খিলঞ্জিয়া

কাজী আমিনুল ইসলাম..

অমর ঊনিশে মে -ভাষা শহীদ দিবস। বাংলা ভাষার অন্যতম অধিকার। দিনটি যেন ঢাকা পড়ে যাচ্ছে। ঘটনা-অসমের বাঙালির মাতৃভাষার অধিকার রক্ষা।

উত্তর-পূর্ব রাজ্য গুলি প্রান্ত দেশীয়। রাজ্যগুলি পূর্ব বাংলার সঙ্গে ওতপ্রোত জড়িত ছিল। দেশভাগের পর যোগাযোগ অবস্থা জটিল হয়ে পড়েছে। সামাজিক অবস্থাও জটিল। অসম সরকার বিধানসভায় ২৪ অক্টোবর  ১৯৬০ খ্রিঃ বিল এনে একমাত্র অসমীয়া ভাষাকেই সরকারী ভাষা করেছিল।

অসমে চিরদিনই বাঙালির সংখ্যা বড় আকারের। তাছাড়া বাংলার অনেক অংশ নিয়ে অসম রাজ্য হয়েছিল। বাংলাকে সহকারি ভাষা করার দাবী চলছিল। দাবী না মানাই আন্দোলন তীব্র আকার নেয়। ধর্মঘট চলছিল। ১৯৬১-র মে শিলচর রেল স্টেশনে রেল অবরোধে গুলি চালালে ১৫০ জন আহত, ১১ জন শহীদ হন। পরে বরাক উপত্যকার বাংলা সহকারি ভাষা হয়েছে। ভাষা শহীদকে সামনে রেখে বাংলা ভাষা সংস্কতির উন্নয়নের গতি বাড়ানোর প্রয়াস রয়েছে।

ভাষা শহীদ তো বটে, পাশের রাজ্য অসম ভ্রমণের আগ্রহ দীর্ঘদিনের। কিন্তু ধর্মীও হামলা, বাংলা খেদা ঘটনা আগ্রহকে দমন করেছে।

পিইএন-এর দল কাঞ্চনজঙ্ঘা ট্রেনে ভাষা দিবস ২০১৮-য় অনুষ্ঠানে শিলচর যাচ্ছে। আমরা দুজন তাঁদের সঙ্গে অংশ নিতে পথে ট্রেনে চড়লাম। আমাদের পাশের আসনগুলিও শিলচর যাত্রীর। তারা চারটি সংরক্ষিত আসনে আটজন। সিলচরের কাটা কাপড়ের ব্যাবসায়ী। ফাকা আসন ছিল, আমাদের প্রতি যেন রুষ্ট। তাঁদের জোর তর্কের রেশ তখন রয়েছে। বিভেদ সমীকরণ আত্মরক্ষা বনাম সমন্বয় আত্মরক্ষা। বেশ অস্বস্তিকর। তার পরেও খবরের কাগজ, লোকের কথা, শুনতে হয়েছে এনআরসি নিয়েই। বয়স্ক লোকটি অস্বস্তি কাটাতে বলল, নাগরিকপঞ্জি, এনরসি নিয়ে আমরা খুব বিব্রত। যারা বাংলাদেশ থেকে এসেছে তারা সঙ্কটে পড়েছে। পশ্চিমবঙ্গেও নাগরিকপঞ্জি করছে না। একটা লিস্ট বের হয়েছে। তবে অসমে বাঙালীদের মধ্যে বিভেদের রাজনীতি চালাচ্ছে। সেভাবে ক্ষমতায়ও এসেছে। টোটাল বাঙালি অসমে সংখ্যাগরিষ্ঠ। মুসলিমদের বলছে অনুপ্রবেশকারী ২০১১-র জনগণনায় অসমে তিন কোটি এগারো লাখের মধ্যে এক কোটি সাত লাখ (৩৪.২২ শতাংশ) মুসলমান। বিভেদ এনে বাঙালির সর্বনাশ করছে।

তর্কের দ্বিতীয় জন ফোঁস করে উঠল, আমরা বিজেপি করছি, পশ্চিমবঙ্গ, অসম, বাংলাদেশকে এক করে দিতে চাইনা বলে। আপনিতো কংগ্রেস, সন্তোষমোহন দেবের শ্রাদ্ধে মহাভোজ হল, আপনাকে নিমন্ত্রণ করেনি। আপনি ভিতরে কমিউনিস্ট। বাঙালি হিন্দু অবশ্যই নাগরিক হবে। হিন্দুই তাদের পরিচয়। প্রথম জনের ক্ষোভ এই সমীকরণে মুসলিম বাঙালি সংগঠন ধর্মকে ঢাল করে চুপটি হয়ে আছে। জমিয়তের মওলানা বলেছেন কারো গায়ে হাত পড়লে কোর্টে যাবেন। অসমি জাতীয়তাবাদী হামলা করেছে। ভারসাম্য রক্ষার নামে বাঙালির উপর বেশি হামলা হয়েছে। রাজীব গান্ধির আমলে অসম সরকারের সঙ্গে কেন্দ্র চুক্তিকরে ১৯৭১ সালের পরে অসমে যারা এসেছে তারাই বহিরাগত। আগেরদেরকে বাছাই করে নাগরিকত্ব দেওয়া হবে।

তখন থেকে বিজেপি হিন্দুকে শরণার্থী আখ্যা দিয়ে সমীকরণের ডাক দেয়। নরেন্দ্র মোদী প্রধানমন্ত্রী হলে, ২০১৫-র ৭ সেপ্টেম্বর কেন্দ্র গেজেট প্রকাশ করে – বাংলাদেশ, পাকিস্থান, আফগানিস্থান থেকে আসা হিন্দু, বদ্ধ, শিখ, জৈন শরণার্থী।

প্রথম জনের প্রশ্ন, লোকসভায় বিল এনেছিল, এখন রাজ্যসভাতেও সংখ্যাগরিষ্ঠ বিজেপি। আইন করে সমাধান নয়, ভয় ভীতির মধ্যে রাখা! ভোট দিয়েছি ২০১৪, ২০১৬ তে, আধার কার্ড আছে। আমরা সবাই নাগরিক – সে আইন চাই। তখন বাঁধা দেওয়া হয়নি। এর সঠিক সমাধান চাই। হিন্দু বনাম মুসলিম নয়, বাঙালির উন্নতি চাই।

পূর্ব অঞ্চলে সাতটি রাজ্য। আসাম নামে সাধারণ ভাবে পরিচিত ছিল হিমালয়ের পাদদেশের অসমতল অঞ্চল। ভেতরে বহু পাহাড় পর্বত, বহু নদী, বন জঙ্গল। মঙ্গোল জাতির শাখা জনজাতি তিব্বত টপকে ভূটান বর্মা হয়ে অসমতল-আসামে বসত করছে। অস্ট্রিক, নিগ্রোবটু, শক, হুন মিশ্রণ কম হয়েছে। চেহেরা, বর্ণ, আকৃতিতে কিরাত জাতির ছাপ বংশ পরম্পরায় চলছে। আচার আচারনে বহু বহু শাখা হয়েছে। উত্তর পূর্ব অঞ্চলে কিরাত গোষ্ঠীর বহু বহু জাতির বাস। অহোম জাতি তার মধ্যে অন্যতম, সংঘবদ্ধ ও শক্তিশালী। ১২২৮ সালের দিকে তাদের আগমন হয়। করচারি, চুতিয়া, মোরান প্রমুখ জাতিকে পরাজিত করে পর্বতের নিম্নভূমি অঞ্চলে ১২৯৭ সালে রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে। গৌহাটিকে কেন্দ্র করে কামরূপ রাজ্য তখন প্রতিষ্ঠিত হয়। ব্রাহ্মণ এনে তারা উপনিবেশও দেয়। ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় মিশ্র অহোম সংস্কৃতি গড়ে ওঠে।

তুর্কি, মোঘল অসমকে কব্জা করতে পারেনি। সে রকম সম্পদ না থাকায় এড়িয়েও গেছে। ইংরেজও অসমকে ঘাটায়নি। বর্মীরা অসমকে প্রায়ই আক্রমণ করত। ১৮২১ সালে বর্মীরা অসম দখল করে নিলে আর উদ্ধার করতে পারেনি। অসমের রাজা স্বর্গদেব চন্দ্রকান্ত সিংহ ইংরেজের সাহায্য প্রার্থনা করেন। বর্মীদের তাড়িয়ে ইংরেজ ১৮২৫ সালে অসম দখল নেয়। বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির অংশ করে কলকাতা থেকে অসম কে শাসন করেছে ১৮৭২-১৮৭৩ অবধি। ১৮৭৪ সালে চিফ কমিশনার শাসিত অসম রাজ্য হয়। কাছাড় (১৮৩২ খ্রিঃ), খাসি জয়ন্তী (১৮৩৫ খ্রিঃ) ইত্যাদি রাজ দখল করে ইংরেজ অসমের মধ্যে ঢুকিয়ে নেয়। লাভ জনক রাজস্বের দিকে নজর দেয়। চা বাগান, ধান খেত, বন গড়ে তোলে। তেল, কয়লা, লাহা, চুনাপাথর খনিজ দ্রব্যের উপর নজর দেয়। অসমকে উন্নত করতে আধুনিক শিক্ষার বাবস্থা করা হয়। শিক্ষক, আমলা যায় কলকাতা থেকে। বাংলা শিক্ষিত পাদ্রীও ১৮৪০ থেকে দলে দলে অসমে গিয়ে পাহাড় অঞ্চলে বাইবেল স্কুল খুলতে থাকে। স্থানীয় ভাষাকে লিখিত আকারে নিয়ে আসে। অক্ষর হয় বাংলা।

বাংলা রাজ্যকে ছোট করতে ১৮৭৪ সালে শ্রীহট্ট, কাছাড়, গোয়ালপাড়া অসমে যায়। বিশ্বযুদ্ধের পরে রাজ্য সীমানা সংস্কার হলে ১৯১৯ সালে অসম প্রদেশ হয়। অসমীয়াদের ক্রমশ্য জাত্যাভিমান জাগে। বাংলা ভাষা ও বাঙালি বিরোধিতা দেখা দেয়। পাদ্রীরা বাংলার বদলে রোমান ইংরেজি হরফ পাহাড়ি জাতির মধ্যে চালানোর চেষ্টা করে। তবে ইংরেজির ২৬ অক্ষরের বদলে কম অক্ষরে স্থানীয় ভাষা রপ্ত করায়। অহোম জাতি বাংলাকে সংস্কার করে তৎসম নির্ভর অসমি ভাষা বলবত করে। তাতে বাঙালি বুদ্ধিজীবীর অবদান রয়েছে।

ব্যবসা, খাদ্যে চিরদিন অসম ছিল বাংলা নির্ভর। ইংরেজ আমলে আধুনিক প্রবাহে আনা হয় তা বাংলা থেকে ও বাঙালীদের দিয়েই। কোচবিহার, ত্রিপুরার মতো কাছাড়ও বাংলা সংস্কৃতির উপজাতি রাজা ছিলেন। শিলচর থেকে ২৫ কিমি দূরে ঘাসপুর ছিল কাছার রাজধানী। রাজবাড়ি ধ্বংশ হয়ে গেছে তবে রাজার নির্মিত মন্দির রয়েছে। এক শ্রেণীর বাঙ্গালিকে ইংরেজ উন্নত করেছিল। তাদের দ্বারা সমাজকে সিক্ত করতে চেয়েছিল। দাবী নিয়ে আন্দোলন খুসি হলে তাদের জব্দ করতে বঙ্গভঙ্গ করেছে। অসম পূর্ববঙ্গ নিয়ে পূর্ববঙ্গ রাজ্য হয়।

বরাক উপত্যকা বাঙালি অধ্যুষিত। বঙ্গভঙ্গের কারণ দেখানো হয়েছিল পূর্ববঙ্গ মুসলমানদের উন্নয়ন। ১৯০৬ – ১১ বঙ্গভঙ্গ ছিল। বঙ্গভঙ্গর প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছিল কয়েক বছর আগে থেকে। ইংরেজ শাসনের শেষের দিকে নিম্নবর্গ ব্যাপক সংখ্যায় মুসলমান হয়েছিল। নব মুসলমানদের উন্নয়নও প্রয়োজন ছিল। তারা কৃষক, কৃষি মজুর হয়ে অসমের দিকে গিয়েছিল। ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ রদ হয়। সে বছর রাজধানী কলকাতা থেকে দিল্লি যায়।

প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন নির্বাচন ১৯৩৫ সালে হয়। কংগ্রেস ও মুসলিম লিগে আলাদা ধৈর্যের প্রভাব ছিল। কংগ্রেসের বৃহৎ দল হলেও সংখ্যা গরিষ্ঠ না হওয়ায় সরকার গঠন করেনি। লিগ নেতা মহঃ শহিদুল্লাহ ১৯৩৭ সালে সরকার গঠন করে। পরের নির্বাচনেও একই অবস্থা হয়। মহঃ শহিদুল্লাহ ১৯৩৭-১৯৪৭ সাল অবধি প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন।

দেশ স্বাধীনের সময় ভারত পাকিস্থান দুটি দেশ হয়। বাংলা অসম নিয়ে তৃতীয় দেশের প্রস্তাবও উঠেছিল। অসমের কংগ্রেসের আপত্তিতে তৃতীয় প্রস্তাব মানা হয়নি। তবে পাকিস্থান থেকে বাংলা দেশ হয়েছে। জাতি সত্তাই মানব সংস্কৃতির প্রধান আধার।

দেশভাগে ভারত পাকিস্থানে যাওয়া নিয়ে গণভোট হয় শ্রীহট্টে। করিমগঞ্জে পাকিস্থান, মৌলোভীবাজার মহকুমায় ভারতের পক্ষে বেশি ভোট পড়ে। তবে ভৌগলিক কারণে করিমগঞ্জ ভারতে। মৌলোভী বাজার পাকিস্থানে যায়। দেশ ভাগ হলে উভয় দিকেই ধর্মীয় সংখ্যালঘুর ওপর ভীষণ আক্রমণ হয়। উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত আগেই সুবিধামতো আশ্রয় নেয়। বেশি বিপদে পড়ে গরিব গুর্বোরা, পূর্ব পাকিস্থান থেকে বেশি এসছে। আসতে হিন্দু মহাসভার মতো সংগঠন স্বাগত জানায়। বাংলাদেশ হবার যুদ্ধের সময় বহু বাঙালি আসে, হিন্দুর অধিকাংশ ফিরে যায়নি।

অসমি  জাতীয়তাবাদী সংগঠন (প্রায় ত্রিশটি) অসম সংখ্যালঘু হয়ে যাচ্ছে বলে ক্রমশ্য আন্দোলনে নেমে পড়ে। পূর্ব ও উত্তর অঞ্চলের লোক বহিরাগত। তাদের উপর আক্রমণও হতে থাকে। জঙ্গি ও বিচ্ছিন্নবাদ আন্দোলনও দেখা দেয়। অসমকে শান্ত করতে প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধীর চুক্তি হয় খিলঞ্জিয় অসমের ভূমিপুত্রর অধিকার রক্ষার।  তখন থেকে বাঙালীর ওপর বেশি কোপ আসে। বিজেপি হিন্দু বাঙালী শরণার্থী বলে সমীকরণে নেমে পড়ে। ধারনাও তৈরি করে মুসলমান মাত্রই অনুপ্রবেশকারি। তবে রিকশাচালক, চাকর ঝির কাজে অতি গরীব কিছু আসেনি তা নয়। তাদের দেখিয়ে বাঙালীর অধিকারকে বিজেপি ভাগ করছে। তাদেরকে অসমী হতেও উৎসাহ দিচ্ছে। মুসলমানরা অনেকে অসমি ভাষা রপ্ত করছে। অবশ্য পূর্বপুরুষের ভিটামাটি, সরকারি চাকরি, কুলি কামিন নথীতে পূর্বপুরুষের নামে দেখিয়ে নাগরিক পঞ্জিতে নাম তুলতে পারছে। তাতেও বিজেপি’র বাগড়ার চেষ্টা রয়েছে।

জোটসঙ্গী অ গ প অসম জাতীয়তাবাদী প্রধান মুখপত্র। অ গ প-র প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী প্রফুল্ল মহন্ত, প্রাক্তন সাংসদ কুমার দিপক দাস নাগরিক সংশোধিত বিল আনার তীব্র বিরোধী। অ গ প-র নেতা তথা মন্ত্রী অতুল বেরা, কেশব মহন্ত, ফণীভূষণ চৌধুরী মাঝে মাঝে হুঙ্কারও দিচ্ছেন। বিজেপি নেতা মুখ্যমন্ত্রী সর্বানন্দ সোনয়াল চুপটি করে দেখে জাচ্ছেন। শিলচরের বিজেপি বিধায়ক কিশোর নাথকে বিদেশী নোটিশ ইস্যু করা হয়েছে। বিধায়ক দীলিপ কুমার পাল উপাধ্যক্ষ পদ ছেড়েছেন স্বজাতি, স্বধর্মের লোকের রক্ষার জন্য। ১৯ শে মে’র শহীদ মঞ্চের ঘোষণা, ধর্মের ভিত্তি নয়। বহুত্ববাদ, সবার ভাষা সংস্কৃতিই অসমের সমন্বয়ী প্রবাহ, তাকে রক্ষা করতে হবে।

 

(লেখাটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছে ‘রংধনু’ নামে একটি প্রত্রিকায়।)

Back To Top