ভারতীয় সংবিধানের ৩০ নং ধারাঃ  উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য

~মুন্সী আবুল কাশেম

ভারতীয় সংবিধানের ৩০ নং ধারার সংযোজন ধর্মীয় ও ভাষাভিক্তিক সংখ্যালঘুদের শিক্ষার এক অনন্য সাধারণ অধিকার। এই অধিকার তাদের জন্য আশীর্বাদ যারা শিক্ষায় ও আর্থসামাজিক ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়া সংখ্যালঘু।

এই ধারা সম্পর্কে দু-এক কথা বলার আগে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় সংখ্যালঘুদের অবস্থান কোনখানে তা ভেবে নেওয়া ভালো। সহজ বাংলায় আমরা বুঝি যে সংখ্যালঘুরা নিজ প্রচেস্টায় বিধানসভায় বা লোকসভায় কোন বিল পাশ করার ক্ষমতা রাখেনা। সংখ্যাধিক্যের অভাবহেতু তাদের সংবিধানিক খুবই দুর্বল। অনিশ্চয়তা তাদের সামাজিক জীবনে নিত্যসঙ্গী । ভারতীয় সংবিধান সচেতন ভাবে স্পর্শকাতর এই ‘সংখ্যালঘু’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন।

ভারতে সংখ্যালঘু সমাজ বিশেষভাবে  ধর্মীয় সংখ্যালঘু সমাজের সংখ্যা একাধিক তবে মুসলিম সমাজ সর্ববৃহৎ হারে সংখ্যালঘু। স্বাভাবিক কারণে অনেকেই বলে থাকেন ৩০ ধারার এই আইন মুসলিম সমাজকে তোষণ করার জন্য লিপিবদ্ধ হয়েছে কিন্তু কথাটি আদৌ বাস্তব সম্মত নয়।

এ প্রসঙ্গে একটা কথা বলে নেওয়া ভালো যে সংখালঘুদের ধর্মের অধিকার অথবা ধর্মীয় কৃষ্টি-কালচার প্রসারে উৎসাহ দেওয়ার জন্য ৩০ নং ধারা নয় । ভারত ধর্মনিরপেক্ষ দেশ এবং ধর্মনিরপেক্ষ সরকারের দায়িত্ব নয় যে কোন ধর্মীয় নীতির প্রসার বা প্রচারে আর্থিক সাহায্য বরাদ্দ করা। সরকার নাগরিকদের ধর্মীয় স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করবেন না ঠিকই কিন্তু উৎসাহই দেবেন না। অতএব ৩০ নং ধারাকে যারা ধর্মীয় শিক্ষার নীতি ও আদর্শ প্রচারের সহায়ক হিসাবে বর্ণনা করেন তাদের উচিৎ এই ধারার ব্যাখ্যা নিয়ে দ্বিতীয় বার ভাবা।

সংখ্যালঘু মুসলিম সমাজের জন্য ৩০ নং ধারার প্রয়োজন কেন?

ইতিহাসের পাতা উল্টালে দেখা যায় যে আমাদের দেশে কম বেশী প্রায় ২০০ বছর ইংরেজ শাসনাধীন ছিল । ইংরেজরা এদেশে ব্যবসা করতে এসেছিল কিন্তু তৎকালীন নবাব বাদশাহদের ঝড়গাঝাটির সুযোগকে কাজে লাগিয়ে ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে নবাব সিরাজদৌলার হার ও ১৭৬৪ সালে বক্সার যুদ্ধে নবাব মীর কাশিমকে হারিয়ে তারা বাংলা, বিহার, উড়িষ্যার রাজক্ষমতা দখল করে এবং পরবর্তী কালে তৎকালীন ভারতের সমস্ত রাজা বাদশাহদের হারিয়ে সমগ্র ভারতবর্ষের শাসন ক্ষমতা দখল করে । স্বাভাবিক কারণে এদেশের মুসলিমদের সাথে ইংরেজদের বিরোধ একান্তয় আন্তরিক।

ইংরেজ আসার আগে আমাদের দেশে মোটামুটি দু- ধরনের শিক্ষা ব্যবস্থা চালু ছিল । হিন্দুদের জন্য ‘টোল’ শিক্ষা যেখানে সংস্কৃত শেখানো হত ধর্মীয় ভাষা তথা দেব ভাষার আরাধনার উদ্দেশ্য। স্বার্থ এই যে দেবতা তুষ্ট হলে জলের দেবতা বরুন্দেব বারি ধারা বর্ষণ করাবেন যার দ্বারা দেশ খাদ্যশস্যে সমৃদ্ধ হবে। অন্যদিকে মুসলিম সমাজ ‘মাদ্রাসা’ শিক্ষার মাধ্যমে ইসলামিক ধর্মীয় ভাষা আরবি ও বাদশাহদের ভাষা ফারসি শিক্ষা করত। বিধাতা সন্তুষ্ট হলে পানি বর্ষিত হবে যার মাধ্যমে দেশ শস্য- শ্যামলা হবে এবং ফারসি শিক্ষার মাধ্যমে রাজ আনুকুল্য পাওয়া যাবে। টোল বা মাদ্রাসায় বিজ্ঞান , অঙ্ক, দর্শন, ইত্যাদি শেখার কোন সুযোগ ছিল না। দেশ উন্নত চিন্তার অধিকারী হবে কি ভাবে?

ইংরেজরা এই দেশ দখলের পর প্রথমে তারা খানিকটা মুসলিম তোষণের জন্য ও খানিকটা তৎকালীন আইন যা ফারসি ভাষায় লিখিত , তা জানার জন্য ক্যালকাটা মাদ্রাসা স্থাপন করেন (১৭৭৯-৮০)। তবে তা ছিল নিতান্তই সাময়িক । পরবর্তীকালে তারা ইংরেজি ভাষাকে সরকারী ভাষা হিসাবে সুপ্রতিষ্ঠিত করে। ফারসি ভাষার গুরুত্ব কমে যায়।

ইংরেজ সরকার ভারতীয় শিক্ষা ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন ঘটান (১৮৩৫)। ‘স্কুল’ শিক্ষা ব্যবস্থা প্রবর্তিত হয় যেখানে ইংরেজী , অঙ্ক, বিজ্ঞান, দর্শন, শিক্ষা শুরু হয়। হিন্দু সমাজ ‘টোল’ শিক্ষার অবসান ঘটিয়ে স্কুল শিক্ষায় আত্মনিয়োগ করে কিন্তু মুসলিম সমাজ ইংরেজ প্রবর্তিত এই শিক্ষা ধারায় অংশ গ্রহণ করে নি। তারা মাদ্রাসা শিক্ষার মধ্যে আবদ্ধ থেকে যায়। ফলে হিন্দু সমাজ যেমন সরকারী প্রশাসনে প্রবেশ করতে পেরেছে তেমনি জ্ঞান-বিজ্ঞানে অগ্রগতি লাভে সমর্থিত হয়েছে। কিন্তু রাজনৈতিক বৈরিতার কারণে মুসলিম সমাজ ইংরেজ প্রবর্তিত স্কুল শিক্ষা বয়কট করায় এবং মাদ্রাসা শিক্ষার মধ্যে আবদ্ধ থাকায়, তারা ক্রমশ রক্ষণশীলতার ঘেরাটোপে আটকে পড়ে। ইংরেজ শাসনের শেষ দিন পর্যন্ত মুসলিম সমাজে মাদ্রাসা শিক্ষার এই ধারা বহাল থাকে।

১৯৪৭ সালে ১৫ আগস্ট ইংরেজ শাসনের অবসান ঘটে । রাজনৈতিক তিক্ততার মধ্যে দেশ ভাগ হয়, পাকিস্থান নামক এক নতুন রাষ্ট্রের জন্ম হয়। কিন্তু বৃহৎ সংখ্যক মুসলিম সমাজ তাদের স্বদেশভূমি ভারতবর্ষ ত্যাগ করে নি। তারা তো এই দেশের স্বাভাবিক নাগরিক।

১৯৫০ সালে ২৬ শে জানুয়ারী দেশের সংবিধান রচিত হলো। তাতে লেখা হল ভারতের সকল নাগরিক তাদের ধর্ম , বর্ণ লিঙ্গ যাইহোক না কেন সকলের জন্য থাকবে  সমান অধিকার ( সংবিধানের ১৪, ১৫(১) ধারা)। সরকার কারোর প্রতি কোন বৈষম্য মূলক আচরণ করবেন না।

কিন্তু বাস্তব সত্য এই যে সমঅধিকার পেতে হলে সমযোগ্যতা থাকতে হবে। আধুনিক বিজ্ঞান শিক্ষায় যারা উন্নত তাদের সঙ্গে গতানুগতিক রক্ষণশীল ধর্মীয় শিক্ষায় আবদ্ধ সমযোগ্যতা বাছাইয়ের পরীক্ষায় সাফল্য পাবে কি ভাবে? সংবিধান রচয়িতারাও  এ প্রশ্নে যথেষ্ট ভাবিত ছিলেন।

প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যেতে পারে তৎকালীন সময়ে দেশের মুসলিম সমাজ যেমন শিক্ষায় ও আর্থসামাজিক ক্ষেত্রে অনুন্নত ছিল ঠিক তেমনি দেশের বৃহৎ সংখ্যক দলিত, তপশীল জাতি ও উপজাতি সপ্রদায়ের লোকেরাও শিক্ষার অভাবে সামগ্রিক ভাবে পেছিয়ে ছিল। তাদের উন্নয়নে সংবিধানের ১৫(৪) ধারা সংযুক্ত হয়। দেশের দলিত, তপসিলী জাতি ও উপজাতির লোকের উন্নয়নে সরকার বিশেষ ব্যবস্থা নিতে পারবেন সে দায়িত্ব সরকারকে দেওয়া হয়। তাদের ছেলেমেয়েরা সরকারী সাহায্যে শিক্ষা লাভের সুযোগ পাবে। চাকুরি পাওয়ার ক্ষেত্রে বিশেষ সুযোগ পাবে । সাংবিধানিক এই অধিকার তাদের জীবনের এই অসহয়তা বোধ অনেক খানি দূরীভূত হয়েছে। কিন্তু দুঃখের বিষয় এই সুযোগ পেছিয়ে পড়া মুসলিম সমাজের জন্য বরাদ্দ হয়নি। সম্ভত তৎকালীন প্রতিকূল রাজনৈতিক পরিবেশ তার জন্য দায়ী।

মহামতি ডঃ বি আর আম্বেদকরের সভাপতিত্বে গঠিত সাংবিধানিক কমিটি মুসলিম সমাজের সামগ্রিক উন্নয়নে এক বলিষ্ঠ ধারা সংযোজন করেন। এটি সংবিধানের ৩০ নং ধারা , ধর্মীয় সংখালঘুদের শিক্ষার মৌলিক অধিকার । আধুনিক শিক্ষায় পেছিয়ে পড়া সংখ্যালঘু মুসলিম সমাজের কাছে  একটি চ্যালেঞ্জ । মুসলিম সমাজকে দায়িত্ব দেওয়া হল স্থির করতে কোন ধরনের শিক্ষা তাদের কাম্য। মুসলিম সমাজ ঠিক করুক বৃহত্তর প্রতিযোগিতার সাফল্য পেতে হলে শিক্ষার ধরন ও বিষয়বস্তু কি হওয়া উচিৎ? অধিকার প্রতিষ্ঠান পরিচালনার পূর্ণক্ষমতা । আরো বলা হল সেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিচালনার যাবতীয় খরচ  সরকার বহন করবেন যা দেশের অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় সরকার করে থাকেন। এটি ৩০(১) , (২) ধারার মর্মবাণী।

পরিতাপের বিষয় মুসলিম সমাজ সংবিধান প্রদত্ত সেই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে পারে নি। সমাজের বিশিষ্ট জনেরা ঠিক করলেন গতাগতিক ‘মাদ্রাসা’ শিক্ষায় তাদের কাম্য । তবে তাদের দাবী মাদ্রাসার আগে দুটি ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করা হোক । একটি Senior , আদর্শ High। পূর্বতন খারেজী মাদ্রাসার নাম হল senior Madrasaha এবং রিভাইসড মাদ্রাসার নাম হল High Madrasaha। সম্ভত মাদ্রাসার মাধ্যমে ইংরেজি শিক্ষার বিরুদ্ধে মুসলিম সমাজ যে আন্দোলন করেছিল তার প্রায়শ্চিত্ত করার জন্য senior ও High শব্দ দুটির সংযোজন ।মুসলিম সমাজ সরকারের কাছে দাবী করলেন এই মাদ্রাসার দুটি পরিচালনার দায়িত্ব বিনা শর্তে সরকার গ্রহণ করুন এবং আর্থিক সাহায্য দিয়ে মুসলিম সমাজকে বাধিত করুন । বলা বাহুল্য পশ্চিমবঙ্গ সরকার সে দায়িত্ব যথাযত পালন করে আসছেন এবং ২০০৭ সাল পর্যন্ত এরূপ মাদ্রাসার সংখ্যা দাঁড়ায় ৬১৪ । মাদ্রাসাগুলির যাবতীয় খরচ সরকার বহন করেন এবং মাদ্রাসাগুলির পরিচালনা ও দেখভাল করার জন্য সরকার মনোনীত বিশিষ্টজনদের নিয়ে মাদ্রাসা গঠিত হয় । মাদ্রাসা বোর্ড পাঠ্যসূচী ঠিক করেন , শিক্ষক বাছাই ও নিয়োগের নির্দেশ এবং পরীক্ষা পরিচালনা করেন।

মাদ্রাসা বোর্ড থেকে পাশ করা ছেলেমেয়েরা তীব্র প্রতিযোগিতার বাজারে কতটা সাফল্য পাচ্ছে তা নিয়ে বিদ্বজ্জন মহলে যথেষ্ট প্রশ্ন থাকতে পারে কিন্তু এটাত ঠিক এই শিক্ষাধারা পশ্চিমবঙ্গ মুসলিম সমাজের পক্ষে এক অমূল্য আইডেনটিটি।

২০০৮ সালে ৩০ শে জুন তারিখে প্রকাশিত Go.942-MD আদেশনামার মাধ্যমে পশ্চিমবঙ্গ সরকার মাইনরিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন ও পরিচালনার বিধি প্রণয়ন করেন যা এতদিন অচর্চিত ছিল। ঐ বিলের ১(৯) ধারা বিধিমতে পশ্চিমবঙ্গ সরকার ঘোষণা করেন যে এ পর্যন্ত যতগুলি মাদ্রাসা সরকার স্বীকৃতি দিয়েছেন ও আর্থিক সাহায্য বরাদ্দ করেছেন তাদের সকলকেই ‘সংখ্যালঘু’ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মর্যাদা দেওয়া হল।

একটা বড় ভুল হয়ে গেল । অনুমোদিত মাদ্রাসা গুলি পরিচালিত হচ্ছিল সরকারের সাধারণ শিক্ষা আইনে যেভাবে সরকারী অন্যান্য স্কুল কলেজ পরিচালিত হয় । কিন্তু সংখ্যালঘু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তা থেকে ভিন্ন। সংখ্যালঘু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অধিকার আছে নিজ দায়িত্বে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করার। শিক্ষক নিয়োগসহ প্রতিষ্ঠান পরিচালনার অন্যান্য সব কাজ প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষকে করতে হবে – ৩০ ধারার আইনে তাই বলা আছে। সরকার লক্ষ্য রাখবেন , নীতি-নিয়ম ঠিক করে দেবেন কিন্তু পরিচালনার সরাসরি হস্তক্ষেপ করবেন না।

সরকারি নিয়ন্ত্রণাধীনে পরিচালিত সংখালঘু স্ট্যাটাসপ্রাপ্ত মাদ্রাসা গুলিতে শিক্ষক নিয়োগের ক্ষমতা মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ দাবী করছেন। কিন্তু সে দাবী নিয়ে  শিক্ষক মহলে নানা ধরনের প্রশ্ন উঠছে। প্রশ্নটি বর্তমানে স্পর্শকাতর অবস্থায় পৌঁছেছে । মহামান্য উচ্চাদালত ৩০ ধারার পক্ষে রায় দিয়েছেন। জানা নেই উচ্চতম আদালত কি রায় দেবেন?

তবে দড়ি টানাটানি শুরু হয়েছে মুসলিম সমাজের মধ্যেই । ৩০ ধারা নীরবে- নিভৃতে কাঁদছে। আর অন্য সমাজের লোকেরা মুচকি হাসি হাসছে।

 

 

Back To Top