নেতাজী-কে নিয়ে একটা ভয় সবাই বয়ে নিয়ে চলেছে…. সোমনাথ সিনহা

একটা ভয় সবাই বয়ে নিয়ে চলেছে….

ঠিক এই কারনেই রাষ্ট্রসংঘে আজও সুভাষচন্দ্র বসুর নাম ‘যুদ্ধ অপরাধী’ হিসেবে রয়েছে। তিনি প্রকাশ্যে এলেই ভারত সরকার তাঁকে রাষ্ট্রসংঘের হাতে তুলে দিতে বাধ্য। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর রাষ্ট্রসংঘ শুধুমাত্র নেতাজীর ক্ষেত্রে এই সংক্রান্ত সময়সীমা রেখেছিল 1999 সাল পর্যন্ত। পরে তা বাড়িয়ে 2021 সাল পর্যন্ত করা হয়েছে। মানে এর মধ্যে যদি নেতাজী প্রকাশ্যে আসেন তাহলে ‘যুদ্ধ অপরাধী’ হিসেবে রাষ্ট্রসংঘে তাঁর বিচার হবে।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, 1945 সালে যদি নেতাজীর মৃত্যু হয়েই থাকে তবে রাষ্ট্রসংঘ কেন প্রথমে 1999 সাল পর্যন্ত তাঁর জন্য অপেক্ষা করলো? আবার 1999 সালের পর তা বাড়িয়ে 2021 সাল কেন করলো? কিসের এত ভয়?

আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত ব্রিটেন-আমেরিকা জানিয়ে দিয়েছে 2021 সালের আগে, তাদের হাতে থাকা নেতাজী সংক্রান্ত কোন নথি-পত্র তারা প্রকাশ করতে পারবে না। না, আমাদের দেশের কোনও প্রধানমন্ত্রী, কোনও রাষ্ট্রপতি, দেশের এতগুলো অঙ্গরাজ্যের কোনও মুখ্যমন্ত্রী – এব্যপারে আজ পর্যন্ত কোনও প্রতিবাদ করেননি।

ভয়টা শুরুতেও ছিল। 1939 সালের 12 জুলাই সর্দার প্যাটেল তৎকালিন কংগ্রেস সভাপতি বাবু রাজেন্দ্রপ্রসাদ-কে চিঠি লিখে এক নির্দেশ দিয়েছিলেন সুভাষ চন্দ্র-কে দল বিরোধী কাজের জন্য ‘শো-কজ নোটিস’ জারি করতে। তাঁর বিরুদ্ধে অপবাদ আনা হলো তিনি নাকি বম্বে এআইসিসির ‘মদ্যপান নিষিদ্ধ’ সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেছিলেন। যদিও সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের প্রতিবাদে তা খারিজ হয়ে যায়। স্বাধীনতার পর নেহেরু আর প্যাটেল (1948, 15 জানুয়ারী) ভারতের প্রতিটি থানায় নির্দেশ পাঠিয়েছিলেন, ‘কোনও থানায় নেতাজীর ছবি রাখা যাবে না।‘ সেখেত্রেও প্রতিবাদ বিক্ষোভে সেই নির্দেশও তাঁরা ফিরিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছিলেন।

স্বাধীনতার পর থেকে আজ পর্যন্ত নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু একমাত্র ব্যক্তি যিনি ভারতীয় রাজনীতিতে আজও প্রাসঙ্গিক। ভয়টা থেকেই যাচ্ছে। 1978 সালের লোকসভাতে আজাদ হিন্দ সরকারের ‘বিপুল সম্পদ’ কোথায় গেলো তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল। 1945 সালের 29 জানুয়ারী সুভাষ চন্দ্রের 48 তম জন্মদিনের শেষে তাঁকে অনিচ্ছা সত্ত্বেও সোনা দিয়ে ওজন করা হয়েছিল। পূর্ব এশিয়ার ধনী দরিদ্র নির্বিশেষে বহু ভারতীয় তাঁদের যথাসর্বস্ব দেশের কাজে আজাদ হিন্দ সরকারের হাতে তুলে দিয়েছিলেন। ‘ওয়াই ইয়েলাপ্পা’ ছিলেন আজাদ হিন্দ সরকারের এক ব্যাংক গভর্নর। যুদ্ধ শেষে নেতাজীর নির্দেশে ব্যাংকের সোনা-টাকা পয়সা কয়েকটি বাক্সে ভরে বার্মার নির্দিষ্ট স্থানে নিয়ে যাচ্ছিলেন। ব্রিটিশ বিমান সেই কনভয়ে বোমা ফেলে। ইয়েলাপ্পা মারা যান, অনেক সঙ্গী সাথি গ্রেপ্তার হন। তথনকার বাজার দরে ইয়েলাপ্পা’র সাথে ছিল 85 কেজি সোনা এবং 7 কোটি 37 হাজার টাকা। সবকিছু নিয়ে নেয় ব্রিটিশ বাহিনী। এই সুবিশাল সম্পদ জেনারেল হিউ টয়-এর হাত ঘুরে নেহেরু-র দখলে যায়। জেনারেল হিউ টয় পরে নেতাজীর জীবনী রচনা করে এই ঘটনার উল্লেখ করেছেন (হয় আত্মগ্লানিতে নাহলে ভাগ কম পেয়ে)।

এছাড়াও আরও অনেক জায়গায় বিভিন্ন ক্ষেত্রে আজাদ হিন্দ সরকারের টাকা গচ্ছিত রাখা ছিল, যা পরে ভারত সরকারের হাতে আসে। এইভাবে বহুদিন তর্ক-বিতর্কের পর বহুবছর পরে 1987 সালের 3 আগষ্ট প্রধানমন্ত্রী দপ্তর স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হয় ‘Assets of Netaji Subhas Chandra Bose worth Rs.114 crores transfered to the Govt. of India by the Govt. of Japan, Barma and Singapore’–  অর্থাৎ বার্মাতে এত লুটপাটের পরও জাপান, বার্মা, সিঙ্গাপুর সরকার নেতাজীর আজাদ হিন্দ সরকারের 114 কোটি টাকা স্বাধীনতার পর ভারত সরকারের হাতে তুলে দিয়েছিল। সেইসময় প্রধানমন্ত্রী ‘নেহেরু’ আজাদ ভাণ্ডারের অর্থ-সম্পদ নিয়ে একটা ট্রাস্ট ফান্ড তৈরীর কথা বললেও, তা জমা হয় ইন্ডিয়ান ওভারসিজ ব্যাংকে তাঁর নিজের নামে। মূল্য প্রায় 1,47,163 পাউন্ড (টাকা নয়) এবং পাঁচ (5) কিলো সোনা। লোক দেখানো কিছু সোনা আর মাত্র 200 টাকা জাতীয় সংগ্রহশালায় রেখে দেওয়া হয়। যে সম্পদ নেতাজী গড়েছিলেন দেশের জন্য তা আজও ভোগ করে চলেছে নিজেদের রাজা পরিচয় দেওয়া এক পরিবার। যার ওপর একমাত্র অধিকার আজাদ হিন্দ ফৌজের বীর শহীদ পরিবারের। অথচ স্বধীন ভারতে আজাদ হিন্দ সৈন্যদের পেনসনের দাবীকে ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে বারবার। তাই ভয় থাকবেই।

ভয় ছিলোই ‘যদি তিনি ফিরে আসেন’। ভারতীয় সাধারণ জনগণ যদি সব জেনে যায়। ব্রিটিশ সরকার ক্ষমতা হস্তান্তর সম্পর্কিত দলিলের 6নং ভ্যলিউম-এ ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ক্লিমেন্ট এটলি লিখেছেন – ‘আজাদ হিন্দ সরকার, আজাদ হিন্দ ফৌজের যুদ্ধ এবং যুদ্ধবন্দি আজাদ হিন্দ বাহিনীর বিচারকে কেন্দ্র করে সারা দেশের ব্রিটিশ-ভারতীয় ফৌজ, রাজকীয় নৌ বাহিনী ও বিমান বাহিনীর সদস্যদের মধ্যে যে অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল, তাতে ভারতীয়দের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর ছাড়া বিকল্প পথ ছিল না।’ সেইসময় এই লেখা সাধারণ ভারতবাসী জানতে পারেনি।

ভয় আছে বলেই আজও তাঁর নাম ‘যুদ্ধ অপরাধী’ হিসাবে রেখে দেওয়া হয়েছে। হয়তো 2021 সালের পর সময়সীমা বাড়িয়ে তা 2051 করে দেওয়া হবে। পরে তা আরও বাড়িয়ে দেওয়া হবে।

1945 সালের 15 আগষ্ট নেতাজী একটা ঘোষণা করেছিলেন, “সে কারও দাক্ষিণ্যের ওপর নির্ভর কোনওদিন করে নাই, করবেও না। সে যখন আসবে তথন এমনিই আসবে। সে জন্য কারও সম্মতি, অনুমতি এসব দরকার হবে না। ঝড়ের মতো আসবে সে।” … তাই ভয়তো থাকবেই …
হে শ্রেষ্ঠ মহাপুরুষ , হে শ্রেষ্ঠ দেশপ্রেমিক … তোমার আসন শূন্য আজি হে বীর পূর্ণ করো।

তথ্য:
1) অধ্যপক ডঃ কল্যাণ কুমার দে – ‘নেতাজী সুভাষ : দ্য রিয়েল লিবারেটর অফ ইণ্ডিয়ান সাবকন্টিনেন্ট’।
2) ডঃ পিটার ওয়ার্ড ফের – ‘দ্য ফরগটন আর্মি 1943-45’।
3) পি.এন.চোপরা – ‘কালেক্টেট ওয়ার্কস অফ সরদার প্যাটেল’।
4) নির্মলেন্দুবিকাশ রক্ষিত, অতনু ভট্টাচার্য – বিশেষ নিবন্ধ।

মতামত লেখকের অত্যন্ত ব্যক্তিগত…

সূত্র: Somnath Sinha, প্রকাশ করেছেন কুণাল ভৌমিক ।

সেখান থেকে গ্রহণ করা হয়েছে।

Back To Top