কেন ইরান এবং সৌদি আরব পরস্পরের শত্রু ?

সাইফুল্লা লস্কর : মুসলিম বিশ্বের প্রাণ কেন্দ্র বলা হয় মধ্য প্রাচ্যকে। কারণ এখানে কেন্দ্রিভুত হয়ে আছে মুসলিম বিশ্বের বেশিরভাগ শক্তি এবং সম্পদ। এই অঞ্চলটি ওতপ্রোতভাবে জড়িত ইসলামের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতির সঙ্গে। মুসলিম বিশ্বের বেশিরভাগ পবিত্র স্থানগুলোর অবস্থানও এখানে। বর্তমান মানব সভ্যতার মূল চালিকাশক্তি খনিজ তৈল সম্পদের সর্ববৃহৎ ভান্ডারের উপস্থিতিতে সমৃদ্ধ হওয়ার কারণে বিশ্বশক্তি গুলো সব সময়েই এই অঞ্চলের ওপর নিজেদের আধিপত্য কায়েম করার চেষ্টা চালিয়ে এসেছে এবং এখনও করছে। মহাশক্তি গুলোর ক্ষমতা দখলের এই প্রতিযোগিতার ফলে হয়েছে আঞ্চলিক শক্তির বিভাজন। এই শক্তি বিভাজনের কারণে উদ্ভুত বর্তমান মধ্য প্রাচ্যের দুটি মেরুর একটি হলো আমেরিকা এবং পশ্চিমা দেশগুলোর মদদপুষ্ট সৌদি আরব এবং এর মিত্র শক্তি অন্য দিকে আছে রাশিয়া এবং চীনের সমর্থনপুষ্ট ইরান এবং এর মিত্র দেশগুলো। মধ্যপ্রাচ্যে নিজেদের প্রভাব বিস্তারের জন্য এই দুটি শক্তি সর্বদা পরস্পরের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করে। তবে সুন্নি অধ্যুষিত সৌদি আরবের সঙ্গে শিয়া অধ্যুষিত ইরানের এই বৈরিতার একটা ঐতিহাসিক পটভূমি আছে।

১৯৭৯ সাল পর্যন্ত সৌদি আরব এবং ইরান দুটি রাষ্ট্রই আমেরিকা সমর্থিত একনায়ক দ্বারা শাসিত হতো। ইরানের শাহ এবং সৌদি বাদশাহদের মধ্যে ইরানে ১৯৭৯ এর বিপ্লবের আগে পর্যন্ত উষ্ণ সম্পর্ক বজায় থাকত। এমনকি ১৯৭৮ সালে সৌদি সফরে গিয়েছিলেন ইরানের তৎকালীন শাহ মুহাম্মদ রেজা পাহলাভি। কিন্তু পরিস্থিতির আমূল পরিবর্তন ঘটে ১৯৭৯ সালে যখন শাহের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে ইরানে সফল ইসলামী বিপ্লবের ফলে মার্কিন গ্রাস মুক্ত হয় দেশটি। দীর্ঘ ১৫ বছর নির্বাসনের পর দেশে ফেরেন আয়াতুল্লাহ খোমেনী।রাজধানী তেহরানের আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে তাকে স্বাগত জানাতে হাজির হয় ১০ লক্ষেরও বেশি মানুষ। এই সফল ইসলামী বিপ্লবের মাধ্যমে একনায়কতন্ত্রের উৎখাতের ফলে ইরানের আশপাশে বিভিন্ন দেশে একই রকম জনজাগরণের গুঞ্জন শুরু হয়। সরাসরি খামেনী বিরোধিতা করেন একনায়কতন্ত্রের এবং এটাকে ইসলামী বিরোধী বলে অভিহিত করেন।  এমনকি সিআইএ এর প্রকাশ করা গোপন নথি থেকে জানা যায় ইরান মধ্য প্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে তাদের ইসলামী বিপ্লবের ধারণা রপ্তানি করতে চেষ্টা করেছিল। সৌদি আরবের শীয়া অধ্যুষিত কাতিফ শহরে  শুরু হয় একই রকম আন্দোলন। খামেনির চিত্র নিয়ে রাস্তায় নামা আন্দোলনকারীদের ওপর নিরাপত্তা রক্ষীদের বলপ্রয়োগে মৃত্যু হয় ২০ জন প্রতিবাদকারীর।

ঘটনায় উদ্বিগ্ন সৌদি আরব আশপাশের আরো ছয় একনায়তান্ত্রিক দেশের সঙ্গে নিয়ে প্রতিষ্ঠা করে জিসিসি। ১৯৮২ তে শিয়া অধ্যুষিত ইরাকে ইরানের বিপ্লবের ফলে ইরাকে অস্থিরতা সৃষ্টি হতে পারে এই আশঙ্কায় ইরানে অভিযান চালায় রাষ্ট্রনায়ক সাদ্দাম হোসেন। সাদ্দামকে প্রত্যক্ষ সমর্থন দেয় সৌদি সরকার। ১৯৮৭ সালে ইরানি হজ যাত্রীরা সৌদি সরকারের বিরুদ্ধে প্ল্যাকার্ড হাতে মক্কা শহরে প্রতিবাদ করেন যার ফলে ধস্তাধস্তিতে নিহত হয় প্রায় ৪০০ জন। ইরানের সঙ্গে সব রকম সম্পর্ক ছিন্ন করে সৌদি আরব।

এর পর থেকে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক অনেক উথান পতনের সাক্ষী হয়। সম্পর্কের নতুন টানাপোড়েন তৈরি হয় ২০১১ সালে সিরিয়াকে কেন্দ্র করে। আমেরিকার সমর্থনপুষ্ঠ সৌদি আরব এবং এর মিত্র দেশগুলো সরাসরি সিরিয়ার বাসার সরকারের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয় এবং তাকে উৎখাত করার জন্য সর্বতভাবে প্রচেষ্টা শুরু করে। অন্য দিকে সুন্নি অধ্যুষিত সিরিয়ায় শিয়া গোষ্ঠী থেকে আগত বাসার সরকারের পক্ষে সব রকম সাহায্য পাঠায় ইরান এবং রাশিয়া। আসাদ পক্ষকে অস্ত্র সাহায্য করে ইরান এবং তাদের সৈন্যদের প্রশিক্ষণেরও ব্যাবস্থা করে তারা। সৌদি অনেক প্রচেষ্টার পরও এখনও বাসার সরকারের দখলে সিরিয়ার বেশিরভাগ অঞ্চল। তবে বিদেশের হস্তক্ষেপ ও মদতে চলা রক্তক্ষয়ী গৃহদ্বন্দের ৮ বছরে প্রাণ গিয়েছে ৫০০০০ এর ও বেশী মানুষের। বস্তুচ্যুত হয়েছে প্রায় ৬০ লক্ষ মানুষ এবং শরণার্থী হয়েছে প্রায় ৫০ লক্ষ মানুষ।

এর পর ইয়েমেনে শিয়া হাউথি বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান কেন্দ্র করে প্রবল উত্তেজনা সৃষ্টি হয় ইরান এবং সাউদির মধ্যে। ইরানে সৌদি দূতাবাসে হামলার কারণে সম্পূর্ণ রূপে বিচ্ছিন্ন হয় দ্বিপাক্ষিক কূটনৈতিক সম্পর্ক। দুটো দেশ কখনো সরাসরি সামরিক সংর্ঘষে লিপ্ত না হলেও দুদেশের মধ্যে প্রক্সি যুদ্ধ সব সময় চলতে থাকে। বাহরাইনে এবং লেবাননে নিজেদের আধিপত্য বিস্তারে উভয় দেশের নিজস্ব পরস্পরবিরোধী কর্মসূচি আছে। তবে লকডাউনের মধ্যে সৌদি থেকে মার্কিন সামরিক বাহিনীর প্রস্থানের ফলে এখন নতুন আশার সঞ্চার হয়েছে মধ্য প্রাচ্যে। তবে এই ঘটনা থেকে শিয়া সুন্নি বিরোধের ফলে মধ্য প্রাচ্যে আধিপত্য বিস্তারের লড়াইয়ে ত এই দুই দেশ নিজেদের মধ্যেকার দূরত্ব কম করতে পারে কিনা তার উত্তর কেবল সময়ই দিতে পারে।

Back To Top