মাসুমবাজার থেকে কাশিমবাজারঃ এক প্রাচীন বন্দর নগরী

মোহাম্মদ সাদউদ্দিন

 

জরাজীর্ণ অবস্থায় দাড়িয়ে কাশিমবাজার কুঠি

কাশিমবাজার নামটি উচ্চারণ করলেই সর্বপ্রথম ভেসে আসে কাশিমবাজার কুঠী কিংবা কাশিমবাজার রাজবাড়ি, অথবা গভর্নর জেনারেল ওয়ারেল হেস্টিংসের কবর। কিন্তু তারও বহু আগে কাশিমবাজারের সুপ্রাচীন ইতিহাস রয়েছে। আজকের যেটা কাশিমবাজার প্রকৃতপক্ষে সেটির নাম মাসুমবাজার। ‘মাসুম’ একটি উর্দু শব্দ। যার অর্থ শিশু। এখানে শিশু-বিক্রি করা হতো বলে এই জনপদের নাম হয় ‘মাসুমবাজার’। আসলে মাসুমবাজার থেকে কাশিমবাজার হল কী ভাবে? এই ইতিহাস জানতে গেলে আমাদের একটু আরও অতীতের দিকে ফিরে যেতে হবে। মুর্শিদাবাদের অন্যতম নবাব মীর কাশিম আলির নামানুসারে কাশিমবাজারের নামকরন হয়েছে বলে আধুনিক ইতিহাসবিদদের অনেকেই অভিমত পোষণ করেন। কিন্তু প্রকৃত ইতিহাস অন্য কথা বলে। আসুন আমরা সেই ইতিহাসের দিকে একটু অগ্রসর হই।

ইসলামিক জলসা সম্পর্কে লেখা অসাধারণ একটি লেখা
ডাচ কবরস্থান। যেখানে রয়েছে ওয়ারেন হেস্টিংস এর স্মৃতি

 

মোগল সম্রাট শাহজাহান তখন দিল্লির বাদশাহ। তার অন্যতম সেনাপতি কাশিম আলি খাঁ-কে বাংলার পর্তুগীজ অধ্যুষিত হুগলীতে পাঠান। হুগলীকে পর্তুগীজদের কবলথেকে অধিকার করে তার বজরা ভাগীরথী নদীর উপর ছুটিয়ে দেন কাশিম আলি। শেষ পর্যন্ত হুগলী, কালনা, কাটোয়া, বহরমপুর হয়ে কাটিগঙ্গার ধার ঘেঁষা মাসুমবাজারে পৌঁছান কাশিম আলি খাঁ। মাসুমবাজারের নিষ্ঠুর শিশু বিক্রির ঘটনা বন্ধ করে দেন। মাসুমবাজারের নামকরন করা হয় কাশিমবাজার। কাশিমবাজার কাটিগঙ্গার ধারে গড়ে উঠে একটি বন্দর নগরী হিসাবে। মোগল আমলের তৈরি হওয়া বন্দর-নগরী কাশিমবাজার বাংলার নবাবী আমল ও পরে ইংরেজ আমলে তার শ্রীবৃদ্ধি ঘটে। একটি বন্দর নগরী হিসাবে কাশিমবাজারের আত্মপ্রকাশ ঘটে। রাজশাহী আর মুর্শিদাবাদের সিল্ক, জিয়াগঞ্জের বালুচুরি, ঢাকার মসলিন, জামদানি কাশিমবাজার বন্দর নগরীর মাধ্যমে ইউরোপ পাড়ি দিত। কাশিমবাজার পূর্বভারতের ‘বাণিজ্য বসতি লক্ষ্মী’। ফরাসী, ইংরেজ, ওলন্দাজ, দিনেমার, আর্মেনীয়, আরব্য ও পারস্য থেকে জাহাজ কাশিমবাজার বন্দরে ভিড় করতো। আর রেশম, তাঁতবস্ত্র, মোম, লাক্ষা, সোরা, নীল, ঘি, লঙ্কা প্রভৃতি কাশিমবাজার থেকে বিদেশে রপ্তানি হোতো। দেশ-বিদেশের অজস্র জাহাজ কাশিমবাজারে আসতো। এই সেই কাশিমবাজার যেখানে আর্মেনীয়, ডাচ, ইংরেজ – এই তিন জাতির ইউরোপীয় সমাধীক্ষেত্র রয়েছে। তার মধ্যে গভর্নর জেনারেল ওয়ারেল হেস্টিংসের ও তার পরিবারের সদস্যদের সমাধীক্ষেত্র পর্যটকদের কাছে আকর্ষণ বেশি। ১৬৮০ খ্রিষ্টাব্দে জব চার্ণক কাশিমবাজার কুঠির প্রধান ছিলেন। ১৭৭৫ খ্রিষ্টাব্দে টাভের নিয়ার কাশিমবাজার আসেন। কাশিমবাজার বন্দরনগরী থেকে প্রতিবছর গড়ে কুড়ি হাজার বাক্স রেশম বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যেত। ফরাসী-রাজা চতুর্দশ লুই কাশিমবাজারে তৈরি সিল্কের পোশাক পরতে ভালবাসতেন। ফরাসী রাজার দরবারে মুর্শিদাবাদের সিল্কের বিশেষ সম্মান ছিল। নবাব মুর্শিদকুলি খাঁ ১৭০৪ সালে রাজধানী ঢাকা থেকে মুর্শিদাবাদে স্থানান্তরিত করার পরই কাশিমবাজারের জৌলুষ ও মর্যাদা আরও বাড়তে থাকে। মুর্শিদাবাদ শহর থেকে কাশিমবাজারের দূরত্ব মাত্র তিন কিলোমিটার বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার রাজধানী মুর্শিদাবাদ হওয়ার সুবাদে কাশিমবাজারের মান-মর্যাদা আরও বেড়ে যায়। গগনস্পর্শী অট্টালিকায় এই বন্দরে দৈনিক ৫০ থেকে ৬০ টি জাহাজ যাওয়া আসা করত রেশম বোঝায় করে। এমনই একটি বন্দর নগরী যেখানে বৌদ্ধ-জৈন-হিন্দু ও ইসলামী সংস্কৃতি মিলেমিসে একাকার। জৈন তীর্থঙ্কর নোমিনাথের মন্দির, ব্যাসপুরের শিবমন্দির, বিষ্ণুপুরের কালীমন্দির, কালিকাপুরের মসজিদ মহাকালের করাল গ্রাসে আজ নিশ্চিহ্ন। কাশিমবাজারের বিখ্যাত হাতে তৈরি কাগজ। সারা বিশ্বে তার কদর ছিল। প্রকৃতির নিষ্ঠুর পরিহাসে পলিমাটি জমে জমে কাটিগঙ্গা তার নব্যতা হারিয়ে ফেলে। তাই ক্রমশ বন্দর নগরী তার সেইরূপ হারিয়ে ফেলে। আর সেই পলিমাটি তুলে কাটিগঙ্গার গভীরতা বাড়ানোর কোনও চেষ্টা ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি করেনি। কোম্পানি তার যাবতীয় সম্পত্তি বিক্রি করে দিয়ে কলকাতায় পাড়ি দিল। আর বন্দর নগরী কাশিমবাজার ক্রমশই নিস্তেজ হয়ে পড়ে রইল। কাশিমবাজার শিয়ালদা-লালগোলা শাখার একটি রেলস্টেশন। ইতিহাস যেন ডুকরে ডুকরে কাঁদে।

আরও পড়ুন :পশ্চিমবঙ্গের ওয়াকফ সম্পত্তি
Back To Top