হে স্বাধীনতা, আচ্ছে দিন কবে আসবে? ~মুহাম্মদ হেলালউদ্দিন

বাহাত্তরতম স্বাধিনতা দিবস। এক এক করে স্বাধীনতার একাত্তর বছর কেটে গেল। স্বাধীনতার সঙ্গে পার্টিশন বা দেশভাগ তথা বাংলা ভাগ শব্দটা বেশ জড়িয়েছিল। তার সঙ্গে জড়িয়ে উদ্বাস্তু, শরণার্থী, অনুপ্রবেশ। ‘এ আজাদি মুক্ত হ্যাঁয়’ স্লোগানও জড়িত। স্বাধীনতা ৭১, ৭০ ছুল ডলার। টাকার দামের এমন পতন এর আগে কখনও হয়নি। ‘আচ্ছে দিন আসছে’। মাভৈ মাভৈ নৃত্য করে।

খান আব্দুল গাফফর খান কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির একমাত্র সদস্য যিনি দেশভাগের বিরুদ্ধে ভোট দেন। প্রায় সজলনেত্রে বলেন “হাম তো তাবাহ হো গায়ে”। গান্ধীজীকে বলেছিলেন তাহলে এরপর থেকে আমাদের বিদেশী বা পাকিস্থানি বলে গণ্য করবেন, তাই না?

প্রভাতি দৈনিকের প্রথম পাতায় ৫০ পয়েন্টে হেডিং ‘সার্থকজনম…! সাব হেডিং ‘দেশপ্রেমে মুগ্ধ দেশ, হায়দার নিজেই দেশহীন’। তারপর ’১৫ আগস্ট ২০১৭। দেশ জুড়ে ‘ভাইরাল’ এই ছবি। অসমে দক্ষিণ শালমারার বানে ডোবা স্কুলে দেশের পতাকা উঠেছে। গলা জলে দাঁড়িয়ে সেলাম ঠুকছে আদুল গায়ে দুই খুদে ছাত্র। পাশে প্রধান শিক্ষক’। পোস্ট কার্ড মাপের দুটি ছবি। একটি ১৫ আগস্ট, ২০১৭ বানভাসী স্কুলে হায়দারের তেরঙ্গাকে কুর্নিশ। দ্বিতীয়টি ১৪ আগস্ট ২০১৮, মায়ের সঙ্গে হায়দার আলি খান। সে এখন বিদেশী। গাফফার খান স্বাধীনতার প্রাক্কালে হয়েছিলেন বিদেশী আর আজ দেশহীন হায়দার আলি খান। মেরা ভারত মহান! স্বাধীনতা তুমি!

১৯৪৭ সালের ক্ষমতা হস্তান্তরের কিছুদিন পড়ে হাজার হাজার মানুষের সমাবেশ আসামে কংগ্রেসের জনসভা। মুসলিম অধ্যুষিত এলাকায় সমাবেশে যেদিকে তাকায় সেদিকে শুধু দাঁড়ি আর টুপির ছড়াছড়ি । মঞ্চে উপবিষ্ট কংগ্রেস নেতারা তো হতবাক। জনৈক নেতা মন্তব্য করেন –‘পাকিস্থান হওয়ার পরেও এই দৃশ্য। ১৯৪১ আদমসুমারিতে আসামের মুসলিম জনসংখ্যা ছিল ২৫ শতাংশ। এখন ৮০ বছর পরে মুসলিম মুসলমান জনসংখ্যা ৩৩ শতাংশ, বেড়েছে মাত্র ৮ শতাংশ। ২০০১ সালের আদমসুমারি অনুযায়ী, আসামে জনসংখ্যা বেড়েছে ১৮.৯ শতাংশ। আর জাতীয় জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ২১.৫ শতাংশ। ২০০১ থেকে ২০১১ পর্যন্ত আসামে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ১৬.৯ শতাংশ। জাতীয় জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ১৭.৬ শতাংশ। তাহলে দেখা যাচ্ছে জাতীয় জনসংখ্যার বৃদ্ধির হারের চেয়ে সব সময় কম। তাহলে আসামে বাংলাদেশি অনুপ্রবেশের জন্য জনসংখ্যা বাড়ছে এ প্রচার এক ভ্রান্তি ছাড়া আর কি হতে পারে? বন্ধ হোক এই মিথ্যা প্রচার।

বামসেফের রাষ্ট্রীয় অধ্যক্ষ ওয়ামন মেশ্রাম চৌত্রিশতম রাষ্ট্রীয় অধিবেশনে অমৃতসর (পাঞ্জাব ২০১৭) তার বক্তব্যে বলেছিলেন –ভারতে সাড়ে তিন শতাংশ বিদেশী ব্রাহ্মণদের পাঁচটি রাজনৈতিক দল ২০০৯ লোকসভায় তিনশো পঁচাত্তরটি তারা কব্জা করেছিল। ২০১৪ সালে চারশো এগারোটি আসন ব্রাহ্মণ এবং উচ্চজাতির কব্জায় অর্থাৎ ভারতের আইনসভা সাড়ে তিন শতাংশ ব্রাহ্মণদের কব্জায়। কার পালিকায় লোকসভার রিপোর্ট অনুযায়ী ৭৯.২ শতাংশ আইএসএম, আইপিএস, আইআরএস ব্রাহ্মণ এবং উচ্চজাতির কব্জায়। বিচার ব্যবস্থায় ৯৭ শতাংশ সুপ্রিমকোর্ট এবং হাইকোর্টের বিচারপতি ব্রাহ্মণ এবং ততসম উচ্চবর্ণের লোকেরা। ভারতের মিডিয়া ব্রাহ্মণ এবং বেনিয়াদের দখলে। ভারতের সমস্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলরের পদ ব্রাহ্মণ এবং উচ্চজাতির দখলে। ভারতের গণতন্ত্রের সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ বড় বড় পদ ব্রাহ্মণদের কবজায়। ভারতে গণতন্ত্র নয় ব্রাহ্মণতন্ত্র কায়েম হয়েছে’।

মর্তের ঈশ্বর ব্রাহ্মণ উচ্চবর্ণ। বাকিরা সব ঐশ্বরিক দাস। ব্রাহ্মণেরা দুটি দলে বিভক্ত। গোঁড়া ব্রাহ্মণরা আরএসএস কে নিয়ন্ত্রণ করে আর প্রগতিশীল ব্রাহ্মণরা কম্যুনিস্ট দল সহ অন্যান্য সব জাতীয় দলগুলি নিয়ন্ত্রণ করে। ব্যাপার এমনই যে দলই জিতুক না, দেশ শাসন একমাত্র ব্রাহ্মণদের হাতে থাকবে। ব্রাহ্মণ বেনিয়ারা দেশের নিয়ন্ত্রক।

বেনিয়া গান্ধী মহাত্মা (!) জাতির জনক (!) ছিলেন হিন্দু বর্ণাশ্রম ধর্মের কট্টর সমর্থক। অর্থাৎ মেথর কিংবা কামারের ছেলে মেথর কিংবা কামারই থাকবে। অধ্যাপক কিংবা বিমান চালক হবে না, অধ্যাপকের ছেলে অধ্যাপকই হবে; স্যানিটেশন ইঞ্জিনিয়ার কিংবা চাষি হবেনা।

বর্ণাশ্রম ও জাতপাত সম্বন্ধে তিনি এতটাই স্পর্শকাতর ছিলেন যে হিন্দু মুসলমানের ঐক্যের ভিত্তিতে খিলাফত আন্দোলন চালানোর সময়ে তিনি মুসলমানের ছোঁয়া খাবার খেতেন না, এমনকি আন্দোলনের সহ পরিচালক মৌলানা শওকাত ও মৌলানা মহম্মদ আলির ছোঁয়া খাবারও না। তাঁর এই মনোভাব আলি ভাতৃদ্বয়কে আহত করত, হয়তো ক্ষুদ্ধও করেছিল। গান্ধীজী অবশ্য বলেছিলেন, আলি ভাতৃদ্বয় নাকি অতি সযত্নে (তাঁর) এই ধর্মান্ধতাকে শ্রদ্ধা করতেন’। তাঁর মতে ওটা ধর্মান্ধতা নয়, আত্মনিগ্রহ’। (চেতনা লহর, বর্ষ ৮, যুগ্ম সংখ্যা জানুয়ারি, জুন ২০১৮ হরিজনদের হিন্দু ধর্ম ত্যাগ, গান্ধী বনাম রবীন্দ্রনাথ আশিস লাহিড়ী, পৃষ্ঠা ৮)।

আর একজন ব্রাহ্মণ ‘এক্সিডেন্টালি কমউনিস্ট’ সোমনাথ চ্যাটার্জি। সিপিএম তাঁর কাছে ছিল নেসেসারি ইভিল। তিনি বলেছিলেন –আমাদের চ্যাটুজ্জেদের তিন প্রজন্ম এই বাড়িটা থেকে পাস করে বেরিয়েছে, এমন নজির বিশেষ একটা খুজে পাবে বলে মনে হয়না। জ্যোতিবসু আর সোমনাথ চট্টোপাধ্যায় বাংলায় শিল্প বিপ্লবের জন্য পুঁজির সন্ধানে প্রায়ই বিদেশে যেতেন, ইউরোপে, আমেরিকা, মায় ইজরায়েলেরও। তিনি স্বাধীনতা দিবসের দুদিন আগে আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন। স্বাধীনতা তুমি। জহরলাল নেহেরু নিয়মিত আরএসএস অফিসে যেতেন। তিনি হেডগেওয়ারকে কংগ্রেস থেকে আর থেকে বেরিয়ে আরএসএস করার জন্য বলতেন।

হুগলী জেলার পান্ডুয়ার তালান্ডুর মালিপাড়া গ্রামে সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়ের বাবা নির্মল চট্টোপাধ্যায়ের পরিবার থাকতেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় কলকাতা ছেড়ে সোমনাথবাবু পৈতৃক বাড়িতেই এসে উঠেছিলেন। ওই এলাকায় চট্টোপাধ্যায় পরিবারে প্রতিষ্ঠিত ৬০০ বছরের পুরনো বুড়ি মা দুরগার মন্দির। কাজের চাপে সোমনাথ বাবু আসতে না পারলেও প্রত্যেক বছর এই পূজার জন্য খরচের টাকা পাঠাতেন। ‘এক্সিডেন্টালি কমিউনিস্ট’ তাই বুঝি পূজাতে টাকা পাঠাতেন।

জন্ম ২৫ জুলাই ১৯২৯ সালে আসামের তেজপুরে। মৃত্যু ১৩ আগস্ট ২০১৮। বাবা নির্মল নির্মলচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ছিলেন হিন্দুমহাসভার অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। হিন্দু মহাসভা থেকে প্রতিনিধিত্ব করে হুগলীর সাংসদ হয়েছিলেন। সোমনাথ বাবুর স্ত্রী রেণু চট্টোপাধ্যায় লালগোলা জমিদার পরিবারের সন্তান ১৯৪৮ সালে নেহেরু সরকার কমউনিস্ট পার্টিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করলে বন্দী কমিউনিস্টদের মুক্তির দাবীতে হিন্দু মহাসভার নেতা নির্মল চট্টোপাধ্যায়ের উদ্যোগে গঠিত হয় অল ইন্ডিয়া সিভিল লিবার্টিজ ইউনিয়ন। ১৯৬৮ কমউনিস্ট পার্টির নেতা জ্যোতিবসুর সঙ্গে সোমনাথবাবুর ঘনিষ্ঠতা, ১৯৭১ লড়েছিলেন সিপিএম সমর্থিত নির্দল প্রার্থী হিসাবে, বাবা নির্মল চট্টোপাধ্যায় মৃত্যুর পর, বর্ধমান লোকসভা থেকে জয়ীও হন।

সোমনাথ চট্টোপাধ্যায় কমউনিস্টদের একজন জবরদস্ত নেতা হলেও তাঁর ঘরে কোন কমউনিস্ট নেতার ছবি থাকত না। সে কার্লমার্কস, লেলিন, এঙ্গেলস বা অন্য কারও। ছবি থাকত জ্যোতিবসু ও রবীন্দ্রনাথের। তিনি শেষ জীবনে থিতু হন রবীন্দ্রনাথের কর্মক্ষেত্র শান্তিনিকেতনে।

১৯৯৪ সালে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতিবসু শিল্পায়ণের জন্য তৎপর হন। সেই সময় কাজের গতি আনতে শিল্পবন্ধুর ভাবমূর্তির সোমনাথবাবুকে শিল্পউন্নয়ন নিগমের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব দেন। সেই সময় শান্তিনিকেতনের খোয়াই ধ্বংস করে বিভিন্ন বাণিজ্যিক সংস্থাকে মদত দেওয়ার অভিযোগ উঠেছিল। তিনি তখন বোলপুরের সাংসদ ছিলেন।

হায় স্বাধীনতা তুমি –কি দিলে তুমি। এক বুক  হতাশা ছাড়া। তবুও স্বাধীনতা সস্বাধিনতাই।

 

(মতামত লেখকের নিজস্ব)

(Exclusive partnership with Dunia Bangla Weekly)

Back To Top