প্রয়াত হলেন মরমী কথাকার আব্দুর রাকিব ।

আবদুর রাকিব (১৯৩৯) বীরভূমের মুরারই থানার এদরাকপুর গ্রামে জন্ম। ছাত্রাবস্থাতেই ১৯৫৮ সালে কলেজ ম্যাগাজিনে স্বনামে ‘শরৎচন্দ্র’ কবিতা ও অন্য নামে ‘মংলু’ নামে ছোটগল্প লিখে লেখকজীবনের উদ্বোধন ঘটে। ১৯৬০ সালে মাসিক পত্রিকায় ছদ্মনামে লেখেন ‘শুকনো পাপড়ি ‘গল্প।

পেশা হিসেবে শিক্ষকতাকেই গ্রহণ করেন। সেইসময় মুর্শিদাবাদের জিনদিঘির চারণকবি গুমানি দেওয়ানের সান্নিধ্যে আসেন। তাঁর কবিজীবনের উত্থানের কাহিনি সংগ্রহ করে লিখে ফেলেন প্রথম গ্রন্থ ‘চারণকবি গুমানি দেওয়ান’ (১৯৬৮) । হরফ প্রকাশনী থেকে বইটি প্রকাশ পেলে চারিদিকে সাড়া পড়ে যায়।

‘কাফেলা’ পুরস্কারে সম্মানিতও করা হয় লেখককে। ২০০১ সালে তথ্য সংস্কৃতি বিভাগ, পশ্চিমবঙ্গ সরকার কর্তৃক বইটির দ্বিতীয় সংস্করণ হলে আরও জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। বইটি শুধু কবিজীবনের আলেখ্যই নয়, সময় সংস্কৃতি, দেশপ্রেম, মানবিকতা, ভারতের প্রাচীন ঐতিহ্য, মানুষের জীবন জিজ্ঞাসাও কবিগানের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মূল উপজীব্য বিষয়।

একটা যুগের ভাবনাই যেন কবি গুমানি দেওয়ানের পাঁচালিতে ফুটে উঠেছে। মেধাবী তিক্ষ্ণ যুক্তিজালের সঙ্গে অপূর্ব হাস্যরস পরিবেশন বইটির মূল বৈশিষ্ট্য। এখানেই বইটির শ্রেষ্ঠত্ব। লেখকের অন্যান্য উল্লেখযোগ্য বইগুলি হল — ‘প্রতিকূলে একজন’, ‘বাদশাহ ও বাবুই বৃত্তান্ত’ প্রভৃতি গল্পের বই। ‘সংগ্রামী নায়ক মাওলানা আবুল কালাম আজাদ’, ‘একত্ববাদের মশাল দৌড়’, ‘আল্ কুরানের উপমা ব্যঞ্জনা, ইসলামে নারীর অবস্থান ও অধিকার’ ইত্যাদি প্রবন্ধ গ্রন্থ। অনূদিত গ্রন্থগুলি হল — ‘ইসলাম প্রসারের ইতিহাস’, ‘কাশফুল মাহজুব’ , ‘স্পেনের মুসলিম ইতিহাস’ ইত্যাদি। সবগুলিই ইংরেজি থেকে বাংলায় অনুবাদ করেছেন। সম্প্রতি আরও কিছু বই প্রকাশিত হয়েছে, যেমন নতুন গতি প্রকাশনীর ‘আবদুর রাকিবের নির্বাচিত গল্প’ এবং ‘বেড়ে ওঠার দিনগুলি’, ‘পথপসারীর পত্রোত্তর’ ইত্যাদি আত্মজীবনীমূলক রচনা।

স্বচ্ছ, সাবলীল এক মৌল সৌন্দর্যে অনুরণিত বইগুলি অনবদ্য সৃষ্টি হিসেবেই চমৎকৃত হয়ে উঠেছে। অসাধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন এই গদ্যকার শব্দ, ক্রিয়াপদ, বিশেষণ, শব্দব্যঞ্জনা নিয়ে বারবার পরীক্ষা নিরীক্ষা করেছেন। তাঁর ভাষাশৈলীতে মুগ্ধ হতে হয়।

রাঢ় বাংলার জীবন সংস্কৃতি বোঝাতে তিনি এক জায়গায় লিখেছেন : “এখানে বেঁচে থাকার অর্থাৎ অস্তিত্ব রক্ষার আকাঙ্ক্ষাটি আনন্দময়। আনন্দময় কিন্তু আত্মমগ্ন নয়। ব্যক্তি এখানে বিশ্বনাগরিক হতে চায়। সহাবস্থানে সন্তুষ্ট না থেকে সম্প্রীতির জন্য উন্মুখ হয়। এবং জীবনকে তাত্ত্বিক বা দার্শনিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখে না। চেতনিক ও প্রফুল্ল অস্তিত্বের জন্য যে জীবন-পদ্ধতি দরকার, বেঁচে থাকার সেই স্বত:স্ফূর্ত সাবলীল ছন্দকে তথা জীবনাচরণকে এখানে বলা হচ্ছে ‘জীবন-সংস্কৃতি’। “জীবনের আনন্দময় চালচলনের গতি যে ব্যবহারিক সম্পর্কের মধ্যে দিয়েই গড়ে ওঠে, লেখকের অভিজ্ঞতা সেই নিরিখেই। তাই সমাজ দর্শনের মূল ক্রিয়াটিতে সম্প্রীতির ভাবনাটিও চমৎকার ভাবে দেখেছেন : “ আজও বৈশাখী-সন্ধ্যায় হিন্দু-কীর্তন মুসলিম-মসজিদের কাছে এসে থেমে যায়। হিন্দুর মৃত্যু সংবাদ স্বজনদের কাছে পৌঁছে দেয় মুসলমান যুবক। হিন্দুর ঝগড়া মেটায় মুসলমান মাতব্বর, মুসলমানের ঝগড়া হিন্দু। নবান্ন-বিজয়ায় আমন্ত্রিত হয় মুসলমান মেহমান, তেমনি ঈদে আমন্ত্রিত হয় হিন্দু প্রিয়জন। হিন্দু বরযাত্রী দলে মুসলমান থাকে, মুসলমান বরযাত্রী দলে হিন্দু। সন্ধ্যায় মসজিদে আজান দেয় মুসলিম মুয়াজ্জিন, আর হিন্দু বধূরা শাঁখ বাজিয়ে প্রদীপ জ্বালে তুলসীমঞ্চে। রাঢ় বাংলার এ-এক চিরায়ত সান্ধ্য পটচ্ছবি।’’ (উত্তর রাঢ়ের রূপ ও জীবন সংস্কৃতি)।

তাঁর গল্পের কুশীলবেরা মূলত গ্রামসমাজের হতদরিদ্র মেহনতি মানুষ, যাদের অধিকাংশই মুসলিম, যাদের বিত্তবৈভব কৌলিন্য কিছুই নেই। শিক্ষা নেই, আভিজাত্য নেই, নেই সংস্কৃতিও। ছেঁড়াখোঁড়া জীবনের ভার বহন করে মাটির কাছের মানুষ তারা। তবুও তাদের মধ্যে একটা নৈতিক মূল্যবোধ নিয়ে তারা বেঁচে থাকে। জেগে ওঠে তাদের বিবেকও। তাদের সত্তায় স্নেহপ্রেমের অভাব নেই। এক নির্লোভ মানবিক স্বর শোনা যায়, যা অপার্থিব সুন্নাতের মহান মর্যাদায় অভিষিক্ত। ভাবনায় আলোকিত প্রত্যয় জেগে ওঠে। গল্পের মোচড়ে কখনো কখনো চোখে জল এনে দেয়।

শিল্পের প্রতি দায়বদ্ধতা থেকেও একটা পরিচ্ছন্ন রুচিবোধে চালিত লেখক পরিণতিতে পৌঁছে দেন। অনন্ত সম্ভাবনার সংকেতে হৃদয় মুকুলিত হয়ে ওঠে। চরিত্রগুলির চেনা পরিচিতিও পাল্টে যায় নিমেষে। প্রকৃতি পটে গ্রাম্য ও আদিবাসী তিন কন্যাকে দেখে তাঁর এক গল্পের নায়কের আনুভূতিক স্বর এরকম : “তিন কন্যার খোঁপায় কৃষ্ণচূড়ার লতানে লাল চমক দেখে চমকে উঠি। কারা এরা! স্রেফ গ্রাম্য ও আদিবাসী কন্যা, নাকি নিখাদ তিন প্রকৃতি ললনা, যারা পরস্পরের মুখের ও মনের ভাষা বোঝে! এ ছবি তো হঠাৎ করে তৈরি হওয়া নয়। এ যেন নারী ও প্রকৃতির প্রতিসাম্যে গড়া এক অখণ্ড সত্তার চির-বহমান প্রতিরূপ।

সময় ও সভ্যতার শত অভিঘাতেও যার সুষমা ও আয়ু ক্ষয় হয় না। যারা জগৎ সংসার ভুলে আত্মার সঙ্গে কথা বলে, বুঝতে পারি, অসময়ে তাদের আসরে এসে আমরা ভালো করিনি।’’ (সহজ পাঠ : অসহজ অঙ্ক)।

ভাবনার স্তরে অনেকখানি তলিয়ে যেতে হয়। নায়কেরা কখনোই বিকৃত রুচির শিকার নয়। বৃহৎ কোনও ধ্বংসকার বা দেশদ্রোহীও নয় তারা। এই সমাজেরই সাধারণ মানুষ। চিরদিন তারাই থাকবে। গল্পগুলিও তাদের জীবনের অনুষঙ্গ হয়ে বিরাজ করবে। মূলত ‘নতুন গতি’ এবং ‘কলম’ পত্রিকায় সবচেয়ে বেশি লিখেছেন আবদুর রাকিব। তিনি ‘নতুন গতি’র সম্পাদকীয় বিভাগেও রয়েছেন।

এক সময় ‘কাফেলা’পত্রিকায় ধারাবাহিক ভাবে ‘বাতায়ন’ শিরোনামে কবিদের কবিতা নিয়ে মূল্যায়ন করতেন। ধারাবাহিক ভাবে সাহিত্য চর্চায় এখনও সচল তিনি। কলকাতা কেন্দ্রিক সাহিত্য মোড়কের আভিজাত্যকে তোয়াক্কা করেন না বলেই গ্রামের বাড়ি ‘ছায়ানটে’ই অনেক বেশি স্বচ্ছন্দ বোধ করেন।
লিখেছেন :তৈমুর খান ।

Back To Top