শহিদ তিতুমীর, নারকেলবেড়িয়া ও কৃষক আন্দোলন

চলতি বছরের (২০১৭) জুলাই মাসে কিছু অপশক্তি ও মৌলবাদী শক্তি স্বরুপনগর-বাদুড়িয়া-বসিরহাটে সাম্প্রদায়িক আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু শুভ বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ সেই আগুনকে নিভিয়েছিল যা অভিনন্দনযোগ্য। মানুষ যখন খাওয়া-পরা-রুজি-রোজগার জোগাড় করা নিয়ে লড়াই করে তখন সে লড়াইকে থামিয়ে দেওয়ার জন্য প্রতিক্রিয়াশীল কায়েমি স্বার্থ অপশক্তির সাহায্যে সাম্প্রদায়িকতা তৈরি করে। কিন্তু তিতুমিরের দেশ যে এ আগুনে জ্বলবে না সেখানকার মানুষই প্রমান করেছলেন। কৃষক বা চাষিদের ন্যায্য অধিকারের বা ন্যায্য দাবি আদায়ের জন্য ব্রিটিশ সরকার রোষের হয়, হয়েই তাদেরই গুলিতে যিনি শহিদ হয়েছিলেন। তিনি হলেন সৈয়দ মীর নিসার আলী ওরফে তিতুমীর। তিতুমীর এর জন্ম ১৮৭২ সালের ২৭ জানুয়ারি। ১৯৩১ সালের ১৯ নভেম্বর তিতুমীর শহিদ হন। আর তাকে স্মরণ করে সেইদিন থেকে উত্তর ২৪ পরগণার নারকেলবেড়িয়া গ্রামে এক সপ্তাহ ব্যাপী তিতুমীর মেলা সংগঠিত হয়। যা সব সম্প্রদায়ের মানুষকে একটি বন্ধনের আবদ্ধ মিলিয়ে দেয়। আজকের বন্ধনে মিলিয়ে দেয়। আজকের দিনে তিতুমীরের কৃষকদের দাবি-দাওয়া নিয়ে যে কৃষকদের বিদ্রোহ বা কৃষক আন্দোলন গড়ে উঠেছিল তা অবশ্যই অনুস্বরণীয়, অনুকরণীয় বা স্মরণীয়। শ্রেণী বৈষম্যের বিরুদ্ধে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে ধরমনিরপেক্ষ কৃষক আন্দোলন। কৃষক-শ্রমিক-খেতমজুরদের লড়াইকে ধর্মীয় বিভাজন টেনে যারা লড়াইকে, সংগ্রামকে ভেঙে দিতে চায়, আমরা তাদেরকে ঘৃণা করি। আর তিতুমীরকে অনুসরণ করি। কৃষকদের ন্যায্য দাবী আদায় শুধু নয়, বরং তিতুমীরকে কৃষক আন্দোলনে ঐক্যবদ্ধ করার প্রথম সৈনিক বললে অত্যুক্তি হবেনা। অথচ যে গ্রামে বাস করে মাটির মানুষকে সঙ্গে নিয়ে কৃষকদের ন্যায্য পাওনা আদায়ের দাবিতে নীল বিদ্রোহে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন সেই উত্তর ২৪ পরগণা ঐতিহাসিক নারকেলবেড়িয়া গ্রামের ‘তিতুমীর-স্মৃতিস্তম্ভ আজ অবহেলার শিকার হয়ে জীর্ণ হয়ে গেছে। ১৯৭২ সালে এই ঐতিহাসিক স্মৃতিস্তম্ভ স্থাপিত হয়। স্মৃতিস্তম্ভে লেখা আছে ‘ভারতের মুক্তির সংগ্রামের প্রথম শহিদ তিতুমীরের পুণ্য-স্মৃতি স্বরণে’। স্মৃতিস্তম্ভের উদ্ধৃতি থেকে একথা বলা যায়, “তিতুমীর ভারতের স্বাধীনতা আন্দলনের প্রথম শহিদ। পূর্ব রেলের শিয়ালদাহ-বনগাঁ শাখার মসলন্দপুর স্টেশন থেকে প্রায় ১০ কিমি দূরে নারকেলবেড়িয়া গ্রাম। ঐতিহাসিক নারকেলবেড়িয়া গ্রাম। গোটা গ্রাম ঘুরেও চোখে পড়লনা সেই বাঁশের কেল্লার চিহ্ন। নারকেলবেড়িয়ার সঠিক কোন স্থানে বাঁশের কেল্লা নির্মাণ করে তিতুমীর ইংরেজদের সঙ্গে বীর সৈনিকের মত লড়াই করে ইতিহাস রচনা করেছিলেন। তার কোনও সঠিক নিশানা গ্রামবাসীরা আজও দিতে পারে না। সবচেয়ে বিস্ময়ের ব্যাপার  হল যে স্থানটিতে বাঁশের কেল্লা স্থান হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে সেটাও অনুমান করে করা হয়েছে। কেননা সেখানে বাঁশের কেল্লার ইতিহাসও লেখা নেই। ইতিহাস ও এটাই তিতুমীর বাঁশের কেল্লা বানিয়ে ব্রিটিশ বাহিনীর বিরুদ্ধে বীরের মত যুদ্ধ করেন। দেশ-বিদেশের পর্যটক, ইতিহাস পিপাসু কিংবা ইতিহাস গবেষকদের আজও নারকেলবেরিয়া, তিতুমীর সমান ভাবেই টানে। কিন্তু দুঃখের সঙ্গেই জানাতে হচ্ছে নারকেলবেড়িয়া গ্রাম যেরকম ভাবে অবহেলার শিকার ওই গ্রামে স্থাপিত তিতুমীর স্মৃতিস্তম্ভ।

নারকেলবেড়িয়া গ্রামের ধূ-ধূ সবুজ সাজানো মাঠ আজও এলাকার মানুষদের ফাঁসিতলা নামে পরিচিত। কেননা এই উন্মুক্ত মাঠেই ব্রিটিশ সরকার তিতুমীরের প্রধান সেনাপতি গোলাম মাসুম খাঁ-কে ফাঁসি দিয়েছিল। অসংখ্য কৃষক সৈন্যরা রক্তের লাল-লাল হয়ে গিয়েছিল ফাঁসিতলা মাঠ। আজ সবই ইতিহাস। লোক মুখে আজও শোনা যায় সেই কবিতার ছন্দ ‘ভড়ভড়িয়া, কচ্ছ কুঁড়িয়া/ লাশে লাশে নিল জুড়িয়া’। দুঃখের বিষয় না ফাঁসি কাঠায় মাঠ, না  নারকেলবেড়িয়া গ্রাম কোন ওখানেই প্রত্নতত্ত্ববিভাগ বা কেন্দ্রীয় সরকার ঐতিহাসিক প্রদর্শনী কেন্দ্র গড়তে কোন ভূমিকাই পালন করেনি স্বাধীনতার ৭০ টি বছর কেটে যাওয়ার পরও। ভাগ্যিস, ১৯৭২ সালে শান্তিময় রায়ের মত প্রগতিশীল ও দায়িত্ববান ব্যক্তিত্বের প্রচেষ্টায় ‘তিতুমীর স্মৃতিস্তম্ভটি গড়ে উঠেছিল।

নীল বিদ্রোহের পাশাপাশি তিতুমীর ‘ওয়াহবি’ আন্দোলন সংগঠিত করে। ‘ওয়াহবি’ আন্দোলন ছিল ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন। তিতুমীর এই আন্দলনের অনুপ্রেরণা পেয়েছিল উত্তর ভারতের বিশিষ্ট ‘ওয়াহবি’ নেতা সৈয়দ আহম্মদ শাহ্‌ বেরেলীর কাছে। সুদূর মক্কায় এই ‘ওয়াহবি’ নেতার সঙ্গেই পরিচয় ঘটে তিতুমীরের। কথাটা দুঃখের হলেও সত্য, তিতুমীর যখন কৃষক বা নীল চাষীদের ন্যায্য পাওনা আদায়ের লক্ষে ব্রিটিশদের মরণপণ সংগ্রামে লিপ্ত তখন আমাদের দেশে সামন্ত জমিদার প্রভুরা নীল চাষি কৃষকদের উপর তিন টাকা হারে কর আরোপ করেন।

তাছাড়া তিতুমীরকে শায়েস্তা করের জন্য ব্রিটিশদের সমর্থনে লাঠিয়াল ও বন্ধুকধারী ফৌজও পাথিয়েছিলেন। নারকেলবেড়িয়া পাশ্ববর্তী গোবরডাঙ্গা, কোপরা-গোবিন্দপুরের ব্রিটিশদের হয়ে সমস্ত শক্তি নিয়োগ করেন তিতুমীরকে দমন করতে। তিতুমীর যে ব্রিটিশ বাহিনীর সঙ্গে সংগ্রামে লিপ্ত, সেই সময় আমাদের দেশের ফকির বিদ্রোহ ও সন্ন্যাস বিদ্রোহের একটি ঢেউ বহমান ছিল। এঁদের সঙ্গে পেরে উঠতে ব্রিটিশদের বেশ বেগ পেতে হয়। শক্তিশালী ফকির বাহিনীর নেতা মিক্সন শাহ তার দলবল নিয়ে তিতুমীরের সঙ্গে যোগ দেন। জমিদার ও ব্রিটিশদের সমবেত বাহিনীর সঙ্গে তিতুমীর ও মিক্সন শাহ-এর মিলিত বাহিনীর তুমুল যুদ্ধ হয়। এই যুদ্ধের শুরু ১৪ নভেম্বর। রুদ্রপুর কুঠি, ইছাতির গড়, মির্জাপুর  কুঠি দখল করে নেই তিতুমীর বাহিনী। এমনকি তিতুমীরের সৈন্যবাহিনী বারাসাতের হেস্টিংস কুঠি পর্যন্ত দখল করে নেয়। হেস্টিংস কুঠির গোরা সৈন্যরা পরাজিত হয়ে কলকাতার দিকে পালিয়ে যায়। এই সময় তিতুমীরের দলবল যুদ্ধ জয় করে গাইঘাটা ও ইছামীর কুঠি দখল করে। তারপর জমিদার বাড়িতেও আক্রমণ করে তিতু ও মিক্সন শাহ-এর মিলিত বাহিনী। সম্মুখ সমরে পেরে উঠতে না পেরে ১৮৩১ সালের ১৯ নভেম্বর শীতের রাতে গোরিলা কায়দায় আক্রমণ করে তিতুমীরকে ইংরেজরা হত্যা করে।

যে তিতুমীর ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে সর্বশক্তি নিয়োগ করে বীরদর্পে লড়াই করে শহিদ হন। সেই তিতুমীর নারকেলবেড়িয়া গ্রাম আজও অবহেলার শিকার। নারকেলবেড়িয়া গ্রামের ইতিহাস আজ লুপ্তপ্রায়। তবুও স্বীকার করতে হবে। বামফ্রন্ট সরকার প্রাথমিক স্তরে তাঁর ইতিহাস ব্যপক ভাবে তুলে ধরেছে। তবে, ১৯ নভেম্বর শহীদ দিবসে সরকারীভাবে কোন ধুমধাম হয়না। যেটুকু হয় গ্রামবাসীদের বেসরকারি উদ্যোগে। তিতুমীর মেলা তারই একটি বহিঃপ্রকাশ। আর ১৫ আগস্ট নারকেলবেড়িয়া গ্রামের বিভিন্ন স্কুল ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্র-ছাত্রীরা কুচকাওয়াজ করে ‘৭২ সালে স্থাপিত স্তম্ভে ফুলমালা দিয়ে যার ‘শহিদ স্মরণে জীবনের মরণের রক্ত-ঋণ শোধ কর, স্লোগানে চারিদিক মুখরিত হয়। মুহররমের দিনে গ্রামের কারবালা প্রান্তরে এসে মাতম করা ছাড়া আর কিছুই হয় না। এইদিন সব সম্প্রদায়ের মানুষের মুখে জারিগান আজও বাংলায় মানুষের হৃদয়  বিগলিত করে। ‘নারকেলবেড়িয়া গাঁয়/ বাঁশের কেল্লা তিতুমীর মারা গেল। গোলাম মাসুম ধরা, ফাঁসিতে ঝোলান — এরা সোনার ছেলে’।

সত্যিই, নারকেলবেড়িয়া গ্রামে যোগাযোগ ব্যবস্থা খুবই খারাপ। একটি সুরু পাকা রাস্তা আছে। তাও কাঁচা রাস্তার থেকেও খারাপ। বাঁশের কেল্লা তিতুমীর, গোলাম মাসুম- সবই ইতিহাস। ইতিহাস যে নীরবে নিভৃতে কাঁদে’। মনে পড়ে যায় কবিগুরুর সেই অমোঘ বাণী –‘হে অতীত তুমি ভুবনে ভুবনে কাজ করে যাও গোপনে গোপনে’। তবু অবহেলিত নারকেলবেড়িয়া গ্রাম কিন্তু আজও ইতিহাস পিপাসু বা গবেষকদের খোরাকের বস্তু সে কথা বলা বাহুল্য।

Back To Top