঁদের দিয়ে করুন। বাংলাদেশ থেকে হায়ার করে আলেম নিয়ে আসতে হবে কেন? আমাদের দেশের মুসলিম সমাজ যেখানে হাজারো জরায় জীর্ণ, হাজারো ব‍্যাধিগ্রস্ত সেখানে তাঁকে এনে কি নতুন কোনো পথনির্দেশ জাতি উপহার পাবে? নাকি খাস্তা গরম গরম কিছু নসীহত শোনায় সার?

যুব সমাজ যেখানে বেকারত্বের পরাকাষ্ঠায় বলি, দিশেহারা, সেখানে কর্মসংস্থানের দিশা না দেখিয়ে ‘বিবাহ অর্ধেক দ্বীন’-এই ফতোয়া ঠুকে দিই তাহলে কতোটা ফলপ্রসু হবে? ‘জীবন দিয়েছেন যিনি আহার দেবেন তিনি’-কথা সত্য, তবে খাদ্যের সুষম বন্টনের অভাবে বিশ্বে কোটি কোটি মানুষ অভূক্ত থাকে।

সমাজে নানান অশ্লীলতা, পাপকার্য হু হু করে অগ্রসরমান। তার জন্য বাস্তব সম্মত কর্মসূচি, সমাধান, অন‍্যায়কে রোখার প্রচেষ্টার প্রয়োজন! নাকি মঞ্চ বেঁধে জাহান্নামের ভয় দেখিয়েই সমাজ থেকে পাপ স্থলনের দিবাস্বপ্ন দেখা?

যেখানে স্বাধীনতার ৭২ বছর পরেও জাতি পরের গোলামি করে ক্লান্ত-একটি নিজস্ব রাজনৈতিক প্ল‍্যাটফর্ম করতে পারলোনা, সেখানে ধর্মীয় সভার মঞ্চ থেকে –‘রাজনীতি করা হারাম’-এই ফতোয়াই ছোঁড়া হবে তাই না?

একজন যুবতী আজন্ম বেপর্দায় বড়ো হয়েছে, ইসলামিক পরিবেশ পায়নি–তাকে ‘মা’ ‘ বোন’ বলে বিনয়ের সাথে মাথায় ওড়না, বা হিজাব দেওয়ার কথা বলবেন! নাকি কর্কশভাবে তার চৌদ্দগুষ্টিকে গালি দিয়ে তাকে কূলটা, অশালীন বলে ভালোর পথে আহ্বান করবেন? কোনটা?

একজন দিন মজুর যার ৬-৭টি সন্তান, সংসার চালাতে নাভিশ্বাস ওঠে। তাকে কোরাণের উদ্ধৃতি দিয়ে শোনাবেন —‘জন্মনিয়ন্ত্রন হারাম’ ?

সমাজে এমন বিধবা নারী আছেন যারা বিড়ি বেঁধে সন্তানদের মুখে দু -বেলা দু-মুঠো লবন ভাত তুলে দেন। তাদের ক্ষেত্রে ফতোয়া কি হবে? বিড়ি বাঁধা হারাম? তাদের জন্য একটি বারও কি খোঁজ নিয়েছেন তাদের ‘পেট’ নামক অপদার্থটি কেমন করে চলবে? তার কোনো বিকল্প পথের কথা ভেবেছেন?–
এমন হাজারো প্রশ্ন-সমস্যা রয়েছে।

তৃতীয়ত:-আপনি আমি ইসলাম কে নিয়ে গেল গেল রব তুলি। কিন্তু আমি আপনি কতোটা ইসলামের নির্দেশ মানি?
আপনি যদি একজন ভালো মুসলিম হতে চান তাহলে আপনার হাতের কাছেই তো উপাদান রয়েছে। আপনার ঘরেই গ্রন্থাদি রয়েছে সেগুলো মানুন! প্রতি সপ্তাহেই ‘জুমআর খুতবা’-শুনেন, তা থেকেই তো আপনার জীবন বদলে ফেলতে পারেন মহাশয়! আবার হায়ার করে বিদেশ থেকে বক্তা আনা জরুরী কেন? নাকি ধর্মীয় রমরমা? আনুষ্ঠানিকতা? ধর্মীয় সুড়সুড়ি? সমাজে বিভ্রান্তি সৃষ্টি? আছে আর নেই এর দ্বন্দ্ব তৈরি করা?

বক্তা সাহেব আসবেন, খাবেন, মোটা অঙ্কের পয়সা নিয়ে চলে যাবেন। আপনার সমাজ পরিবর্তনের ভার তিনি নেবেন? ২ ঘন্টার বক্তব্যে যদি আহামরি কিছু হয়ে যেত , তাহলে এযাবতকাল মুছুলমান ‘ন‍্যাংটা’- থাকতো না।

অতএব হায়ার করে বক্তা এনে মঞ্চ বেঁধে কিছু কাঁচা পাকা কথা, শুনাম দূর্নাম শুনে বাহবা দিয়ে জাতির কিঞ্চিত পরিবর্তন হয়নি, হবেওনা। শোনার পরিমাণ কমান, মানার পরিমাণ বাড়ান, বাস্তবের সমস্যার সমাধানের পথ অনুসন্ধান করুন, অন্ধভক্তি ছুঁড়ে ফেলুন তবেই কিছুটা হলেও সফলতা আসবে।

আবার কিছু ব‍্যক্তি ধর্মীয় সিস্টেম কে কটাক্ষ করেই সার! নিজের গায়ে ‘বুদ্ধিজীবীর পোষাক’ চাপিয়ে মুসলিম সমাজের পশ্চাদপদতার চুলচেরা বিশ্লেষণ করেন, কিন্তু এক ওয়াক্ত নামাজের জন্য তিনি ‘মসজিদের পথ মাড়ান না’। এখন ইসলাম ব‍্যবহারিক জীবনে এমনটাই হয়ে গেছে — যারা বোঝেন তাদের দেখা মসজিদে মেলে না, আর যারা অজ্ঞ তারাই মসজিদে গিয়ে মোড়লি পনা করে।

তাই কাদা ছোঁড়াছুড়ি করে নয়, ভাবনা ও কার্যপদ্ধতির সমন্বয় দরকার।

(মতামত লেখকের নিজস্ব)

(লেখক একজন  যুব শিক্ষাসেবী এবং সামাজিক কর্মী। লেখার বিষয়ে যেকোন মতামত দেওয়ার জন্য লেখকের সাথে যোগাযোগ করুন ফেসবুকে এখানে ক্লিক করে। )

Back To Top