শতবর্ষের প্রাচীন মুসলিম ইনস্টিটিউট কলকাতার গর্ব

জামিতুল ইসলাম

বিংশ শতাব্দীর শুরুতে শহর কলকাতায় মুসলিমদের তৈরি যেসব প্রতিষ্ঠান আজও ঐতিহ্য বহন করে চলেছে তার মধ্যে অন্যতম হল মুসলিম ইনিস্টিটিউট। হাজী মোহাম্মদ মহসীন স্কোয়ারে মাথা উঁচু করে থাকা এই প্রতিষ্ঠানটি আজও শিক্ষা, সংস্কৃতি ও ক্রীড়াক্ষেত্রে বিশেষ ঐতিহ্য বহন করে চলেছে।আধুনিকতার সঙ্গে তাল মিলিয়ে শতবর্ষের প্রাচীন এই প্রতিষ্ঠানটি এগিয়ে চলেছে আরও উন্নত পরিষেবার দিকে। যদিও এই প্রজন্মের কাছে মুসলিম ইনস্টিটিউট সম্বন্ধে সেভাবে বার্তা পৌঁছায়নি। তবে সেই প্রচেষ্টা এবার জোর কদমে শুরু হয়েছে। মুসলিম ইনস্টিটিউটের আধুনিকতার পর নতুন রূপে দেখা যাচ্ছে যা শহরের অন্য অভিজাত প্রতিষ্ঠানের তুলনায় কোনও অংশে কম নয়।

মূলত বিতর্ক সভা আর গোলতালার পুকুরে সাঁতারের মাধ্যমে শরীরচর্চা করার উদ্দেশ্য নিয়েই শুরু হয়েছিল। বর্তমানে কলেবরে অন্যরকম আকার নিয়েছে মুসলিম ইনস্টিটিউট। মুসলিম ইনস্টিটিউটকে আরও উন্নত করা প্রসঙ্গে কথা হচ্ছিল সাধারণ সম্পাদক প্রাক্তন আইপিএস অফিসার নিসার আহমেদ এর সঙ্গে। তিনি জানান এই কিছুদিন হল দায়িত্ব পেয়েছি। এখন পুরো বিষয়টিতে জোর দেওয়া হচ্ছে। পূর্ব ও বর্তমান সদস্য এবং কর্মকর্তাদের বিশেষ সহযোগিতায় মুসলিম ইনস্টিটিউট আধুনিকরনের কাজ অব্যাহত রয়েছে। বেশ কিছু কাজ করা হলেও আগামীতে গুরুত্বপূর্ণ পরিকল্পনা রয়েছে, যা বাস্তবায়িত হলেও মুসলিম ইনস্টিটিউট শহরের সব শ্রেণীর মানুষের কাছে গর্বের প্রতিষ্ঠান হয়ে উঠবে। এখন মুসলিম ইনস্টিটিউটে চোখ রাখলেই আধুনিকীকরণের ছাপ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। প্রথমেই লাইব্রেরির কথা বলা দরকার। আইন-ই-আকবরি থেকে শুরু করে ফরাসি ভাষার প্রামাণ্য গ্রন্থ রয়েছে এখানে। সেগুলি আধুনিক লাইব্রেরির মতো সাজানো হয়েছে। বিশেষ করে গ্রন্থ তালিকা। পাঠক চাইলেই গ্রন্থ তালিকা দেখেই নিমেষেই শনাক্ত করতে পারবেন গ্রন্থ ভান্ডার। দুষ্প্রাপ্য গ্রন্থ ও পাণ্ডুলিপির ডিজিটালাইজেশনও হয়েছে। আর এর সঙ্গে রয়েছে শীততাপ নিয়ন্ত্রিত পাঠকক্ষ। নানা ভাষার ম্যাগাজিন ও সংবাদপত্র বিনামূল্যে পড়ার সুযোগ রয়েছে। তবে লাইব্রেরির বই নেওয়ার জন্য লাইব্রেরির সদস্য হতে হয়। শহরে উর্দু মাধ্যমের ছেলে মেয়েদের উপযুক্ত কোচিংয়ের অভাব রয়েছে। সেদিকে লক্ষ্য রেখেই একাদশ শ্রেণীর ছাত্রছাত্রীদের উন্নতমানের কোচিং এর ব্যবস্থা রয়েছে এখানে। জাতীয় উর্দু প্রোমোশনের উদ্যোগে এখানে উর্দু প্রশিক্ষণও দীর্ঘদিন ধরে চলছে। ঢেলে সাজানো হয়েছে অডিটোরিমও। নিসার আহমেদ জানান, শিক্ষা ও সামাজিক কাজে বিশেষ অবদানের জন্য পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সংখ্যালঘু উন্নয়ন ও মাদ্রাসা শিক্ষা দফতর ২০১৬ সালে মুসলিম ইনস্টিটিউটকে বেগম রোকেয়া অ্যাওয়ার্ডে ভূষিত করেছে।

ঐতিহ্যময় আলিয়া মাদ্রাসার পাশাপাশি একটি সাংস্কৃতিক ও ক্রীড়া ক্ষেত্রে জায়গা গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তার কথা মাথায় রেখে তৎকালীন মুসলিমরা মুসলিম ইনস্টিটিউট গড়ার পরিকল্পনা নেন।১৯০২ সালের জুলাই মাসে আলিয়া মাদ্রাসা সংলগ্ন জমিতেই মুসলিম ইনস্টিটিউট হলের বাস্তবায়নের শুরু হয়। আলিয়া মাদ্রাসার কমন রুমে শুরু হয় স্বপ্নের মুসলিম ইনস্টিটিউট। প্রথম সম্পাদক আইএএস মৌলানা কামালউদ্দিন আহমেদ। প্রথম প্রেসিডেন্ট তৎকালীন কলকাতা মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিএইচএ স্ট্রাক।আর কোষাধ্যক্ষ ড.স্যার ই ডেনিসন রস। বহু কৃতি মুসলিম ব্যক্তিত্ব ইনস্টিটিউটের সদস্য ছিলেন। তাছাড়া স্যার গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, শের ই বাংলা এ কে ফজলুল হক, খাজা নিজামুদ্দিন, এইচ এস সোহরাবরদি, সুলতান আহমেদ প্রমুখ ওই প্রতিষ্ঠানের সদস্য ছিলেন। এই সব খ্যাতিমান ব্যক্তির সঙ্গে হাল আমলের রাজ্য সভার সাংসদ নাদিমুল হক বর্তমানে এই প্রতিষ্ঠানের সভাপতি। বর্তমানে এই ঐতিহ্য মণ্ডিত প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন মৌলানা আজাদ কলেজের উর্দু বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক দবির আহমেদ, ডেপুটি মেয়র ইকবাল আহমেদ, জামিল মঞ্জিল, সৈয়দ মহঃ আশরাফ, মহম্মদ উমর খান, মহ নুরুদ্দিন সহ প্রমুখ। তবে মুসলিম ইনস্টিটিউটের বাস্তব রূপ পেতে শুরু করে ১৯৩১ সালে নিজস্ব ভবন তৈরির মাধ্যমে। তৎকালীন রাজ্য সরকার বার্ষিক ৩০০ টাকা অনুদান ও উন্নয়ন বাবদ ৩১৫০ টাকা সহ জমি দান করে। আর সভার প্রশিক্ষণের জন্য গোলতালার পুকুরও দেওয়া হয়। মুসলিম ইনস্টিটিউট গড়ে ওঠার পর তার উন্নয়নে ১৯৭৬ সালে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধার্ত শংকর রায় ২০ হাজার টাকা অর্থ বরাদ্দ করেছিলেন। আর মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বাধীন সরকার বেশ কয়েক লক্ষ টাকা অনুদান দিয়েছে যা পূর্ত দফতরের তত্বাবধানে সংস্কারের জন্য। তবে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা প্রসঙ্গে নিসার আহমেদ জানান, কয়েক লক্ষ টাকা ব্যয়ে মাল্টি জিম সহ টেবিল টেনিস ক্রীড়া সরঞ্জাম আধুনিকীকরণ হয়েছে।আরও উন্নত করা হবে। সেইসঙ্গে লাইব্রেরিকে কেন্দ্র করে সংস্কৃতিক গবেষণা কেন্দ্র গড়ে তোলার ভাবনাও রয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back To Top