রামমন্দিরের স্বপক্ষে বিচিত্র সাফাই / ৪

শিবাজীকে নিয়ে হিন্দুত্ববাদী অস্মিতা হীনতাপূর্ণ

মল্লজীর সাথে বিয়ে হয় দীপাবাইয়ের। বিয়ের পর কেটে যায় অনেকগুলি বছর। দম্পতি চান তাদের ঘর আলো করে আসুক এক সন্তান। কিন্তু বহু প্রতীক্ষার পরেও প্রার্থিত সন্তান না আসায় মল্লজী একদিন আহম্মদনগরের প্রখ্যাত পীর শাহশরীফের শরণাপন্ন হন। সকাতরে আপন মনস্কামনার কথা ব্যক্ত করেন পীর সাহেবের কাছে। পীর সাহেব মল্লজীর হয়ে সন্তান প্রার্থনা করেন আল্লাহর কাছে। এই ঘটনার অনতিকালের মধ্যেই দীপাবাইয়ের গর্ভে সন্তান আসে। সেই সন্তান ভূমিষ্ঠ হয় ১৫৯৪ সালের ১৮ ই মার্চ। পীর সাহেবের নামানুসারে সন্তানের নাম রাখা হয় শাহজী। এই শাহজীই হলেন ছত্রপতি শিবাজীর পিতা।
শিবাজীর পিতামহ মল্লজী আহম্মদনগরের সুলতানের অধীনে পাঁচ হাজার অশ্বারোহী সৈন্যের সেনাপতি ও রাজা খেতাব পান। সুবর্ণি ও চাকন দুর্গ এবং পার্শ্ববর্তী এলাকার ভারপ্রাপ্ত হন। জায়গীর স্বরূপ পান পুণা ও সোপানগর। ১৬০৪ খ্রিস্টাব্দে শিবাজীর বাবা শাহজীর সাথে জীজী ওরফে জীজাবাইয়ের বিয়েতে উপস্থিত ছিলেন আহম্মদনগরের সুলতান স্বয়ং।
এই রকম এক পারিবারিক প্রতিবেশে শিবাজী বেড়ে উঠেছিলেন বলেই যে পরবর্তীকালে হিন্দুত্ববাদের প্রতিভূ হয়ে উঠতে পারেন না — এমন সরল সিদ্ধান্ত করা যায় না বা করছিও না। ইতিহাসের পরিহাসে কত অবিশ্বাস্য কান্ডই তো ঘটে যায়! যেমন আজাদ হিন্দ বাহিনীর প্রতিষ্ঠাতা রাসবিহারী বসু জাপানে বসেই হিন্দু মহাসভার সদস্যপদে ছিলেন। এমনকি আরএসএস-এর প্রতিষ্ঠাতা ডাক্তার কেশব বলিরাম হেডগেওয়ার তাঁর ছাত্রাবস্থায় কলকাতায় থাকাকালীন বিপ্লবী রাজনীতিতে আকৃষ্ট হয়েছিলেন এবং তৎকালীন সময়ের সবচেয়ে শক্তিশালী গুপ্ত সংগঠন অনুশীলন সমিতির সাথেও যোগাযোগ হয়েছিল। সুতরাং অসাম্প্রদায়িক প্রতিবেশে বেড়ে উঠলেও শিবাজী পরবর্তীকালে যে হিন্দুত্ববাদী অস্মিতার প্রধান মুখ হয়ে উঠতে পারেন না — এমন কথা নির্বিচারে বলে দেওয়া যায় না! তাই ঐতিহাসিক তথ্যাদির সাহায্যে দেখে নেওয়া দরকার যে, ইতিহাস বিকৃতির মহানায়ক তথা বর্তমানের বিদ্বেষজীবী রাজনীতিকদের শিবাজী সম্পর্কিত মূল্যায়নের ন্যায্যতা কতখানি।
‘হিন্দুকুলতিলক’ তথা ‘মুসলমানের যম’ শিবাজীর অধীনে কাজ করতেন বহু মুসলমান। তাদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উঁচু পদে। শিবাজীর গোলন্দাজ বাহিনীর প্রধান ছিলেন ইব্রাহিম খাঁ। বলাবাহুল্য, সেই সময় সৈন্য বাহিনীর মধ্যে গোলন্দাজ বাহিনীর গুরুত্ব ছিল সবচেয়ে বেশি। ‘মুসলমান বিরোধী’ শিবাজী তেমন এক বাহিনীর প্রধান করেছিলেন একজন মুসলমানকে! শিবাজীর দূরদৃষ্টির দৃষ্টান্ত হিসেবে যথার্থই উল্লেখ করা হয় তাঁর নৌবাহিনী গঠনকে। অত্যন্ত শক্তিশালী সুসজ্জিত সেই সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান ছিলেন দৌলত খান। দৌলত খান নিশ্চয়ই হিন্দু বা অমুসলমান ছিলেন না! শিবাজীর পদাতিক বাহিনীর প্রধান ছিলেন নূর খাঁ বেগ। তাহলে দেখা যাচ্ছে, বিভিন্ন সেনাবাহিনীর প্রধান পদে মুসলমানদের বসিয়েছিলেন ‘মুসলমান বিদ্বেষী’ শিবাজী! এই সমস্ত সেনাপ্রধানরা শুধুমাত্র হিন্দু সৈন্যদের নেতৃত্ব দিতেন না, মুসলমান সৈন্যদের নিয়েই শিবাজীর হয়ে প্রাণপাত লড়াই করতেন।
এহো বাহ্য, শিবাজীর ব্যক্তিগত দেহরক্ষীদের মধ্যে ছিলেন মাদারি মেহতাব নামে এক মুসলিম যুবক। এই যুবক শিবাজীর এতটাই বিশ্বস্ত ছিলেন যে আগ্রা থেকে পালানোর নাটকীয় ঘটনায় তাঁকে সাহায্য করেছিলেন এই যুবক। একা মাদারি মেহতাব নন, শিবাজীর বিশ্বস্ত সেবক ছিলেন এমন আরও অনেক মুসলমান। তাদের মধ্যে কাজী হায়দার ছিলেন অন্যতম। কাজী হায়দার প্রসঙ্গে এসে যায় সম্রাট আওরঙ্গজেবের কথা, যাঁকে হিন্দুত্ববাদীরা তীব্র হিন্দুবিদ্বেষী রূপে তুলে ধরতে ভালোবাসেন। সালেরি যুদ্ধের পর ওরঙ্গজেব এক ব্রাহ্মণকে দূত হিসেবে শিবাজীর কাছে পাঠিয়েছিলেন মিত্রতার প্রস্তাব দিয়ে। পক্ষান্তরে শিবাজী তাঁর দূত হিসেবে পাঠিয়েছিলেন কাজী হায়দারকে। শিবাজীর অধীনে কাজ করতেন সিদ্দি হিলাল। এই মুসলমান সিদ্দি হিলাল তার ছেলে ভাউয়াকে সঙ্গে নিয়ে যুদ্ধ করেছিলেন আরেক মুসলমান সিদ্দি জোহরের বিরুদ্ধে। পানহালা দুর্গ দখলের সেই যুদ্ধে আহত ও বন্দী হয়েছিলেন ভাউয়া। সপ্তদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে বিজাপুর সেনাবাহিনীর প্রায় ৭০০ পাঠান সেনা শিবাজীর বাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন।
এইসব তথ্য থেকে এই সত্যে উপনীত হওয়া যায় যে, মুসলমান শাসকদের সাথে হিন্দু শাসক শিবাজীর লড়াইয়ের চরিত্র কখনোই ধর্মীয় ছিল না, তা ছিল পুরোপুরি আর্থ-রাজনৈতিক । বিস্তর গবেষণার পর উপযুক্ত তথ্য প্রমাণ সহকারে ‘Who was Shivaji’ গ্রন্থে হিন্দুত্ববাদীদের প্রচারিত শিবাজী- মিথ ভেঙেচুরে একেবারে ছত্রখান করে দিয়েছেন অবিসংবাদী বর্ষিয়ান বামপন্থী নেতা গোবিন্দ পানসারে। উগ্র ধর্মান্ধদের বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থান গ্রহণ করার অপরাধে ৮২ বছর বয়সী প্রবীণ ইতিহাস গবেষক ও সমাজবেত্তা মানুষটিকে ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে নৃশংসভাবে হত্যা করেছে হিন্দুত্ববাদী ঘাতকরা।
কিন্তু সত্যসন্ধানীদের হত্যা করে কখনোই ইতিহাসের সত্যকে মুছে ফেলা যায় না। টিপু সুলতানের তরবারি যেমন হিন্দুত্ববাদের খাপে আঁটে না, তেমনি একইভাবে বিদ্বেষবাদী প্রচারের দ্বারা ছত্রপতি শিবাজীর হিন্দু অস্মিতার গালগপ্পও কোনদিন ইতিহাস ও যুক্তির ধোপে টিকবে না ! (চলবে)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back To Top