মোদীর দ্বিতীয় কার্যকাল: বেনজীর ব্যর্থতার এক বছর

সাইফুল্লা লস্কর : মোদী সরকারের দ্বিতীয় কার্যকালের মেয়াদ এক বছর উত্তীর্ণ হওয়ার প্রাক্কালে দেশ জুড়ে শুরু হয়েছে বিচার বিশ্লেষণ এই সরকারের সাফল্য ব্যর্থতার খতিয়ান নিয়ে। যেখানে মোদী সরকার এই এক বছরে কংগ্রেসের ৬০ বছরের থেকে বেশি কাজ করার দাবি করছে সেখানে বিরোধীরা বলছে মোদী সরকারের এই এক বছর স্বাধীনতার পর দেশের ইতিহাসে অন্যতম সংকটপূর্ণ বছর হিসেবে যার মুল কারন সরকারের নীতিগত ব্যর্থতা। আলাদা আলাদা ভাবে দেখা যাক মোদী সরকারের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সাফল্য এবং ব্যর্থতার পরিসংখ্যান।

অর্থনীতি :
মোদী সরকারের অধীন গত এক বছর ভারতের অর্থনীতির বিকাশ হার ছিল ৪.২% যা শেষ গত ১১ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন, এই পরিসংখ্যান করোনা আবির্ভাবের আগে পর্যন্ত। গত অর্থ বর্ষের চারটি ত্রৈমাসিকে জিডিপি বৃদ্ধির হার ছিল যথাক্রমে ৫.২%, ৪.৪%, ৪.১% এবং ৩.১%।  অর্থনৈতিক অবস্থা গত বছরে ক্রমশ অবনতির দিকে এগিয়েছে যদিও সব থেকে খারাপ সময় এখনও অপেক্ষা করছে আমাদের সামনে। ব্যাক্তিগত ব্যয়, বিনিয়োগ হ্রাস পেয়েছে ব্যাপক মাত্রায়। পরিসেবা ক্ষেত্র এবং উৎপাদন ক্ষেত্র সব থেকে বেশি প্রভাবিত হয়েছে। বছরের শেষের দিকে করোনা প্রভাব মোকাবিলায় অর্থমন্ত্রী নির্মলা সিতারামান ২০ লাখ কোটির অর্থনৈতিক প্যাকেজ ঘোষণা করে অর্থনীতির হাল ফেরানোর চেষ্টা করলেও তাতে কাজ হয়নী।

বেকারত্ব :
২০১৪ সালে ক্ষমতায় আসার আগে প্রতি বছর ২ কোটি কর্মসংস্থানের প্রতিশ্রুতি দেয় মোদী কিন্তু সরকার গঠনের পর সরকারি ভাবে বার্ষিক কর্মসংস্থানের তথ্য প্রকাশ করা বন্ধ করে দেয় সরকার। তবে ২০১৭-১৮ তে সিএমআইই এর রিপোর্ট থেকে জানা যায় ভারতে বেকারত্বের হার ৬.২% সেই হার এই বছরের মার্চ পর্যন্ত গিয়ে ঠেকেছে ২৪.২ শতাংশে। গত বছর শ্রম মন্ত্রণালয় থেকে ভুলবশত প্রকাশ পাওয়া এক রিপোর্ট থেকে জানা যায় ভারতের বেকারত্ব গত ৪৫ বছরের মধ্যে সর্বাধিক পর্যায়ে পৌঁছেছে। এই লকডাউনের সময় ভারতে প্রায় ১২ কোটি ১৫ লাখ মানুষ কর্মচুত হয়েছেন বলে জানা গিয়েছে।

মুসলিমদের ওপর নির্যাতন :
মব লিঞ্চিং : ভারতে মব লিঞ্চিং এর ঘটনা পূর্বের যেকোনো বছরের তুলনায় বৃদ্ধি পেয়েছে। সাধারণ মুসলমানদের বিরুদ্ধে মিডিয়ার সাহায্যে ঘৃণা ছড়ানো এই সরকারের আমলে নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে। দিল্লির নিজামউদ্দিন মসজিদে তাবলিগি জামাতের বিরুদ্ধে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে করোনা ভাইরাস ছড়ানোর অভিযোগ করে করা বিষোদগার এখনও কেউ ভুলতে পারেনি।

দিল্লি দাঙ্গা :  উত্তর পূর্ব দিল্লি তে বিজেপি নেতাদের সাম্প্রদায়িক উস্কানি মূলক মন্তব্যের জন্য সংঘটিত হওয়া দাঙ্গায় ৫০ জনের বেশি মানুষ প্রাণ হারায় এবং অসংখ্য মানুষ নিখোঁজ হয় যাদের বেশিরভাগ মুসলমান। ট্রাম্পের সফরকালে সংঘটিত হওয়া এই দাঙ্গায় আন্তর্জাতিক গণ মাধ্যমে মোদীর ব্যাপক সমালোচনা হয়। কপিল মিশ্র, অনুরাগ ঠাকুরের মতো বিজেপি নেতারা সরাসরি মুসলমানদের বিরুদ্ধে কথা বলে দাঙ্গা বাধালেও পুলিশ তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যাবস্থা নেয়নি উপরন্তু পুলিশি ভূমিকার বিরুদ্ধে প্রতিবাদী মুসলিম ছাত্র ছাত্রী এবং সমাজকর্মীদের গ্রেফতার করে। সাম্প্রদায়িকতার ওপর ভর করে দ্বিতীয় বার ক্ষমতায় আসা মোদী সরকারও এই সব নেতাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি।

CAA বিরোধী প্রতিবাদ বিক্ষোভ এবং সরকারি দমন পীড়োন :
মোদী সরকারের পাশ করানো অসাংবিধানিক এবং বেআইনি নাগরিকত্ব সংশোধনী বিলের বিরোধিতায় সরব হয় গোটা দেশ। প্রাথমিকভাবে আসাম এবং উত্তর পূর্ব ভারত থেকে শুরু হওয়া প্রতিবাদ আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে গোটা দেশে কোথাও কোথাও তা সহিংস রূপ নেয় আবার পুলিশের নির্যাতনে এবং পুলিশের গুলিতে অনেক নিরীহ প্রতিবাদকারির মৃত্যু হয়, বিভিন্ন বিজেপি শাসিত রাজ্যে প্রতিবাদকারিদের বাড়ি ঘর ভেঙে দেয় এবং তাদের বিরুদ্ধে মামলা রুজু করে। দিল্লির শাহীন বাগ এই প্রতিবাদের মুখ হয়ে ওঠে। অমিত শাহের দিল্লি পুলিশ শাহীন বাগের প্রতিবাদ কারীদের মিথ্যা মামলায় ফাঁসিয়ে গ্রেপ্তার করে এবং জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়ার ছাত্রদের ওপর নির্বিচারে লাঠিচার্জ করে অনেককে আহত করে।

বৈদেশিক নীতিতে ব্যর্থতা :
মোদী সরকার ক্ষমতায় আসার সময় যে সব দেশ ভারতের একান্ত মিত্র এবং বন্ধু প্রতিম রাষ্ট্র ছিল তাদের অনেকে মোদী সরকারের নীতির কারণে আজ ভারতের শত্রু দেশগুলোর মিত্রতে পরিণত হয়েছে। কূটনৈতিক ব্যর্থতায় ভারতের সর্বকালের মিত্র নেপাল এখন ভারতের শত্রু চীনের একান্ত মিত্র। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ঘৃণা ছড়িয়ে এবং জাওয়ান প্রীতি দেখিয়ে রাজনীতির আসর সাজানো বিজেপি পাকিস্তান সীমান্তে ভারতীয় জওয়ানদের মৃত্যু কমাতে পারেনি উপরন্তু তাদের আগ্রাসী নীতির কারণে ২৭ শে ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানের হাতে ভূপতিত হয় ভারতের এক মিগ-২১ যুদ্ধবিমান এবং পাইলট বন্দি হয় পাকিস্তানের হাতে। সীমান্ত হত্যা এবং তিস্তার জলচুক্তির মতো বিষয়ে অসন্তুষ্ট বাংলাদেশ এখন ভারতের অতটা নির্ভরযোগ্য প্রতিবেশী নয়। শ্রীলঙ্কা এবং মালদ্বীপে ও ভারতের তুলনায় চিনা বাহিনী অনেক শক্ত অবস্থান অর্জন করেছে। গত এক মাস ধরে লাদাখ সীমান্তে চিনা সেনারা ভারতের সীমান্তের ৫ কিমি ভিতরে এসে অবস্থান করে থাকলেও মোদী সরকার কূটনৈতিক ভাবে এর সমাধানে কোনো পথ বের করতে পারেনি। ইসলাম এবং মুসলিমদের বিরুদ্ধে ঘৃণা ছড়ানোর অভিযোগে আরব বিশ্বও আজ ভারতের মিত্রদের তালিকায় থাকতে নারাজ।

কাশ্মিরের বিশেষ মর্যাদা প্রত্যাহার :
গত বছর অগাস্টের ৫ তারিখে সংসদে এক বিশেষ অর্ডিন্যান্স এনে জম্মু কাশ্মীরের স্বায়ত্বশাসনের সনদ আর্টিকেল ৩৭০ এবং ৩৫ এ প্রত্যাহার করে মোদী সরকার সমস্ত কাশ্মীরকে পূর্ণ লকডাউনের মধ্যে রেখেছে টেলিফোনে ইন্টারনেট পরিসেবা বন্ধ রেখে কিন্তু সেখানে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা নিত্য দিন ঘটছে বলে অভিযোগ করছে মানবাধিকার সংগঠনগুলো তবে মোদী সরকার কাশ্মিরী দের সাংবিধানিক অধিকার শেষ করে দেয়ার পর থেকে সন্ত্রাসবাদী হামলার ঘটনা কোনো ভাবেই কমেনি বরং সাধারণ কাশ্মীরি যুবকদের অস্ত্রও তুলে নেওয়ার ঘটনা বেশি ঘটেছে বলে দেখা গিয়েছে। উপত্যকার অর্থনীতি ইতিমধ্যে কয়েক লক্ষ কোটি টাকার ক্ষতির শিকার হয়েছে। সেখানে মানব ইতিহাসের প্রথম উন্মুক্ত আকাশের নিচে জেল তৈরি করে দিয়েছেন মোদী সরকার এবং বন্ধ করে রেখেছে ৭০ লাখ উপত্যকা বাসীকে।

করোনামোকাবিলা :
যে সময় পুরো বিশ্ব করোনা গ্রাস থেকে বাঁচার জন্য প্রস্তুতি নিতে ব্যাস্ত ছিল ঠিক সেই সময় মোদী ১০০ কোটি টাকা খরচ করে গুজরাটের মোটেরা স্টেডিয়ামে ট্রাম্পের সঙ্গে নমস্তে ট্রাম্প অনুষ্ঠানের মাধ্যমে লাখো মানুষ জড়ো করো করোনা সংক্রমনে বড়ো অবদান রাখে। সরকারের সময় মতো সঠিক সিদ্ধান্তের অভাবে এবং ভারতে মাস্ক, ভেন্টিলেটর, পিপিই এবং যথেষ্ঠ পরিমাণ ওষুধ সরবরাহের ব্যবস্থা না থাকায় করোনা মোকাবিলায় দেশবাসীকে অনেক প্রতিকূলতার শিকার হয়েছে। কয়েক ঘণ্টা সময় দিয়ে ঘোষণা করা লকডাউনের কারণে ভারতের বিভিন্ন শহরে আটকে পরে লাখো শ্রমিক যারা নিজেদের হাতে থাকা সীমিত অর্থ নিঃশেষ হওযার পর পায়ে হেঁটে হাজারো মাইল দূরে বাড়ির পথে যাত্রা শুরু করে। সরকার কোনো ব্যাবস্থা না নেওয়ায় এই ভাবে বহু শ্রমিকের মৃত্যু হয়। মে মাসের শুরু থেকে সরকারের চালু করা শ্রমিক স্পেশাল ট্রেন করে বাড়িতে ফেরানোর ব্যাবস্থা করা হয় কিন্তু তাতেও প্রায় ৮০ জন শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে এখনও পর্যন্ত বলে জানা গিয়েছে।

প্রশ্ন উঠছে এটাই কি মোদীর প্রতিশ্রুতির স্বর্ণ যুগ? কোথায় সেই কৃষক শ্রমিক বান্ধব সরকার? কোথায় বেকারদের কর্মসংস্থান? শুধু সাম্প্রদায়িকতার ওপর ভিত্তি করে কতদিন চলবে এই সরকার ? সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নিজেদের ব্যর্থতা ঢাকতে মোদী সরকার সাম্প্রদায়িকতার ওপর আরো বেশি নির্ভরশীল হয়ে যাবে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।

Back To Top