সৈয়দ বদরুদ্দোজা; এক মহাজীবনের কথা

~খাজিম আহমেদ

জন্ম: ১৯০০ সালের ৪ জানুয়ারি। ১৮৯৮ সালের একটি মতও রয়েছে। জন্মস্থান: জেলা মুর্শিদাবাদ। থানা ভরতপুর। হাল আমলে সালার থানা। গ্রাম : তালিবপুর। পিতা: সৈয়দ আব্দুল গোফুর। প্রাথমিক লেখাপড়া সালার ও কাগ্রাম। প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে দর্শন শাস্ত্রে স্নাতক এবং আইনের ডিগ্রী অর্জন করেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শন শাস্ত্রে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী লাভ। অসাধারণ মেধা সম্পন্ন ছাত্র, বহুভাষাবিদ, বাগ্মী হিসাবে অপ্রাপণিয় ক্ষমতার অধিকারী। বিশ শতকের শুরুতেই অখণ্ড বাঙলায় নয়া উত্থিত শিক্ষিত বাঙালি মুসলমান সমাজ থেকে আগত এক তেজী যুবক, প্রখর সম্ভাবনাময় এক রাজনৈতিক নেতা।

কর্মজীবন:

প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাশেষে কর্মজীবনের শুরু। কলকাতা হাইকোর্টে আইন-ব্যবসা শুরু করেন। কিন্তু আইন ব্যবসা বা ওকালতি তাঁর কাছে আকর্ষণীয় মনে হল না।

জীবন ও রাজনীতি:

অবিভক্ত বাঙলার ‘প্রিমিয়র’ (প্রধানমন্ত্রী) ‘শেরে বঙ্গাল’ আবুল কাশেম ফজলুল হক (১৮৭৩-১৯৬২)-এর ইচ্ছেয় এবং প্রভাবে সৈয়দ বদরুদ্দোজা ‘কৃষক প্রজাপার্টি’-র রাজনীতিতে যোগ দেন। তাঁর সঙ্গে একই রাজনীতি করতেন, এ কে এম জাকারিয়া। তিনিও সালার গ্রামের সন্তান। পূর্ণ সময়ের রাজনীতি করার সময় এ তরুণ বদরুদ্দোজা, ‘দেশবন্ধু’ চিত্তরঞ্জন দাশ এবং ‘নেতাজী’ সুভাষচন্দ্র বসুর সঙ্গে পরিচিত হয়ে ওঠেন। ‘অল-ইন্ডিয়া মুসলীম লীগে’-র সঙ্গে তাঁর প্রত্যক্ষ এবং ব্যপক কোন সংযোগ ছিল না। তবে প্রগেসিভ মুসলীম লীগের সদস্য ছিলেন। বিভাগ পূর্ববর্তী ‘বঙ্গীয় আইন সভা’র তিনি সদস্য ছিলেন। ‘পাকিস্তান আন্দোলন’ তিনি সমর্থন করেন নি। হিন্দু-মুসলিম ঐক্যে তাঁর অগাধ বিশ্বাস ছিল। (অমলেন্দু দে, ‘ইসলাম ইন মডার্ন ইন্ডিয়া’ পৃষ্ঠা ১৬৮)।

দেশ বিভাগের পূর্বে মুর্শিদাবাদ জেলায় ‘মুসলিম লীগ’ যখন অপ্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠেছে তেমন সময়েও তিনি তাঁর সরব উপস্থিতি প্রমাণ করেছেন। বিষয়টি পরিষ্কার করি। ‘বহরমপুর মুসলিম কেন্দ্র’ থেকে ‘মুসলিমলীগ’ এর অসাধারণ ক্ষমতাবান নেতা মওলানা আব্দুল বারি ১৯৩৭ সালের নির্বাচনে জয়ী হলেও ১৯৪১-এ মারা যান। সেই কেন্দ্রের উপনির্বাচনে সৈয়দ বদরুদ্দোজা নির্দল প্রার্থী হিসাবে জয়লাভ করেন। এই সময় থেকেই তাঁর সংসদীয় জীবনের শুরু। ১৯৪০-৪৩ এ কলকাতা কর্পোরেশনে কাউন্সিলর এবং ১৯৪৪ সালে ‘মেয়র’ এর দায়িত্বে ছিলেন। তালতলা থানা এলাকার ইউরোপীয়ান অ্যাসাই লাম লেনে’ (কলকাতা) বসবাস করতেন। হাল আমলে রাস্তাটি আব্দুল হালিম লেন নামে চিহ্নিত।

দেশ ব্যবচ্ছেদের প্রাক-মুহূর্তে ১৯৪৬ এর নির্বাচনে সাম্প্রদায়িক প্রচার ভীষণ তীব্র হয়ে উঠেছিল। এই নির্বাচনে ‘বহরমপুর রুরাল মোহামেডান কনসটিটিউয়েন্সি’-তে সৈয়দ বদরুদ্দোজা ন্যাশনালিস্ট মুসলিম লীগ’-এর প্রার্থী হিসাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে ছিলেন, কিন্তু পরাজিত হন। এই কেন্দ্রে ‘মুসলিম লীগের’ মৌলভি আব্দুল গণিকে পরাজিত করেছিলেন মোহাম্মদ খুদাবখ্শ। ১৯৪৭ সালে ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের ওপর ভিত্তি করে ভারতবর্ষ দ্বিখণ্ডিত হয়ে গেল।

খণ্ডিত দেশ:

এমন এক পরিস্থিতিতে পশ্চিমবাঙলার সীমান্তবর্তী জেলার মুসলমানরা ‘পূর্ব পাকিস্তান’-এ বিপুলভাবে চলে যেতে থাকেন। এই ‘Exodus’-রুখতে ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করেছিলেন সৈয়দ বদরুদ্দোজা। দেশভাগ করে বিজন বিভূঁইয়ে উদ্বাস্তু হওয়ার চেয়ে জন্মভূমিতে বসবাসের ওপর অপরিসীম গুরুত্ব আরোপ করেন তিনি। শুধু তাই নয় মহা বাগ্মী সৈয়দ বদরুদ্দোজা, পশ্চিমবঙ্গীয় হতচকিত রাজনৈতিক আশা ভঙ্গে’র বেদনায় মুহ্যমান মুসলিমদের আঞ্চলিক রাজনৈতিতে আগ্রহী হয়ে ওঠার জন্য উত্‍সাহিত করেন।
দেশ বিভাগের পর মুসলমানরা যখন দিশেহারা হয়ে পড়েছে, তেমন সময়ে মুসলমানদের সামনে তিনি হাজির হয়েছেন ‘আশার প্রতীক’ হিসাবে। তিনি নিরন্তর প্রচার করে চলেছেন, ‘স্বদেশের ধুলি মাটি অনেক বেশি পবিত্র, তারা যেন দেশত্যাগ না করেন।’ দেশ বিভাগের জন্য তিনি কংগ্রেস-কে দায়ী করেন। কংগ্রেসের চূড়ান্ত দাপটের মধ্যেও মুসলমানদের মধ্যে কংগ্রেস বিরোধী রাজনীতির বীজ বপন করেন একজন নির্ভীক মানুষ, তিনিই হচ্ছেন সৈয়দ বদরুদ্দোজা। হতাশাগ্রস্ত মুসলমানদের মন থেকে ‘মাইনরিটি কমপ্লেক্স’ দূর করতে বরাবর সচেস্ট ছিলেন। উচ্চশিক্ষিত, বহুভাষাবিদ, অসাধারণ বাগ্মী এই মানুষটি পশ্চিমবাঙলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে গিয়েও দেশ-ভাগ জনিত পরিস্থিতি থেকে উদ্ভূত নানান সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করেছেন। সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। দুর্বলতমের পাশে থেকেছেন।
স্বাধীনোত্তর পশ্চিমবাংলায় মুসলমানদের প্রতি অবিচার আর বৈষম্যের কঠোর সমালোচক ছিলেন তিনি। ব্যক্তি জীবনেও তিনি রাষ্ট্রযন্ত্রের দ্বারা নির্যাতিত হন, কারারুদ্ধ হন। তাঁর কয়েকজন রাজনৈতিক সহযোগীকেও কারারুদ্ধ করা হয়। কিন্তু তিনি হতাশা বা নৈরাশ্যের মধ্যেও হতচকিত জনগণকে নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষমতা রাখতেন। উচ্চারণ করতেন, মহানবীর সেই কালজয়ী বাণী, ‘হুব্বুল ওয়াতান মিনাল ইমান’- ‘দেশপ্রেম ইমানের অঙ্গ’। মুর্শিদাবাদ জেলার প্রত্যন্ত এলাকার কোন গঞ্জ-কে কেন্দ্র করে জন সমাবেশে প্রায়শঃ একথা বলতেন।

শুধু রাজনৈতিক বা বিধানসভা আর লোকসভার সদস্য হিসাবে তাঁর নির্বাচন কেন্দ্রে বক্তৃতা করতে বা রাজনৈতিক কার্যাদিতে জড়িত থাকতেন তা নয়। বহু ক্ষেত্রে তিনি জেলার বিভিন্ন প্রান্তে ‘মিলাদ-উন-নবী’র মতো মহতী আর পবিত্র অনুষ্ঠানে ইসলামধর্ম আর মহানবী হজরত মোহম্মদ (সাঃ) সম্পর্কে তুলনারহিত মর্মস্পর্শী আলোচনা করতেন। বস্তুত হতাশাগ্রস্ত একটি জনগোষ্ঠীকে তিনি মর্যাদার সন্ধানে উদ্বুদ্ধ করেন। সেই সময় আরও কিছু কিছু রাজনৈতিক কর্মী বা ধর্মীয় আলোচক ছিলেন কিন্তু তাদের মধ্যে কোনো নির্দিষ্ট, সদর্থে রাজনৈতিক আদর্শ ছিল না, উদ্বুদ্ধ বা অনুপ্রাণিত করার গভীর কোন উপলব্দী ছিল না। ব্যতিক্রম ছিলেন মওলানা অধ্যাপক আবু তাহের(কলকাতা), তিনি ‘মাল্টার বন্দী’র রচয়িতা। মওলানা আবু তাহের (বর্ধমান), মওতলানা রফিকুল হাসান (সম্পাদক: কোরান প্রচার)। এই তিনজন ইসলাম ধর্মবেত্তার সঙ্গে পশ্চিমবাঙলার বিভিন্ন প্রান্তে ইসলামী ধর্মসভায় সৈয়দ বদরুদ্দোজা অংশ গ্রহণ করতেন। বস্তুতঃ এই সভাগুলো বিভাগোত্তর পশ্চিমবাঙলার প্রায় পরিত্যক্ত মুসলমানদের আত্মবিশ্বাস জোগাতে ব্যাপক সাহায্য করেছিল। বিভিন্ন সভায় তিনি এম. এন. রায়ের (Radical Humanist) উদ্ধৃতি দিতেন এইভাবে – ‘ইসলামের অসামান্য সাফল্যের কারণ হল তার বিপ্লবী চরিত্র ও হতাশাজনক পরিস্থিতিতে নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষমতা।’ (সূত্র: এম. এন. রায়, ‘The Historical Role of Islam’ বঙ্গানুবাদ ইসলাম ধর্মের ঐতিহাসিক ভূমিকা’ – অনুবাদ: শঙ্কর ঘোষ, ভূমিকা, পৃষ্ঠা: ৭) এইভাবে তার সমর্থক বর্গকে উত্‍সাহিত করতেন।

শতবর্ষ নীরবে অতিক্রান্ত

‘এ রকম এক আদর্শবাদী, নির্ভীক, নির্লোভ রাজনীতি নিঃসন্দেহে আমাদের গর্ব। মুর্শিদাবাদের সুসন্তান। এক অনুকরণীয় ব্যক্তিত্ব। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য…এক ব্যতিক্রম চরিত্রের রাজনীতিবিদের জন্ম শতবর্ষ নীরবে অতিক্রান্ত হয়ে গেছে। কেউ আমরা টের-ও পাই নি।’ [‘বোধোদয় পাক্ষিক সংবাদ পত্র; ২২ ডিসেম্বর, ২০১৭; মন্তব্য: বিপ্লব বিশ্বাস।] এই যন্ত্রণা ক্লিষ্ট আর্তনাদ উপশমের উপায় কি বলুন তো! এই মহাজীবনের অধিকারীর স্মৃতিতে বাঁচিয়ে রাখা।

সৈয়দ বদরুদ্দোজা তাঁর ব্যক্তিগত রাজনৈতিক জীবন তৈরী করার জন্য মুর্শিদাবাদে আসেন নি। মুর্শিদাবাদ জেলার বহু বিশিষ্ট নেতা (বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের) তাঁর নির্দেশিত পথ ধরেই রাজনীতিতে এসেছিলেন। মুর্শিদাবাদ জেলার মুসলমানদের রাজনীতি মনস্ক করে তোলার ক্ষেত্রে সৈয়দ বদরুদ্দোজার অবদান অতুলনীয়। বিশিষ্ট আইনজীবী শশাঙ্ক শেখর সান্যাল, ড. নলিনাক্ষ সান্যাল এবং বৈপ্লবিক সমাজতন্ত্রী নেতা ত্রিদিব চৌধুরীর সঙ্গে তাঁর রাজনৈতিক সম্পর্ক ছিল গভীর। জেলার বহুস্থানে তারা শাসকদল কংগ্রেসের ভ্রষ্টাচার আর দুর্নীতি সম্পর্কে বক্তব্য রেখেছেন। শৈলেন অধিকারী এবং রাজসিংহ দুগার বদরুদ্দোজার গুনাগ্রাহী ছিলেন।

১৯৫২ সালের প্রথম সাধারণ নির্বাচনে রাণীনগর বিধানসভা কেন্দ্রে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে সৈয়দ বদরুদ্দোজা সফল হন নি কিন্তু ১৯৫৭ সালে আলোচ্য কেন্দ্র থেকে হাসিনা মর্শেদকে হারিয়ে বিজয়ী হয়েছিলেন। ১৯৬২ তে রাণীনগর বিধাসভা এবং মুর্শিদাবাদ লোকসভা কেন্দ্রে নির্বাচিত হন। ১৯৬৭ তে পুনরায় মুর্শিদাবাদ লোকসভা কেন্দ্র থেকে সফল হয়েছিলেন। ১৯৭১ এ ‘মুসলিম লীগের’ মওলানা আবু তালির চৌধুরীর কাছে পরাজিত হন। জনাব চৌধুরী প্রথম অধিবেশনে অংশ নেওয়ার পরেই মারা যান। অসুস্থতার কারণে সৈয়দ বদরুদ্দোজা প্রতিদ্বন্দ্বিতা (উপনির্বাচন) করেন নি। ১৯৭১ সালের লোকসভার নির্বাচনে মুর্শিদাবাদ কেন্দ্রের নির্বাচক মণ্ডলীর’ সুবুদ্ধির পরিচয় দেয়নি। কেননা সৈয়দ বদরুদ্দোজা ছিলেন পরাক্রম শাস্ত্রী সাংসদ এবং বিভাগোত্তর পশ্চিমবাঙলার নির্যাতিত মুসলমানদের ‘সেভিয়ার’। বাঙালি মুসলমানদের ‘রাজনৈতিক অভিভাবক’। অধ্যাপক হুমায়ুন কবির ব্যতিরেকে এমন ‘আইকনিক’ – রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব আর কেউ ছিলেন না। উপরন্তু মুসলিমলীগের রাজনীতি সংখ্যাগরিষ্ঠ জনমানসে বিশেষ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। মাথায় রাখা দরকার সংখ্যাগরিষ্ঠের সাম্প্রদায়িকতা সংখ্যালঘিষ্ঠের সাম্প্রদায়িকতা থেকে বহুগুণে ধ্বংসাত্মক আর শক্তিশালী সংখ্যাগরিষ্ঠদের সাম্প্রদায়িকতাবাদী রাজনীতি মুসলমানদের অস্তিত্ব-কেই ধ্বংস করে দেবার ক্ষমতা রাখে। জওহরলাল নেহরু একথা স্পষ্ট করে লিখেছিলেন। এর সত্যতা একাধিকবার প্রমানিত হয়েছে।

বিভাগোত্তর মুর্শিদাবাদ জেলার বিস্তর ‘ইউনিয়ন বোর্ড’ এর প্রেসিডেন্ট বর্গ ১৯৫২ সালের নির্বাচনে সৈয়দ বদরুদ্দোজার সহযোগী হিসাবে ক্রিয়াশীল ছিলেন। সেই সময়কালিন নির্বাচকমণ্ডলী তাদের ‘প্রকৃত রাজনৈতিক বন্ধুকে’ চিনতে অপারগ হয়েছেন। মাত্র পাঁচ বছর (১৯৫৭) পরেই সৈয়দ বদরুদ্দোজা মুর্শিদাবাদ তথা পশ্চিমবাঙলার মুসলমানদের আত্মবিশ্বাস আর মর্যাদার প্রতীক হয়ে ওঠেন।

অনুগামী বর্গ:

পশ্চিমবাঙলা তথা মুর্শিদাবাদ জেলায় তাঁর অজস্র অনুগামী ছিলেন। ইতিহাসের খাতিরেই তাদের নাম-উল্লেখ জরুরী।
ড. খালিলুর রহমান, আজিজুর রহমান, মৌলভী ইয়াকুব আলী, মওলানা খায়রুল্লাহ, আইনুদ্দিন সরকার, আব্দুল বারি বিশ্বাস, আলী আহমদ (মোক্তার), সাজ্জাদ হোসেন (মোক্তার) ইসরাইল হক, ব্রজেন নন্দী, আব্দুল খালেক মোল্লাহ, ডা: মহতাবউদ্দিন, ডা: আব্দুল কাদের, আফতাব উদ্দিন বিশ্বাস, আশরাফুল মিঞ্চা, তোরাব উদ্দিন, জহিরুদ্দিন সরকার, মনিরুদ্দিন সরকার, ফহিমউদ্দিন আহমদ, আব্দুর রহমান, মওলনা সৈয়দ আব্দুল কাশেম প্রমুখ বিশিষ্ট ব্যক্তি সৈয়দ বদরুদ্দোজার সহযোগী ছিলেন। এদের মধ্যে আজিজুর রহমান এবং আব্দুল বারি বিশ্বাস জেলার কংগ্রেস রাজনিতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন।

১৯৫২ সালেই লুত্‍ফল হক সৈয়দ বদরুদ্দোজার সঙ্গে পরিচিত হয়ে ওঠেন। যদিও লুত্‍ফল হক পরবর্তী সময়ে কংগ্রেসের বিরুদ্ধে যোগদান করেন। সেই সময় আব্দুস সত্তার ও কংগ্রেসের বিরুদ্ধ গোষ্ঠীর লোক ছিলেন। জনাব আব্দুস সত্তার সৈয়দ বদরুদ্দোজার প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। জঙ্গীপুরে আব্দুল হক (নির্দল, পরবর্তীকালে আর এস পি), ফারাক্কার টিএম নুরুব্বী (বাংলা কংগ্রেস) সূতীতে শীস মোহাম্মদ (আর এস পি) রাজনীতির ক্ষেত্রে সৈয়দ বদরুদ্দোজার নির্বাচনী প্রচারের মারফত উপকৃত হয়েছেন। এরা সেসব কথা কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্বীকার করে থাকেন। ১৯৬৭ সালে প্রথম ‘যুক্তরাষ্ট্র’ সরকার গঠনে তাঁর অবদান অনস্বীকার্য। ১৯৬৯ এর নির্বাচনেও তিনি মুসলিম জনমতকে যুক্তফ্রন্টের পক্ষে নিয়ে গেছিলেন অসাধারণ দক্ষতা আর তত্‍পরতায়। ব্রিগেডের ‘বিজয় উত্‍সব’-এ তিনি অন্যতম প্রধান বক্তা। সেই বিজয় উত্‍সব ছিল জনসমুদ্রের মতো।

রাজনৈতিক সমাজ কর্মীর উত্থান

১৯৬২ তে রাণীনগর বিধান সভার উপনির্বাচনে নওয়াব সৈয়দ জানি মির্জা; সৈয়দ বদরুদ্দোজার মনোনীত প্রার্থী হিসাবে বিজয়ী হন। এই উপনির্বাচনে ১৯৭২ সাল থেকে ১৯৯১ এর ২৮ ফেব্রুয়ারি তক পশ্চিমবাঙলা কংগ্রেসে অপ্রতিদ্বন্দ্বী নেতা’ জনাব আব্দুস সাত্তার পারজিত হন। নওয়াব জানি মির্জা ‘রাজনৈতিক পিতা’ ছিলেন সৈয়দ বদরুদ্দোজা। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য সৈয়দ জানি মির্জা ১৯৮৭-র নির্বাচনে সোশালিস্ট পার্টি প্রার্থী হিসাবে ভগবানগোলায় জিতেছিলেন। সেই নির্বাচনের প্রচারেও জানি মির্জা সৈয়দ বদরুদ্দোজার প্রসঙ্গ বারে বারে তুলেছেন। সেই মহান নেতার মৃত্যুর তের বছর বাদেও তিনি নির্বাচক মণ্ডলীর স্মৃতিতে অমলিন থেকেছেন। ১৯২৬ সালে আব্দুল বারি বিশ্বাস (আইনজীবি) বদরুদ্দোজা মনোনীত প্রার্থী হিসাবেই জলঙ্গী কেন্দ্র থেকে নির্বাচিত হন। অপেক্ষাকৃত প্রবীন আইনজীবী জনাব আবুল হোসেন (১৯৬২ র উপনির্বাচনে ফারাক্কার বিধায়ক নির্বাচিত হন) সৈয়দ বদরুদ্দোজা সঙ্গে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রেখেছিলেন। জনাব হোসেন, আব্দুস সাত্তারকে সৈয়দ বদরুদ্দোজার সঙ্গে পরিচিত করে তোলেন। জনাব আব্দুস সাত্তার সৈয়দ বদরুদ্দোজার রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার ফসল পরবর্তীতে তিনি কংগ্রেস যোগ দেন। দেশ বিভাগের পঁচিশ বছরের মধ্যে পশ্চিমবাঙলায় মুসলমান সমাজ থেকে বেশ কিছু সংখ্যক রাজনৈতিক ও সমাজকর্মীর উত্থান লক্ষ্য করা গেল। এরা অধিকাংশ ক্ষেত্রে সৈয়দ বদরুদ্দোজার দ্বারা অনুপ্রাণিত ছিলেন। সোজাসুজি বলতে কি বিশেষত মুর্শিদাবাদের মুসলমানদের তিনি রাজনীতি মনস্ক করে তোলেন।

পশ্চিমবাঙলার রাজনীতির গতি প্রকৃতি ও সৈয়দবদরুদ্দোজা

১৯৬২, ১৯৬৪, ১৯৬৫, ১৯৬৭ এবং ১৯৬৯ সাল পশ্চিমবাঙলার রাজনীতিতে মুসলমানদের চিন্তা চেতনা আর গতি প্রকৃতি নির্ধারণ করে- সেই বাবদে সৈয়দ বদরুদ্দোজার ভূমিকা ছিল অতুলনীয়, অনবদ্য আর চমকপ্রদ। খোলসা করা যাক: ১৯৬২ সালে চিন-ভারত সীমান্ত সংঘর্ষকালে বিস্তর কমিউনিস্ট নেতাকে ‘চিনের দালাল’ হিসেবে পশ্চিমবাঙলার সরকার গ্রেপ্তার করে। চিনের সঙ্গে পাকিস্তানের রাজনৈতিক সম্পর্ক সে সময় বন্ধুত্ব সুলভ হওয়ায় বহু পশ্চিমবাঙলার সম্মাননীয় মুসলমান ব্যক্তিকেও গ্রেপ্তার করে। কমিউনিস্ট নেতৃবর্গ আর মুসলমান ব্যক্তিকেও গ্রেপ্তার করে। কমিউনিস্ট নেতৃবর্গ আর মুসলমান গুরুত্ববাহী ব্যক্তিদের সঙ্গে কারান্তরালে রাজনৈতিক পরিচয় আর বন্ধুত্বলাভের সুযোগ তৈরী হয়ে যায়। ১৯৬৪ সালের কলকাতার ‘মহাদাঙ্গা’র প্রেক্ষিতে বামপন্থীদের সেক্যুলার মনোভাব মুসলমানদের মনে কিছুটা আশার সঞ্চার করেছিল। এক্ষেত্রে সোমনাথ লাহিড়ী, ইন্দ্রজিত্‍ গুপ্ত, ভুপেশ গুপ্ত, হীরেন মুখার্জী, রনেন সেনের মত মানুষ ‘সেক্যুলার অ্যাটিউচুড়ে’র পরিয় দিয়েছিলেন। ডা: এ এন ও গণি, আলহাজ্ব মোল্লাজান এবং সৈয়দ বদরুদ্দোজা দাঙ্গা বিধস্ত পরিস্থিতির বিরুদ্ধে রাজনৈতিক শালাপরামর্শ জারি রাখেন, প্রতিবাদ করেন। দাঙ্গা- পীড়িতদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে সৈয়দ বদরুদ্দোজা ভূমিকা ছিল বীরোচিত। সৈয়দ বদরুদ্দোজা কেন্দ্রীয় মন্ত্রী গুল জারিলাল নন্দকে মুসলমান অধ্যুষিত দাঙ্গা বিধস্ত এলাকা পুরো সরোজমিনে দেখিয়ে দেন। প্রসাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য চাপ সৃষ্টি করেন। এই ‘কওম দরদী’ নেতা চূড়ান্ত একপেশে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার স্বরূপ সম্পর্কে সর্বভারতীয় রাজ নৈতিক বন্ধুদের ওয়াকিবহাল করেছিলেন। লোকসভার অধিবেশনে ‘ঝড়’ তুলে দিয়েছিলেন। তাঁর অসাধারণ ইংরিজি বক্তৃতাটির পূর্ণ বঙ্গানুবাদ (তরজমা) কলকাতা ‘পয়গাম’ নামক একটি সংবাদপত্র গভীর গুরুত্ব সহকারে প্রকাশ করো। এই অনিন্দ্যসুন্দর ‘তরজমা’ টি করেছিলেন প্রবীর আচার্য নামীয় একজন তুখোড় সাংবাদিক। সংবাদ পত্রটির সম্পাদক ছিলেন আব্দুল জলিল তরফদার। এই সংবাদ পত্রটি বদরুদ্দোজার প্রতিটি বক্তৃতা মর্যাদার সঙ্গে প্রকাশ করত। আমার কলেজ মওলানা (আজাদ কলেজ) ও বিশ্ববিদ্যালয়ের (কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়) ছাত্রজীবনে উক্ত পত্রিকায় সাংবাদিকতার চাকরি করার সুবাদে সৈয়দ বদরুদ্দোজার বক্তৃতার নানান মন্তব্যের অনুবাদ করার সৌভাগ্য হয়েছে। আলোচনাগুলোর মর্মকথা ছিল ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের বৈষম্য সম্পর্কিত আর অভাব অভিযোগ সংক্রান্ত। লোকসভায় প্রদত্ত বক্তৃতাটির সারমর্ম ছিল এই রকমঃ মুসলমানরা যথার্থ স্বাধীনতা সংগ্রামী আর দেশপ্রেমী হওয়া সত্ত্বেও ‘কোতল’ হয়ে যাচ্ছেন, বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন, জীবন বিকাশের ক্ষেত্রগুলো রুদ্ধ করে দেওয়া হচ্ছে। তিনি ‘শুভ শক্তি’ র সহযোগীতা প্রত্যাশা করেছিলেন। ১৯৬৪ সালের কলকাতার সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা তাঁকে ভয়ানকভাবে বিচলিত করে। তাঁর এই দাঙ্গা সম্পর্কে বিশ্লেষণ ছিল; কলকাতা ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের মুসলমানরা প্রতিকূলে থেকেও আর্থিক ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠার যে চেষ্টা করেছিলেন, তাঁকে ভেঙ্গে গুড়িয়ে দেওয়ার জন্য এই দাঙ্গাটি সংঘটিত হয়েছিল। বাপন্থী নেতাদের মধ্যে যারা উদার ও স্বচ্ছ চিন্তার মানুষ ছিলেন, তাঁদের সঙ্গে সৈয়দ বদরুদ্দোজা সংযোগ স্থাপন করেন। কমিউনিস্টদের সঙ্গে এই সেতু নির্মাণের কাজে এই বর্ষীয়ান মানুষটি অশেষ তত্‍পরতার পরিচয় দিয়েছিলেন। ১৯৬৫-র ‘পাক-ভারত যুদ্ধে’ ভারত রক্ষা আইনে নির্বিচারে মুসলমানদের গ্রেপ্তার করেছে। সৈয়দ বদরুদ্দোজাও কারারুদ্ধ হন।১৯৬৭ সালে বিরোধী দুই ফ্রন্টকে ঐক্যবদ্ধ করে রাজ্যে প্রথম অকংগ্রেস সরকার প্রতিষ্ঠার জন্য অধ্যাপক হুমায়ুন কবির সৈয়দ বদরুদ্দোজার ভূমিকা ছিল দুর্দমনীয় এবং অপ্রতিরোধ্য। ১৯৬৪ সালের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা অধ্যাপক কবিরকেও বিমর্ষ করে তুলেছিল। সে বাদে বর্ষীয়ান সাংবাদিক সুখরঞ্জন সেনগুপ্তের বিস্তৃত বিশ্বাসযোগ্য বর্ণনা রয়েছে। কিভাবে বাঙালি মুসলমানদের ‘রাজনৈতিক চেতনার উন্মেষ’ সম্ভব হল তার বিশ্লেষণও করেছেন এই বর্ষীয়ান প্রখ্যাত সাংবাদিক। ১৯৬৯ সালে কংগ্রেসের ভরাডুবির কৃতিত্বের মূল দাবিদার হচ্ছেন সৈয়দ বদরুদ্দোজা এবং দার্শনিক পাণ্ডিত্য রাষ্ট্রবেত্তা অধ্যাপক হুমায়ুন কবির। মুসলমানদের সঙ্গে বামপন্থীদের যে সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল সে তো সৈয়দ বদরুদ্দোজার রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার ফসল।

‘গর্দিশৌ কা দি’

সৈয়দ বদরুদ্দোজা ১৯৫২ সাল থেকে ১৯৬৭-৬৯ সাল তক একটি রাজনৈতিক পরিবর্তনের প্রেক্ষাপট তৈরী করেছিলেন। তাঁর পুরো রাজনৈতিক জীবন ছিল কংগ্রেস বিরোধী। তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষ কংগ্রেস সম্পর্কে তিনি বীতশ্রদ্ধ ছিলেন। তাঁর রাজনৈতিক কেন্দ্র ছিল জেলা মুর্শিদাবাদ। কিন্তু তামাম পশ্চিমবাঙলার ‘মজলুম’ সংখ্যালঘিষ্ঠ সমাজ তাঁকে পরমশ্রদ্ধার সঙ্গে বিশ্বাস করতেন। ১৯৬৫ সালে আবার মুসলমানদের কাছে ‘গর্দিশৌ কা দি’ হিসাবে হাজির হল। আধা-ফ্যাসিস্ট রাজত্ব কায়েম করেছিল তত্‍কালীন কংগ্রেসী রাজ্য সরকার। আত্মরক্ষার প্রয়োজনে রক্ষিত বন্ধুক পর্যন্ত মুসলমানদের কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া হল। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বিজয় সিং নাহার ‘সন্দেহভাজন’ কিছু কিছু শিক্ষিত মুসলমানকে ডি আই আর-এ বন্দী করে জেলে পাঠিয়ে দিলেন। এই অপকর্মটির নিশানা হলেন সৈয়দ বদরুদ্দোজা, নিখাদ ভদ্র সজ্জন আজিজ্জুর রহমান, ডা: গোলাম ইয়াজদানি প্রমুখ।
‘কওম দরদী’ নির্ভীক নেতা সৈয়দ বদরুদ্দোজা দীর্ঘদিন কারারুদ্ধ থাকার ফলে অসুস্থ অবস্থায় মুক্তিপান। বর্ষীয়ান এই জননেতার শরীর ভেঙে তছনছ হয়ে যায়। সৈয়দ বদরুদ্দোজার একদা একান্ত স্নেহভাজন ভ্রাতৃপতিম আজিজ্জুর রহমান ‘বন্ড’ দিয়ে জেল থেকে বেরিয়ে এসে কংগ্রেসে যোগ দেন। ‘দেশদ্রোহী’ হিসাবে চিহ্নিত সৈয়দ বদরুদ্দোজা, আজিজ্জুর রহমান আর ডা: গোলাম ইয়াজদানি দশকের পর দশক রাজনীতির ক্ষেত্রে যে আধিপত্য বিস্তার করেন – এটাই তাঁদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয় অবিচার আর সন্ত্রাসের জোয়ার। এই সব অবিচার পশ্চিমবাঙলার মুসলমানদের মনে বিখুদ্ধ মানসের জন্ম দেয়। যতদিন তক সৈয়দ বদরুদ্দোজার সংসদীয় জীবন ছিল, তিনি অন্যায়-অবিচারের গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে প্রতিবাদ করেছেন। সৈয়দ বদরুদ্দোজার নিরন্তর প্রচারের ফলে মুসলমানরা নিজেদের গুরুত্বটি উপলব্ধি করতে পারে এবং ব্যাপকভাবে রাজনীতিতে অংশ গ্রহণ করে।

বন্ধু কাজী নজরুল ইসলামের জন্য

সৈয়দ বদরুদ্দোজার জীবনের একটি ভিন্নতর বিষয় নিয়ে দু’চার কথা বলা যাক। কবি কাজী নজরুল ইসলামের সঙ্গে সৈয়দ বদরুদ্দোজার বন্ধুত্ব সম্পর্ক ছিল। কবির দুর্দিনে তাঁর সুসময়ের বন্ধুরা কেউ পাশে ছিলেন না। কিন্তু সৈয়দ বদরুদ্দোজা কবিকে পরিত্যাগ করেন নি। পুরো বাঙালি জাতির পক্ষ থেকে ১৯২৯ সালের ১৫ ডিসেম্বর কলকাতার অ্যালবার্ট হলে কবিকে সংবর্ধনা সভার অন্যতম উদ্যোক্তা ছিলেন সৈয়দ বদরুদ্দোজা। ‘সওগাত’ পত্রিকার দপ্তরে বসে কাজী নজরুল ইসলামকে সংবর্ধিত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। আহ্বান কারীদের মধ্যে এ কে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, সৈয়দ বদরুদ্দোজা, জলধর সেন, দিলীপ কুমার রায়, দীনেশ রঞ্জন দাশ, প্রেমেন্দ্র মিত্র, এস ওয়াজেদ আলি, আসাদুজ্জামান, ডা: আর আহমদ, সৈয়দ জালাল উদ্দিন প্রমুখ বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ। এই সভায় সভাপতিত্ব করেন আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়। ভাষণ দেন সুভাষচন্দ্র বসু। এটি বিশাল একটি ঐতিহাসিক ঘটনা যার প্রত্যক্ষ উদ্যোগী ছিলেন সৈয়দ বদরুদ্দোজা।

মহানবীর জীবনীকার

সৈয়দ বদরুদ্দোজা জীবনের শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে লিখেছেন ‘হজরত মোহাম্মদ (দঃ) তাঁহার শিক্ষা ও অবদান’। তাঁর গুণগ্রাহীরা এই গ্রন্থ পেয়ে গর্বিত হয়েছিলেন। ইংরেজি অনুবাদের পরিকল্পনাও ব্যক্ত করেছিলেন – সেটি তাঁর মৃত্যুর কারণে আর হয়ে ওঠেনি। বর্ধমান থেকে উত্থিত তুখোড় বক্তা এবং ইসলামি ‘তহজীব’ এবং ‘তমুদ্দন’ (ধর্ম ও সংস্কৃতি) ভিত্তিক প্রবন্ধকার আবু তাহের এর ‘সত্যের আলো’ (১৩৬৪, ফাল্গুন মাস) নামক গ্রন্থের ভূমিকা (৩ পৃঃ) সৈয়দ বদরুদ্দোজা লিখেছেন, ‘তাঁর এই পুস্তিকা মুসলমানগণের বিশেষ করিয়া মুসলিম যুবকদের যে প্রকৃত কল্যাণ সাধন করিবে, সে বিষয়ে আমার আদৌ সন্দেহ নাই।’ প্রথম প্রবন্ধটি ছিল – ”হে মুসলিম, জেগে ওঠো’ প্রকাশিত হয়েছিল ‘অর্ধ সাপ্তাহিক ‘পয়গাম’ পত্রিকায় (কলকাতা) ইংরেজি ভাষায় লিখিত তাঁর দুটি মুল্যবান গ্রন্থ রয়েছে। ১. Indian Secularism : Text of speech’ এবং
২. ‘Select writings and speeches of Syed Badrudduja ইংলিশ ‘কেতাব’ দুটিতে তাঁর ‘রাষ্ট্র চিন্তার’ প্রকাশ লক্ষ্যযোগ্য হয়ে উঠেছে।

শেষের দিনগুলো

শেষ জীবনে সৈয়দ বদরুদ্দোজা নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েছিলেন। কলকাতার তালতলা অঞ্চলের ১৯ নম্বর ‘ইউরোপিয়ান অ্যায়াসাইলাম লেন’-এর বাসভবনে ছিলেন তাঁর স্ত্রী এবং কন্যা। জীবনের শেষ দিন গুলোতে যত্‍কিঞ্চিত্‍ আর্থিক অসুবিধার সম্মুখীন হয়েছিলেন। এই সময়ে তালতলা লেনের জনাব জাফর আলি নামক এক সহৃদয় ব্যক্তি তাঁর সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতেন।

কেউ ভোলে কেউ ভোলে না

সৈয়দ বদরুদ্দোজার মৃত্যুর (১৯৭৪ সালের ১৮ নভেম্বর) পর তাঁর স্মৃতি রক্ষার্থে কোন ব্যবস্থা হয়নি। বিভাগ পরবর্তী পশ্চিমবাঙলার সাহিত্য সমাজে সুপরিচিত লেখক এবং ‘হরফ প্রকাশনী’ র কর্ণধার এবং ‘জাগরণ’ ও মাসিক ‘কাফেলা’ পত্রিকার সম্পাদক আবদুল আজীজ আল্-আমান কলকাতা কর্পোরেশনের কর্তাব্যক্তিদের চাপ দিয়ে তালতলা অঞ্চলে ‘সৈয়দ বদরুদ্দোজা চিলড্রেন পার্ক’ আর চ্যারিটেবিল সোসাইটি না করলে, এতদিনে সৈয়দ বদরুদ্দোজা বিস্মৃত হয়ে যেতেন। বিস্ময়ের কথা এই যে তিনি ১৯৬৭ এবং ১৯৬৯ -এ যুক্তফ্রন্ট সরকার গঠনে প্রত্যক্ষ ভূমিকা নিয়েছিলেন, এতদসত্ত্বেও ‘বামফ্রন্ট সরকার’ তাদের ৩৩ বছরের জামানায় তাঁর স্মৃতিরক্ষার জন্য কোন আগ্রহ প্রকাশ করেনি। স্মর্তব্য বিভাগ পূর্ববর্তী অখণ্ড বাঙলার ‘শ্যামা-হক’ মন্ত্রী সভার অন্যতম ‘কিং মেকার’ ছিলেন সৈয়দ বদরুদ্দোজা। তাঁর স্মৃতি দীর্ঘ দিন বেঁচে থাকুক।

পাদটীকা:

(১) ১৯৪১ এর ডিসেম্বর মাসে ‘শেরে বঙ্গাল’ জনাব ফজলুল হকের নেতৃত্বে দ্বিতীয়বার বাংলার মন্ত্রিসভা গঠিত হলে নওয়াব ওয়াশিফ আলি মির্জা ‘হিন্দু মুসলিম ইউনিটি অ্যাসোসিয়েশন’ পক্ষ থেকে কলকাতায় ১৯৪২ সালে ‘ঐক্য সম্মেলন’ এর আয়জন করে। নওয়াব মির্জা সভাপতিত্ব করে ছিলেন। প্রধান বক্তা ছিলেন মওলানা এ কে ফজলুল হক (শেরে বঙ্গাল)। এই গুরুত্বপূর্ণ মর্যাদাসূচক আলোচনা সভায় স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে, উদাত্ত কণ্ঠে বক্তব্য পেশ করেছিলেন সৈয়দ বদরুদ্দোজা, অন্যান বিশিষ্ট বক্তারা ছিলেন ড. ননিলাহক্ষ সান্যাল, ডা: বিধানচন্দ্র রায়, সৈয়দ নওশের আলি, হেমেন্দ্রপ্রসাদ ঘোষ, সামসুদ্দিন আহমদ, এ কে এম জাকারিয়া এবং দার্শনিক পণ্ডিত প্রবর অধ্যাপক হুমায়ুন কবির।

(২) দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ ‘বেঙ্গল প্যাক্ট’ (১৯২৩ এপ্রিল) নামক ‘হিন্দু মুসলিম চুক্তিনামা’ রচনা করে ‘স্বরাজপার্টি’ ও ‘বঙ্গীয় প্রাদেশিক কমিটি’-কে দিয়ে মঞ্জুর করালেন। কিন্তু নানান অপ্রীতিকর অবস্থার মধ্য দিয়ে তা বাতিল হল। ‘বেঙ্গল প্যাক্ট’ এর কারণে সৈয়দ বদরুদ্দোজা দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জনের বিশেষ ভক্ত হয়ে পড়েন। দেশবন্ধুর স্ত্রী বাসন্তী দেবীকে মায়ের সম্মান প্রদান করতেন। সেই সময়ে সৈয়দ বদরুদ্দোজা তরতাজা যুবক।

(৩) সুভাষচন্দ্র বসুর উদার অসাম্প্রদায়িক মানবতাবাদী চিন্তাধারার জন্য সৈয়দ বদরুদ্দোজা তাঁকে অতলান্তিক শ্রদ্ধা নিবেদন করতেন। ওপরোক্ত দুই বাঙালি মহাজীবন তরুণ বদরুদ্দোজাকে বিশেষ স্নেহ করতেন। রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত যুবা বদরুদ্দোজার বক্তৃতায় মুগ্ধ হয়েছিলেন। দেশবন্ধু আর নেতাজী প্রসঙ্গ তিনি নিজেই বহু নির্বাচনী সভায় আবেগ মথিত কণ্ঠে উচ্চারণ করতেন। নেতাজী সুভাষের একটি বাণী তিনি এই সভাগুলতে, মুর্শিদাবাদের বহু জোন ক্ষেত্রে স্পষ্ট বলতেন, ‘ইত্তেহাদ ইত্তেমাদ কুরবানী’। ঐক্য ভ্রাতৃত্ব ত্যাগ চাই দেশের দশের কল্যাণের জন্য। তাঁর শ্রোতা সহযোগী বন্ধুবর্গ সমর্থক-সজ্জন উচ্ছ্বাসে উদ্বেল হয়ে পড়তেন।

অশ্রুতপূর্ব প্রায় বেনজির বাগ্মিতা ঠিক যেন আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন রাজনৈতিক সংগঠক, দার্শনিক এম এন রায়। এমন মানুষটিকে আমরা মনে রাখিনি, একি কম বেদনা আর ক্ষোভের বিষয়।

(৪) প্রায়ত আবুল মনসুর আহমদ (১৮৯৮-১৯৭৯ এর ১৮ মার্চ) এই উপমহাদেশের প্রখ্যাত সাহিত্যিক, সাংবাদিক এবং রাজনীতি-বেত্তা। বিশ শতকী বাঙলার মুসলমান, বিশেষতঃ প্রথমার্থে; আত্মমর্যাদা আর স্বরূপ সন্ধানের সওয়ালে যে নিরন্তর সংগ্রামে রত ছিল তার বিশদ বর্ণনা আর বিশ্লেষণ আছে তাঁর নির্মিত এক অনবদ্য আত্মজৈবনিক রাজনীতিক ভাষ্য ‘আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর’ নামক গ্রন্থে। সেই ঐতিহাসিক গ্রন্থে জনাব আবুল মনসুর সৈয়দ বদরুদ্দোজার সম্পর্কে গুরুত্ব সহকারে আলোচনা করেছেন। সেই প্রসঙ্গে এসে গেছে নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু, উদার অ-সাম্প্রদায়িক গণতন্ত্রী শরত্‍চন্দ্র বসু, মানবতন্ত্রী এম এন রায় (১৮৮৭, ২১ মার্চ ১৯৫৪ -২৬ মার্চ), আবুল কালাম সামসুদ্দিন (১৮৮৭-১৯৭৮), রচিয়তা ‘অতীত দিনের স্মৃতি’ এবং আবুল হাসিম (বর্ধমান) (জন্ম ২৭ জানুয়ারি, ১৯০৫), রচয়িতা ‘In Retrospection’ বঙ্গানুবাদ : ‘আমার জীবন ও বিভাগপূর্ব বাংলাদেশের রাজনীতি’ অনুবাদক : শাহাবুদ্দিন মহম্মদ আলী)-এর নাম। সৈয়দ বদরুদ্দোজা কত বড় রাজনীতি-বেত্তা এবং বড় হৃদয়ের মানুষ তাঁর প্রমাণ মেলে এই ধরনের মর্যাদাপূর্ণ আলোচনাগুলোতে।

(৫) কিছু স্মৃতি : কিছু কথা, বিশ শতকে তিনের দশকে গোড়ার দিকে একটি ধর্ম সভায় বক্তৃতার জন্য সৈয়দ বদরুদ্দোজা আমন্ত্রিত ছিলেন। সভাপতিত্ব করছিলেন ‘নোবেল লরিয়েট’, সি ভি রমণ। বিজ্ঞানী মিঃ রমণকে পূর্ব নির্ধারিত অন্য একটি অনুষ্ঠানে উপস্থিত হতে হত। শ্রী রমণ, সৈয়দ বদরুদ্দোজাকে বক্তৃতাটি ‘Brief’ করতে বলেন, বদরুদ্দোজা বলেন, ‘স্যার অবশ্য ‘Brief’ বলব। আরও বললেন, একেবারে Reasonably brief বলব। বক্তৃতা শুরু করলেন। বেশ কয়েকবার সৈয়দ বদরুদ্দোজা, মহাবিজ্ঞানী রমণকে বললেন, ‘Sir Shall I stop? মিঃ রমণ বললেন ‘No Youngman Go on.’ বিজ্ঞানচার্জ আরও বললেন, আমার অন্যত্র যাওয়ার ছিল, কিন্তু এই যুবকের বক্তৃতা আমাকে, ‘আঠার মতো আটকে দিল।’ (Glued)। ‘Glued’ শব্দটি সিভি রমণ ব্যবহার করেছিলেন।

(৬) ১৯৩৭ সালে সাবেক বাঙলার প্রধানমন্ত্রী (Premier) এ কে ফজলুল হক গঠিত ‘মন্ত্রীসভা’-কে সংবর্ধনা দেওয়ার জন্য ১৯৩৮ সালের শুরুতে বিশ্বভারতীতে একটি সমাবেশের ব্যবস্থা করেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। সেই সমাবেশে যুবা সৈয়দ বদরুদ্দোজার অনির্বচনীয় আর অনিন্দসুন্দর বাগ্মিতায় ‘গুরুদেব’ রবীন্দ্রনাথ ‘বিমুগ্ধ’ বিস্ময়ে সৈয়দ বদরুদ্দোজার তারিফ করেন। প্রত্যুত্তরে বদরুদ্দোজা বলেন, ‘আপনি বাঙলা ভাষা ও সাহিত্যের প্রতিূু আপনার সামনে এই অর্বাচীন কি এমন শ্রুতি মধুর শব্দ উচ্চারণ করবে।’ রবীন্দ্রনাথ পরম স্নেহভারে বললেন, ‘বত্‍স। আমি অল্প কিছু আঁকিবুঁকি (Scribble) করতে পারি – কিন্তু এমন সুললিত বক্তব্য রাখতে পারি না। এই প্রতিভা ‘ঈশ্বরের দান’।’ শ্রদ্ধায় সৈয়দ বদরুদ্দোজা মাথা নত করেন। একজন কঠোর ভাবে একেশ্বরবাদী’ তেজি যুবকের পক্ষে এতো এক বিশাল প্রাপ্তি।

(৭) ১৯৩৮ সালে কলকাতার অ্যালবার্ট হলে ‘অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগ’ এর একটি আলোচনাচক্র আমন্ত্রিত বক্তা হিসেবে সৈয়দ বদরুদ্দোজার বক্তৃতা করেছিলেন। এমন সময়ে এই উপমাহাদেশের ‘মুসলিম রাজনীতির’ অনিঃশেষ ক্ষমতা আর দোর্দণ্ড প্রতাপের অধিকারী, মিঃ মুহাম্মদ আলি জিন্নার প্রবেশ। তিনি বদরুদ্দোজার ইংরেজি উচ্চারণ আর উর্দু লব্জ এর ব্যবহার বিমোহিত হয়ে গেলেন। যদিও মিঃ মুহাম্মদ আলি জিন্নাহ উর্দু ভাল জানতেন না। বস্তুতঃ তিনি ইংরেজি ভাষায় বক্তৃতার জন্যই বদরুদ্দোজাকে পরমস্নেহে আলিঙ্গন করেন।

(৮) ১৯৫৩ সালের একেবারে শেষে আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘অল ইন্ডিয়া উলেমা কনফারেন্স’-এ সৈয়দ বদরুদ্দোজা বক্তা হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। তামাম মুসলিম দুলিয়া থেকে আলেমবর্গ, এমন কি আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘বুজর্গ’ রাও হাজির ছিলেন। আগ্রহ উদ্দীপক বিষয় এই যে এই উপমহাদেশের অন্যতম বিশিষ্ট ইসলাম-বেত্তা, ‘তাজ কিরাত উল কোরান’ এর রচয়িতা মওলানা আবুল কালাম আজাদ ও এই মজলিসে উপস্থিত ছিলেন। সৈয়দ বদরুদ্দোজার উপস্থিত পণ্ডিত বর্গের ভাষা অর্থাত্‍ আরবি, ফার্সী, উর্দু এবং ইংরাজি ভাষায় ঝড়ের বেগে বক্তৃতা করেন। বক্তৃতা শেষে মওলানা আজাদ বদরুদ্দোজার বাগ্মিতার অশেষ প্রশংসা করেন। এই বক্তৃতায় দেশ দ্রোহিতার অভিযোগ তুলে ভারত সরকার ‘প্রিভেনশন ডিটেনশন অ্যাক্টে’ সৈয়দ বদরুদ্দোজাকে গ্রেপ্তার করে (১৯৫৪ সালের ১ ফেব্রুয়ারি)। আদালতে মামলা চলাকালীন মহামান্য জর্জ তাঁকে আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য বক্তব্য রাখার সুযোগ দেন। বদরুদ্দোজার দীর্ঘক্ষণ ধরে ইংরেজি ভাষায় দেশপ্রেম এবং সত্‍ নাগরিক হিসাবে তাঁর দায়িত্ব কর্তব্য সম্পর্কে বক্তব্য পেশ করেন। তাঁর বিরুদ্ধে মকাদ্দমাটি শুরু হয়েছিল রাত্রিতে। তিনি যখন বক্তব্য শেষ করলেন তখন গভীর রাত্রি। জর্জ বেকসুর খালাশ-করে দিলেন। বললেন স্বাধীনভাবে বাড়ি চলে যেতে পারেন। কোর্ট এখন তার নিজের কাজটুকু করবে। এই সব ঘটনাকে গল্প বা অতি কথন মনে হতে পারে কিন্তু এগুলো ঐতিহাসিক ‘Fact’।

(৯) জওহরলাল নেহরু প্রয়াণ ১৯৬৪ তে। পার্লামেন্ট তাঁর স্মৃতিচারণ করার সুযোগ পেয়েছিল মাত্র ৭ জন সাংসদ। সৈয়দ বদরুদ্দোজাও এই বিরল সুযোগ পেয়েছিলেন। বিশ্বের তাবত্‍ দেশের প্রথম শ্রেণীর নেতৃবর্গ হাজির। বদরুদ্দোজা যে মর্মস্পর্শী বক্তৃতা দিয়েছিলেন, তা কঠোর ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন নেতৃবর্গকে আবেগে উদ্বেল করে তোলে। অশ্রুসিক্ত হয়ে ওঠেন অনেকেই। তিনি কি ‘মিরাকল’ জানতেন! ইসলাম অবশ্যই ‘মিরাকলে’ বিশ্বাস করে না।

(১০) ১৯৭৩ সালের ৩ সেপ্টেম্বর- এ কলকাতায় নেতাজী রিসার্চ ব্যুরোর উদ্যোগে শরত্‍চন্দ্র বসুর ৮১ তম জন্ম দিন উপলখ্যে একটি আলোচনাচক্রের আয়োজন করা হয়। শরত্‍চন্দ্র বসু, সুভাষচন্দ্র বসুর অগ্রজ। তিনি ‘অখণ্ড বাঙলা’ র জন্য ব্যাপক সওয়াল করে ব্যর্থ হন। সৈয়দ বদরুদ্দোজা, শরত্‍চন্দ্র বসুর সঙ্গে ‘যুক্তবঙ্গের’ আন্দলনে ওতপ্রোত জড়িত ছিলেন। এই স্মরণ সভায় দীর্ঘ বক্তৃতার মারফত শরত্‍চন্দ্র বসুর ‘সেক্যুলার অ্যাটিউচ্যুটে’র পরিচয় তুলে ধরেন। ‘অখণ্ড বাঙলা’ কত জরুরী ছিল তার পক্ষে অশেষ যুক্তির উত্থান করেন। সাত চল্লিশৌত্তর উভয় বাঙলায় যে রক্তপাত হয়েছে তার বর্ণনা শ্রোতা শিহরিত করে। প্রখ্যাত সাংবাদিক বিবেকানন্দ মুখার্জী এই ‘সেমিনারে’ উপস্থিত ছিলেন। তিনি মন্তব্য করেছিলেন, স্বাধীনতা সংগ্রামী বিপিনচন্দ্র পালের পরে বাঙলা ভাষায় এমন সুখশ্রাব্য বক্তৃতা শুনব তা ভাবিনি। সৈয়দ বদরুদ্দোজার যাদু স্পর্শী বক্তৃতায় মুগ্ধ হওয়া ছাড়া গত্যন্তর থাকেনা। বিবেকানন্দ মুখার্জী সৈয়দ বদরুদ্দোজার রাজনীতির সঙ্গে সহমত পোষণ করতেন না।
মার্কসবাদী জননেতা, তাত্ত্বিক আর পণ্ডিত অধ্যাপক হীরেন্দ্রনাথ মুখার্জী (মুখোপাধ্যায়) ‘তরী হতে তীর’ নামক তাঁর আত্মস্মৃতিতে বদরুদ্দোজার বাগ্মিতার উদাত্ত তারিফ করেছেন। যুক্তফ্রন্ট গঠনে বদরুদ্দোজার অবদানের প্রসঙ্গটিও উত্থিত হয়েছে।

(১১) ইংরেজি ভাষায় মুসলিম সাংবাদিকতার জনক মৌলবী মুজিবুর রহমান (সম্পাদক ‘দ্য মুসলমান’, দ্য কমরেড (সাপ্তাহিক) ১৯৩৮ সালে অসুস্থ হয়ে পড়েন। সৈয়দ বদরুদ্দোজা ১১৪/১৫, লোয়ার সার্কুলার রোডে (বর্তমানে এ জি সি বোস রোড) জনাব রহমানকে প্রায় দেখতে যেতেন। শ্রদ্ধেয় জন বা বন্ধুদের বিপদের পাশে দাঁড়াতে সদা উদগ্রীব থাকতেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু, মওলানা আবুল কালাম আজাদ, অধ্যাপক -দার্শনিক হুমায়ুন কবির, ড. মুহম্মদ শহীদদুল্লাহ, আবুল মনসুর আহমদ, কবি গোলাম মোস্তফা ইত্যাকার অগ্রজ বিশিষ্ট পুরুষ; মুজিবুর রহমানের বাড়িতে শুভেচ্ছা জানাতে গিয়েছিলেন। ১৯৪০ এর ২৬ জুলাই জনাব রহমানের মৃত্যুয় হয়। (দেখুন, আমিনুর রহমন, মৌলবী মুজিবুর রহমন, বিশ্বকোষ পরিষদ, কলকাতা)।।

লেখক: ঐতিহাসিক খাজিম আহমেদ। উদার আকাশ প্রকাশন থেকে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর মূল্যবান প্রবন্ধের বই ‘পশ্চিমবাঙালার বাঙালি মুসলমান : অন্তবিহীন সমস্যা।’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back To Top