সাংবিধানিক অধিকার আদায়ে মুসলিমদের ব্যর্থতার কারণ

মুন্সী আবুল কাশেম..

ইতিহাসকে সাক্ষী রেখে আমরা বলতে পারি যে রাজনৈতিক কারণে সমগ্র ব্রিটিশ আমলে (প্রায় ২০০ বছর) মুসলিম সমাজ ছিল নির্যাতনের শিকার। আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে তারা ছিল নিষ্পেষিত। তার উপর অনেকখানি রক্ষণশীলতার কারণে ইংরেজ প্রবর্তিত আধুনিক শিক্ষার অঙ্গনে মুসলমানরা আন্তরিক ভাবে প্রবেশ করেনি। ফলে জীবনের সর্বক্ষেত্রে তারা পিছিয়ে পড়তে শুরু করে।

পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী শুধু মুসলমানরাই ছিল না। নন-মুসলিম সমাজের এক বড় অংশ, যারা এস.সি. / এস.টি. হিসাবে অভিহিত তারাও পিছিয়ে ছিল। ভারতীয় সংবিধান ১৫(৪) ধারা অনুযায়ী নন-মুসলিম হিসাবে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে উত্তোলনের বিধিব্যাবস্থা করেছেন। কিন্তু মুসলিম সমাজের জন্য তেমন কোনও আইন বিধিবদ্ধ হয়নি। ফলে তারা যেমন পিছিয়েছিল তেমনি পিছিয়ে আছে। এটিই মুসলিম জনজীবনের তীব্র যন্ত্রণা। ১৫(৪) ধারায় কী বলা আছে? এই ধারার বলে সম্প্রদায় ও তৎসহ যারা শিক্ষা ও সামাজিক ক্ষেত্রে পিছিয়ে আছে তাদের উন্নয়নে বিশেষ ব্যাবস্থা গ্রহণ করার কথা বলা আছে। এস.টি. / এস.সি. কারা? বেচারি হতভাগ্য ভারতীয় জনসমাজের এই অংশ। তারা এদেশরই আদিম আদিবাসী। গৌর বর্ণের আর্যরা দামামা বাজিয়ে এদেশ দখল করে নেয়। গায়ের জোরে আদিম আদিবাসীদের এক বড় অংশকে বিতাড়িত করে। তারা বাধ্য হয়ে আশ্রয় নেয় বনে-জঙ্গলে, দুর্গম গিরি ও কান্তার মরু প্রান্তরে। তাদের ভাগ্যে তকমা দেওয়া হল অসভ্য বর্বর জনজাতি যারা সভ্য সমাজ বহির্ভূত এক ভাগ্যহারা অসামাজিক জীব। তারাই হল ভারতীয় সংবিধানের এস.টি. সম্প্রদয়।

এস.সি. কারা? এস.সি. -রা অনেকটাই ভাগ্যবান। ডাক পড়লেই যেন তারা আর্যদের দুয়ারে হাজির হতে পারে। তাদের জন্য অবশ্য দেশের সম্পদ বা সম্পত্তির মালিকানা বরাদ্দ করা হবে না। দেবালয়ে উঠতে দেওয়া হবে না। বেদ, পুরাণ, উপনিষদ স্পর্শ করার অধিকার তারা পাবে না। জীবন হবে তাদের কাছে দুর্বিষহ। এই সন্ধিক্ষণে তারাই হল ভারতীয় সংবিধানে এস.সি.। রাজনৈতিক উত্থান পতনে ভারতের শাসক শ্রেণীর রুপ পরিবর্তন হয়েছে। আর্য দেবতার স্থলে মুসলিম নবাব বাদশারা এসেছেন, তাদের সরিয়ে দিয়ে ইংরেজরা ক্ষমতা দখল দখল করেছে। দেশ ও দুনিয়ার অনেক পরিবর্তন হয়েছে কিন্তু দুর্ভাগ্য ভারতের শূদ্র, দলিত, অস্পৃশ্য আদিম আদিবাসী এস.সি / এস.টি. -দের জীবনে বিশেষ কোনও পরিবর্তন হয়নি। আর্য সভ্যতার পরিভাষায় এস.সি / এস.টি. -দের ধর্মীয় অবস্থান যেখানেই থাকুক না কেন পরবর্তীকালে তারা অবশ্য বৃহত্তর হিন্দু সমাজে উল্লেখযোগ্য অংশ হিসাবে প্রতিষ্ঠা লাভে সমর্থ হয়েছে।

স্বাধীন ভারতের রূপকারক ‘বাবাসাহেব ভীমরাও রামজি আম্বেদকর’ ভারতের নতুন সংবিধানে তাদের জীবনে আশার আলো ফেলতে পারেছিলেন। তাদের জন্য সংবিধানে স্থান পেয়েছে ১৫(৪) ধারা। তাদের জীবনের গতি পরিবর্তনের জন্য এই ধারার মাধ্যমে সরকারের উপর সাংবিধানিক দায়িত্ব ন্যস্ত করা হয়েছে। তাদের আর্থ-সামাজিক ভাগ্যকে উপরে তুলতে হবে এটি ১৫(৪) ধারার শপথ।

১৫(৪) ধারায় আর এক শ্রেণির হতভাগ্য জনজাতির ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে Socially and educationally backward classes of citizens দের চিহ্নিত করে তাদের জন্য সংবিধানের এই ধারার অধিকার বরাদ্দ করতে হবে। কিন্তু Socially and educationally backward classes  of citizens নির্ধারণের সংজ্ঞা কী হবে তা নিয়ে সংবিধানে বিশেষ কোনও নির্দেশ দেওয়া নেই। গণতান্ত্রিক সরকারের দয়ার উপর বিষয়টি অদ্যাবধি নির্ভর করছে। এস.সি. / এস.টি. -দের সংজ্ঞা দেওয়া আছে, তারা হবে হিন্দু, শিখ, বৌদ্ধ, জৈন ইত্যাদি অ-মুসলিম জনজাতির অংশ। তাদের পদবি থাকতে হবে সরদার, মণ্ডল, সাঁপুই, নস্কর, মাহাতো, কিসকু ইত্যাদি ইত্যাদি। তাদের ধর্মীয় পরিচয় হিন্দু। ঘটনাক্রমে ওইসব পদবি বহন করা এমন বহু মানুষ এদেশে বাস করে যারা মুসলিম ধর্মে বিশ্বাসী। কিন্তু দুঃখের বিষয় এই যে সরদার, মণ্ডল, সাঁপুই, লস্কর পদবি থাকা সত্ত্বেও মুসলিম জনগোষ্ঠী ১৫(৪) ধারার সুযোগ পাবার হকদার নয়। ভাগ্যহারা মুসলিম সমাজ যেমন পিছিয়ে ছিল তারা তেমনই পিছিয়ে রইল। এখন বিচার্য বিষয় মুসলিম সমাজ Socially and educationally backward classes of citizens এর পর্যায়ভুক্ত হবে কি না?

সামাজিক ভাগ্যঃ হতভাগ্য ভারতের মুসলিম সমাজ। এদেশের মুসলিম শাসন আমলে অবহেলিত ও শূদ্র জনজাতির এক বড় অংশ সাম্যবাদী ইসলামিক নীতিতে বিশ্বাসী ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে। যাদের কোনও ধর্ম ছিল না তারা ধর্ম পায়। মন্দিরে যারা উঠতে পারত না, মসজিদে তারা উপাসনা করার অধিকার পেল। আল্লাহ সবার কাছে সমান। মানুষে মানুষে কোনও ভেদাভেদ নেই। একাসনে বসে রাজা প্রজা উভয়েই এক আল্লাহ-কে স্মরণ করার অধিকার পায়। এটি ছিল তৎকালীন ভারতীয় নীচ সম্প্রদায়ভুক্ত জনজীবনের এক বড় অংশ ইসলামে দীক্ষিত হওয়ার কারণ। কিন্তু মুসলিম শাসনাধীন ভারতে মুসলিম সমাজ দুটি ভাগে বিভক্ত ছিল। প্রথম ভাগ, যারা আশরাফ শ্রেণিভুক্ত উচ্চকোটির মানুষ, তাদের ঠাই ছিল রাজ দরবারের আশেপাশে। পরবর্তী কালে এই আশরাফ শ্রেণি রাজ শক্তি অর্জনের লক্ষ্য সামনে রেখে দেশভাগের আন্দোলনে ঝাপিয়ে পড়ে এবং ‘পাকিস্তান’ নামক রাষ্ট্রের আত্মপ্রকাশ ঘটায় এবং সেখানেই তাদের ‘নিরাপদ’ অবস্থান।

মুসলিমদের দাবী দাওয়া নিয়ে পপুলার ফ্রন্ট অফ ইন্ডিয়ার একটি মহা সমাবেশ

বাকি বৃহৎ অংশ ছিল ‘আতরাফ’ শ্রেণির মানুষ তারা ছিল অবহেলিত নিম্নশ্রেণীর মানুষ। তারা ধর্ম পেয়েছিল বটে কিন্তু রাজানুগ্রহ লাভে সমর্থ হয়নি। পূর্ব জীবনের দুঃখ হতাশার কোনও পরিবর্তন তাদের পরের জীবনেও হয়নি। তারা ছিল যেমন অবহেলিত, রয়ে গেল তেমনই অবহেলিত। নতুন রাষ্ট্র ‘আশরাফদের পাকিস্তানে’ তারা যায়নি। তারা দেশভাগ মানেনি। পিতৃ-পিতামহের এই দেশের মাটি তাদের কাছে পবিত্র। এ দেশেই তাদের আপন। এ দেশে তাদের জন্ম, এ দেশেই হবে তাদের নিরাপদ কবরস্থান। সম্ভবত সংবিধান প্রণেতাদের এরূপ ধারণা ছিল যে পরবর্তীকালে স্থিতিশীল ভারতে বিধানসভা বা লোকসভার সম্মানীয় সদস্যরা হতভাগ্য মুসলিম সমাজের ভাগ্য পরিবর্তন ১৫(৪) ধারার সুযোগ লাভের পথ প্রশস্ত করবেন।

কিন্তু দুঃখের বিষয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায় নিজশক্তিতে বিধানসভা ও লোকসভাকে প্রভাবিত করতে পারে না। সরকারি সাহায্য লাভে বঞ্চিত হয়ে মুসলিমরা আগে যা ছিল এখনও তাই আছে এবং সম্ভবত অদূর ভবিষ্যতে তাই থাকবে। সাচার সাহেব অথবা রঙ্গনাথ মিশ্র সাহেব কী বললেন তা নিয়ে বৃহত্তর সমাজে মাথাব্যথার বিশেষ কারণ থাকতে পারে না।

(লেখাটি মুন্সী আবুল কাশেম প্রণীত “৩০ ধারার ডাইরি” বই থেকে অনুমতিক্রমে এখানে প্রকাশ করা হল)। 

Photo Credit: Bing, Getty Images

Back To Top