কেন লাদাখে ড্রাগন সেনা ?

সাইফুল্লা লস্কর

করোনা ভাইরাসের ধাক্কায় বেসামাল সুপার পাওয়ার আমেরিকার ক্রমহ্রাসমান প্রভাবের সুবিধা নিয়ে চিন নিজের আধিপত্য বলয়ের বিস্তারে মনোযোগী হয়েছে। এই আধিপত্য বিস্তারে তাদের মূল প্রতিদ্বন্দ্বী আমেরিকা এবং তার সহযোগী মিত্র দেশগুলো যেমন ভারত জাপান অস্ট্রেলিয়া ইত্যাদি। তাই চিন প্রথমে নিজের পথের কাঁটা পরিষ্কার করার জন্য এই সব দেশ গুলোর বিরুদ্ধে আগ্রাসী মনোভাব দেখিয়ে চিন তাদের বুঝিয়ে দিতে চায়, যেকোনো ক্ষেত্রে তারা আমেরিকার স্বার্থে চীনের বিরুদ্ধে দাঁড়ালে তাদের স্বার্থ ভয়াবহ ভাবে বিঘ্নিত হবে। তারই একটা অংশ হিসেবে চিনা ফৌজ লাদাখে প্রবেশ করেছে। তবে বিশেষজ্ঞ এবং কূটনীতিকরা এর পিছনে আরো কিছু কারণ দেখতে পাচ্ছেন।

আমেরিকা ও চীনের মধ্যেকার দ্বন্দ্বে ভারতের প্রবেশ :


  চিন দক্ষিণ চীন সাগরে নির্বিঘ্নে আমেরিকার শত হুমকী অগ্রাহ্য করে কৃত্রিম দ্বীপ এবং সেখানে সামরিক স্থাপনা নির্মাণের মাধ্যমে নিজদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে অনেকাংশে সফল হয়েছে। চীনের এই বিস্তারমুখী নীতিতে উদ্বিগ্ন আমেরিকা তাদের বিরুদ্ধে প্রথমে তাদের ওপর ইচ্ছাকৃত করোনা সংক্রমন ছড়ানোর অভিযোগ আনে এবং তাদের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক স্তরের তদন্ত পরিচালনার জন্য বৈশ্বিক জনমত সংগ্রহে তৎপর হয় যাতে তারা সফল ও হয়েছে। বিভিন্ন মার্কিন গণমাধ্যমে এখন শোনা যাচ্ছে আমেরিকাতে পাঠরত প্রায় ৩ লাখের বেশি চিনা ছাত্র ছাত্রীদের চীনের হয়ে গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগে দেশে ফেরত পাঠাতে চলেছে ট্রাম্প প্রশাসন। ফলে দুই দেশের সম্পর্ক তলানিতে এসে ঠেকবে এতে কোনো সন্দেহ নেই। আবার তিব্বতকে স্বাধীন রাষ্ট্র ঘোষণার জন্যও আমেরিকা উদ্যোগ নিচ্ছে যা চীনের কাছে খুব বড়ো উদ্বেগের বিষয়। হংকং এ চিনা নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদকারীদের ওপর বলপ্রয়োগের বিরুদ্ধে নিন্দা জানিয়ে এই ঘটনায় অন্য সহযোগী ব্রিটেনকে কাজে লাগাতে চাইছে আমেরিকা। উল্লেখ্য ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত ব্রিটেনের দখলে ছিল হংকং এবং এখনও সেখানকার অধিবাসীরা ব্রিটেনে বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা ভোগ করে।

এমতাবস্থায় আমেরিকা চীনের এই প্রবল দ্বন্দ্বের মাঝে ভারত যাতে কোনোভাবেই প্রবেশ না করে তার হুশিয়ারি দিয়েছে চিনা সরকারি মুখপাত্র গ্লোবাল টাইমস। তারা বলেছে চিন এবং আমেরিকার মাঝে ভারত আসলে তার পরিণাম ভারতের জন্য খুবই ভয়াবহ হবে। ভারত যাতে আপাতত আমেরিকার সাহায্য করার কথা না ভাবে তাই চিনা ফৌজ ভারতীয় সীমানায় প্রবেশ করে ভারতের মধ্যে সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টির প্রয়াস করছে বলে মনে করছে অনেকে।

লাদাখের স্বায়ত্তশাসনের মর্যাদা বিলুপ্তকরন  :


গত বছর ৫ ই আগস্ট ভারতের মোদী সরকার লাদাখ সহ পুরো জম্মু এবং কাশ্মিরের স্বায়ত্তশাসনের মর্যাদা বাতিল করে ভারতের কেন্দ্রীয় শাসিত অঞ্চল হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করে। এই ঘটনার পর ভারত সরকারের প্রকাশিত মানচিত্রে চীনের দখলে থাকা আকসাই চীনকে অন্তর্ভুক্ত করে যা চীনকে বিচলিত করে এবং সে সময় তারা জানিয়ে ছিল তারা লাদাখের ব্যাপারে ভারতের কোনো সিদ্ধান্ত মানে না।
চীনের সঙ্গে ভারতের আন্তর্জাতিক সীমানা  রয়েছে ৩৪৮৮ কিমি যার মধ্যে বেশিরভাগ দ্বিপাক্ষিক ভাবে চিহ্নিত এবং নির্ধারিত নয়। তবে ১৯৯৩ সালে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী নরসিমা রাওয়ের সঙ্গে চিনা কর্তপক্ষের এক চুক্তি হয় লাদাখের সীমানার ব্যাপারে যেটা আজ পর্যন্ত ভারত সরকার এবং সেনাবাহিনী প্রতিষ্ঠিত মতামত বলে মেনে চলে কিন্তু চিনা বাহিনী তা একটা নেহাত সম্মতি বলে মনে করে। ফলে চিনা বাহিনী নিজেদের তৈরি করা অজুহাতেই লাদাখের মধ্যে ঢুকেছে। তারা এখন চায় লাদাখের পূর্বের স্বায়ত্তশাসনের মর্যাদা ফিরিয়ে দেয়া হোক।

চিনা মিত্র পাকিস্তানের পাশে দাঁড়ানো  :


জম্মু কাশ্মিরের বিশেষ মর্যাদা প্রত্যাহারের পর থেকে পাকিস্তান ক্রমাগত এই ব্যাপারে আন্তর্জাতিক স্তরে ভারতের ওপর চাপ সৃষ্টির প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। আবার পাকিস্তান বিরোধী ভাবধারকে নিজেদের রাজনীতির মুখ্য হাতিয়ার হিসেবে ব্যাবহার করা মোদী সরকার পাকিস্তানের দখলে থাকা কাশ্মীর এবং গিলগিট বালটিস্টানের ওপর আবহাওয়ার পূর্বাভাষ দেখানোর পাশাপাশি নিজদের সেনা তৎপরতা বৃদ্ধি করছিল এলওসি এর আশপাশে বলে বিভিন্ন সূত্র থেকে খবর আসছিল। বার বার পাকিস্তান আক্রমণ করে নিজেদের দাবি করা এলাকা ফিরিয়ে নেয়ার কথা শোনা যাচ্ছিল সরকারি দলের অনেক নেতা মন্ত্রীর গলা থেকে। পাকিস্তান যদি ভারতের হাতে আক্রান্ত হয় তাহলে বেশ কয়েকদিক থেকে লোকসানের মুখে পড়বে চিন। পাকিস্তান এই অঞ্চলে চিনের সব থেকে বড় বন্ধুদেশ। তাদেরকে যদি চিন ভারতের হুমকি থেকে রক্ষা করতে না পারে তাহলে অন্যান্য মিত্র দেশগুলো চীনকে ভরসার উপযুক্ত  বন্ধু বলে তাদের ওপর আস্থা রাখতে পারবেনা। আবার ভারতের দাবি করা পাকিস্তানের দখলে থাকা ভূখণ্ডের ওপর থেকে চীনের ৬২ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগে চিন পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোর নির্মিত হয়েছে যা ভারতের আক্রমণে প্রবল ক্ষতির মুখে পড়বে। সেদিক থেকে ভারতকে চাপে রাখতে চীনের এই পদক্ষেপ বলে ধারণা করা হচ্ছে।

রাষ্ট্রসঙ্ঘের তত্ত্বাবধানে করোনা তদন্ত কমিশনের প্রধান দায়িত্ব ভারতের হাতে  ন্যস্ত :


চীনের উহান থেকে উদ্ভুত মারণ ভাইরাস করোনা এখন পুরো বিশ্ব জুড়ে এক ত্রাসের নাম। কাকতালীয় ভাবে চিনে উদ্ভুত এই ভাইরাস চিনের তেমন একটা ক্ষতি করতে না পারলেও তাদের শত্রু আমেরিকার সবথেকে বেশি ক্ষতি করেছে। তাই মার্কিন মুলুকে অনেকে এটাকে চীনের ষড়যন্ত্র হিসেবে দেখছে। তারা মনে করে চিন, আমেরিকার ইতিমধ্যে নিম্নমুখী অর্থনীতির ক্ষতি করার জন্য ইচ্ছা করে এই ভাইরাস আমেরিকায় রপ্তানি করেছে। তাই রাষ্ট্রপতি ট্রাম্প এই ভাইরাসকে চিনা ভাইরাস নামে দিয়ে এর বিরুদ্ধে তদন্তের দাবি করছিলেন যা এখন হতে চলেছে রাষ্ট্রসঙ্ঘের তত্ত্বাবধানে এবং এই তদন্ত কমিশনের প্রধান দায়িত্ব ন্যস্ত হয়েছে ভারতের হাতে। চীনের জন্য এটা নিঃসন্দেহে উদ্বেগের বিষয়, তাই চিনা বাহিনী ভারতকে দেখানোর জন্য এসেছে যে তারা যদি চীনের বিরুদ্ধে কোনো স্বার্থ হানিকর ব্যাবস্থা নেওয়ার কথা ভাবে তাহলে তাদেরকে ছেড়ে কথা বলবে না তারা।

এছাড়াও চীনের বিরুদ্ধে ভারত আমেরিকার সঙ্গে চীনের আশেপাশে তাদের বৈরী দেশ জাপান, অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া প্রভৃতি দেশের সঙ্গে মিলে এক জোট তৈরির প্রচেষ্টা করছে অনেকদিন থেকে যার থেকে ভারতকে সরে যাওয়ার আশ্বাস চাইতে পারে এখন চিন। চিন একটা ঢিলে এ যাত্রায় অনেক পাখি শিকার করতে চায়। তবে ভারত চীনের এই শিকারের অভিসন্ধি কিভাবে মোকাবিলা করে এবং নিজের স্বার্থ, সার্বভৌমত্ব কিভাবে রক্ষা করে সেটাই এখন দেখার।

Back To Top