বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ঃ সাম্প্রদায়িকতা, হিন্দুত্ববাদ এবং কিছু কথা – 2

মোহাম্মদ সাদউদ্দিন

পূর্ববর্তী সংখ্যার পর… 

বাংলাদেশের ঢাকা থেকে প্রকাশিত সাহিত্য পত্রিকা (মাসিক) ‘নতুন এক মাত্রা’-র শরৎসংখ্যার (২০১৮) একটি নিবন্ধ আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করে। নিবন্ধটির নাম ‘আহম্মদ ছফার বঙ্কিম বিচার’। নিবন্ধকার আবুল কাসেম ফজলুল হক। আমি ব্যক্তিগত ভাবে তাকে শ্রদ্ধাও করি। নিবন্ধটির মধ্যে আহম্মদ ছফার বঙ্কিম বিরোধিতার বিরোধটাকে এমনভাবে উপস্থাপন করেছেন হক সাহেব তাতে বঙ্কিম যেন মোটেই মুসলিম বিদ্বেষী ছিলেন না বা হিন্দুত্ববাদকে সেভাবে প্রশ্রয় দেননি। হক সাহেবের এই বঙ্কিম সাফাই নতুন কিছুই নয়। বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের বেশকিছু লেখক- গবেষক নতুন করে বঙ্কিমকে সাফাই দিতে চাইছেন। বঙ্কিমের সাম্প্রদায়িক মনোভাবকে লুকোতে চাইছেন। শান্তনু কায়সার, সারোয়ার জাহান, অধ্যাপিকা সৈয়দা তানভীর নাসরিন সহ বেশ কিছু লেখক-গবেষক বঙ্কিমকে নানান ভাবে আড়াল করতে চাইছেন। শান্তনু কায়সার তাঁর ‘বঙ্কিমচন্দ্র’ গ্রন্থের ভূমিকায় আব্দুল ওদুদের ভাষণকে ব্যাবহারও করেছেন। বঙ্কিম জন্ম শতবর্ষে আব্দুল ওদুদ ঢাকার জগন্নাথ কলেজে আয়োজিত (এখন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়) ‘মুসলিম-বিদ্বেষ’ শীর্ষক একটি আলোচনা সভায় বলেছিলেন, ‘বঙ্কিমচন্দ্র মুসলিম বিদ্বেষী ছিলেন এ অভিযোগ তিনি করিতে পারেননা, তবে তিনি হিন্দুত্বকে প্রয়োজনের অতিরিক্ত পরিমাণে প্রচার করিয়াছেন বলিয়া তিনি অভিযোগ করিতে পারেন’ (দ্রষ্টব্য বঙ্কিমচন্দ্র / শান্তনু কায়সার / কথা প্রকাশ, ঢাকা, বাংলাদেশ)। কাজী আব্দুল ওদুদ-এর প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়েই বলতে হয়, তিনি কিন্তু বঙ্কিমকে ‘অতিরিক্ত পরিমাণে’ হিন্দুত্বকে প্রচার করেছেন তা কিন্তু স্বীকার করেছেন। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তার ‘রাজসিংহ’ উপন্যাসের উপসংহারে নিজেই বলেছেন যে, ‘হিন্দু হইলেই ভাল হইবে, মুসলমান হইলেই খারাপ এমন কোনও কথা নাই’- ততক্ষণে ভারতবর্ষের আকাশে ও সাহিত্যের ক্ষেত্রভূমিতে হিন্দুত্ববাদ ও হিন্দু জাগরণ-এর উত্তাল প্রবাহ তৈরি হয়ে গিয়েছে। যার বিষময় ফল কিন্তু আমরা ভোগ করছি। কলকাতার রিফ্লেক্ট পাবলিকেশন প্রকাশিত ‘বঙ্কিম উপন্যাস সমগ্র’-র শেষাংশে বঙ্কিম পরিচিততে কাঞ্চন বসু জানিয়েছেন ‘যেহেতু ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের পটভূমিকায় বাংলাদেশের সন্ন্যাসী বিদ্রোহের ঘটনাকে জড়িয়ে এই উপন্যাসটি রচিত হয়েছিল, সেহেতু এটি প্রকাশের পর বহু পাঠকই জানতে আগ্রহী হয়েছিলেন, এই গ্রন্থের কোনও ঐতিহাসিক ভিত্তি আছে কি না! এর জবাবে বঙ্কিমচন্দ্র বলেছিলেন, ‘উপন্যাসে ও ইতিহাসে বিশেষ অনৈক্য আছে। যে যুদ্ধগুলি উপন্যাসে বর্ণিত হইয়াছে তাহা বীরভূম প্রদেশে ঘটে নাই। উত্তর বাংলায় হইয়াছিল………… এই ভুল আমি মারাত্মক বিবেচনা করিনা- কেননা উপন্যাস উপন্যাস, ইতিহাস নহে’। বঙ্কিমচন্দ্রের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই একথা বলা যায়না কি, যুদ্ধের স্থান পরিবর্তন হলেও ইতিহাসের ঘটনা প্রবাহ এড়িয়ে ইতিহাস মার্কা উপন্যাস রচনায় আসল ঐতিহাসিক ঘটনাকে উপেক্ষা করা উচিৎ কি? সন্ন্যাস বিদ্রোহ বা ফকির বিদ্রোহ যেখানে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে সংগঠিত হয়েছিল, সেখানে বঙ্কিমচন্দ্রের সন্ন্যাসীরা ব্রিটিশদের গুনগানে মুখরিত। ‘আনন্দমঠ’ উপন্যাসে সত্যানন্দ, ভবানন্দ কিংবা ধরানন্দ— প্রতিটি চরিত্রের মুখে মুসলিম নিন্দাই উচ্চারিত। আমাদের আরও স্মরণ করতে হবে যে, সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্রের অভিন্নহৃদয় বন্ধু ছিলেন বাংলার মুসলিম নবজাগরণের অগ্রনায়ক নবাব আব্দুল লতিফ। স্কট প্রভাবিত বঙ্কিমের প্রথম উপন্যাস ইংরেজিতে। আর তার নাম ‘Rajmohon`s Wife’। এই উপন্যাস রচনার ক্ষেত্রে লতিফের বিশেষ ভূমিকা ছিল। উৎসাহ ছিল। তার উপন্যাসটি তিনি সমাপ্ত করতে পারেননি। পরবর্তীতে সজনিকান্ত দাশ এটি ‘রাজমোহনের স্ত্রী’ নাম দিয়ে বাংলায় অনুবাদ করেন।

১৮৫৬ সালে ‘ললিতা তথা মানসেই’ কাব্যগ্রন্থ রচনার মাধ্যমে বঙ্কিমের বাংলা সাহিত্যে আগমন। সেখানে কিন্তু হিন্দু জাগরণ বা হিন্দুত্ববাদ সেভাবে আসেনি।‘আনন্দমঠ’ প্রথমে কিন্তু ছিল ব্রিটিশ বিরোধী। কিন্তু ব্রিটিশদের ঊর্ধ্বতন অফিসারদের চোখ রাঙানির ফলে উপন্যাসে হিন্দুত্ববাদ, হিন্দু জাগরণ এবং ব্রিটিশ স্তুতিকেই বঙ্কিম হাতিয়ার করেন। ব্রিটিশ সরকারের কড়া নির্দেশে বঙ্কিমের সাহিত্য হয়ে উঠল ব্রিটিশ-স্তুতি আর হিন্দু জাগরণ ও হিন্দুত্ববাদের মহামন্ত্র। আবার এক্ষেত্রে তিনি গুরু ঈশ্বরগুপ্তের পথকেই অনুসরণ করলেন। কবি ঈশ্বরগুপ্ত মুসলিমদের হেয় করার জন্য লিখেছেন–

কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত

“একেবারে মারা যায় প্যাজ খোর চাপ দেড়ে,

“হাঁসফাঁস করে যত প্যাজ খোর নেড়ে।।

বিশেষতঃ পাকা দাড়ি মোটা ভুড়ে।

রৌদ্র গিয়া পেটে ঢোকে নেড়ে মাথা ফুঁড়ে।।

কাজি কোল্লা মিয়াঁ মোল্লা দাড়ি পাল্লা ধরি।

কাছা খোল্লা তোবা তোল্লা বলে আল্লা মরি’’।।

ঈশ্বর গুপ্ত ‘দিল্লির যুদ্ধ’ কবিতায় লিখেছেন

“চিরকাল হয় যেন ব্রিটিশের জয়

ব্রিটিশদের রাজলক্ষ্মী স্থির যেন রয়

ভারতের প্রিয় পুত্র হিন্দু সম্প্রদয়

মুক্ত মুখে বল সবে ব্রিটিশের জয়’’।

পাঠকবর্গ নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন ঈশ্বরগুপ্তের কবিতায় হিন্দু জাগরণ ও ব্রিটিশ-স্তুতি কতখানি ফুটে উঠেছে। তার ‘সংবাদ প্রভাকর’ পত্রিকায় এই ভাবে ব্রিটিশ-প্রশংসা ও হিন্দু জাগরণের পরিধি বৃদ্ধি করেছিলেন। তাই ডেপুটি মাজিস্ট্রেট বঙ্কিমচন্দ্র গুরু ঈশ্বরগুপ্তের পথকেই অনুসরণ করেন। ঈশ্বরগুপ্তের সংবাদ প্রভাকরের ১৮৫৭ সালের ২২ জুনের সম্পাদকীয়তে লেখা হল ‘বন্য পশু শিকার নিমিত্ত শিকারিগণ যেমন পরমানন্দে দলবদ্ধ হয়ে গমন করে, শ্বেতাঙ্গ সৈন্যগন সেইরূপ পুলকিত চিত্তে সিপাহী শিকারে গমন করিতেছে, নরাধম অকৃতজ্ঞ দিগের আর রক্ষা নেই……’। ঈশ্বরগুপ্তের এই নরাধম ‘অকৃতজ্ঞ’ নিশ্চয়ই মুসলিম বিদ্রোহীরা। আর এতেই বোঝা যায় ঈশ্বরগুপ্তের মুসলিম বিদ্বেষ কোন পর্যায়ে ছিল।

ক্রমশ…………

Back To Top