বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ঃ সাম্প্রদায়িকতা, হিন্দুত্ববাদ এবং কিছু কথা – 3

মোহাম্মদ সাদউদ্দিন

আর এই ঈশ্বরগুপ্তের যোগ্য উত্তরসূরি সাহিত্য সম্রাট ঋষি বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ঐতিহাসিক মার্কা উপন্যাস ও পৌরাণিক মিথ সমন্বিত প্রবন্ধ সাহিত্য রচনা করতে গিয়ে হিন্দুত্ববাদ ও হিন্দু জাগরণকে দক্ষ কারিগরের মত সাহিত্যে আমদানি করলেন এবং ব্রিটিশদের জয়গান করলেন। নবাব আব্দুল লতিফের একজন অভিন্ন হৃদয় বন্ধু হিসাবে তিনি এতখানি ডিগবাজি মারবেন, তা ধারনার বাইরে। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ১৮৬৫ থেকে ১৮৮৭ সাল পর্যন্ত ২২ বছরে ১৪ খানি উপন্যাস রচনা করেন। এছাড়াও তার প্রবন্ধ গ্রন্থের সংখ্যা ১১ টি। বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাসগুলি হল ১. দুর্গেশ নন্দিনী (১৮৬৫), ২. কপাল কুন্ডলা (১৮৬৬), ৩. মৃণালিনী (১৮৬৯), ৪. বিষবৃক্ষ (১৮৭৩), ৫. ইন্দিরা (১৮৭৩), ৬. যুগলাঙ্গরীয় (১৮৭৪), ৭. চন্দ্রশেখর (১৮৭৫), ৮. রজনী (১৮৭৭), ৯. কৃষ্ণ-কান্তর উইল (১৮৭৮), ১০. রাজসিংহ (১৮৮২), ১১. আনন্দমঠ (১৮৮৪), ১২. দেবী চৌধুরানী (১৮৮৪), ১৩. রাধা রানী (১৮৮৬), ১৪. সীতারাম (১৮৮৭)।

এছাড়াও বঙ্কিমের ১১ টি প্রবন্ধ গ্রন্থ হল ১. লোক রহস্য (১৮৭৪), ২. বিজ্ঞান রহস্য (১৮৭৫), ৩. কমলা কান্তের দপ্তর (১৮৭৫), ৪. বিবিধ সমালোচনা (১৮৭৬), ৫. সাম্য (১৮৭৫), ৬. প্রবন্ধ পুস্তক (১৮৭৯), ৭. কৃষ্ণ চরিত্র (১৮৮৬), ৮. বিবিধ প্রবন্ধ (প্রথম ভাগ- ১৮৮৭), ৯. ধর্মতত্ব (১৮৮৮), ১০. বিবিধ প্রবন্ধ (দ্বিতীয় ভাগ- ১৮৯২), ১১. শ্রীমদ্ভগবদগীতা (প্রচার পত্রিকায় ১২৯২ ও ১২৯৫ বঙ্গাব্দে প্রকাশিত হয়)।

আমাদের একটা কথা স্বীকার করতে হবে ভারতে প্রকৃত ইতিহাস চর্চার দিশারি আরব্য, তুর্কি বা পার্সিয়ান ঐতিহাসিক ও ইতিহাসবিদরা। ইংরেজ ঐতিহাসিক ও ইতিহাসবিদরা হলেন তার অনুবাদক মাত্র। আর এই অনুবাদের কাজটি করতে গিয়ে তারা অনেকেই ইতিহাস বিকৃতি ঘটিয়েছেন। ব্রিটিশ শাসিত ভারতের বেশিরভাগ ভারতীয় ঐতিহাসিক-লেখক-গবেষক-ইতিহাসবিদরা সেই পথকেই অনুসরণ করেছেন যা দুঃখের হলেও সত্য। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের প্রথম উপন্যাস ‘দুর্গেশ নন্দিনী’-তে সেই ইতিহাস বিকৃতিরই ঘটনাটি ঘটেছে। ইতিহাস প্রামাণ্য নয় এমন ঘটনারও অনুপ্রবেশ ঘটিয়েছেন। এর মূল ঘটনাটি বঙ্কিমচন্দ্র সংগ্রহ করেছেন চার্লস স্টুয়ার্টের ‘হিস্ট্রি অফ বেঙ্গল’ থেকে। প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ ও ঐতিহাসিক যদুনাথ সরকার তার ‘ভুমিকাঃ দুর্গেশ নন্দিনী’ গ্রন্থে (বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ, পৃ-১১, কলকাতা) যথার্থ ভাবেই বলেছেন ‘ডাও সাহেবের মেকী ইতিহাস হইতে লইয়াছেন ক্যাপ্টেন চার্লস স্টুয়ার্ট’। তাই একথা বলা হয়তো অসঙ্গত হবেনা, ‘দুর্গেশ নন্দিনীতে ইতিহাস বিকৃত ঘটেছে। প্রকৃত ঐতিহাসিক তথ্যকে বিকৃত করা হয়েছে’। এই উপন্যাসে আয়েশা চরিত্রকে বঙ্কিম বিকৃত করেছেন। ইতিহাস কাঠামোর উপর নিজের কল্পনার রঙ চাপিয়েছেন। ‘তাই দুর্গেশ নন্দিনী’ হয়ে পড়েছে রোমান্স প্রবণ ঐতিহাসিক উপন্যাস। যদুনাথ সরকার যথার্থই বলেছেন যে, ‘মানসিংহ, জগৎসিংহ, কৎলু খাঁ, খাজা ইসা, ওসমান- ইহারা সকলেই ঐতিহাসিক পুরুষ এবং সে যুগে বঙ্গের ঠিক সেই স্থলে বাস করিতেন। ইহাও সত্য যে, জগৎসিংহ অগণিত পাঠানদের নিকট পরাজিত হইয়া এক দুর্গে আশ্রয় লন এবং তাহার দেওয়ান খাজা ইসা কৎলুর বালক পুত্রদের রাজ্য বাচাইবার জন্য মানসিংহের সহিত দেখা করিয়া বহুমূল্য উপঢৌকন দিয়া সন্ধি করেন। ইহা ভিন্ন ‘দুর্গেশ নন্দিনী’-র আর সব কাল্পনিক (প্রাগুক্ত)। আর কল্পনার রং চড়িয়ে বঙ্কিম বাবু শেষপর্যন্ত কৎলু খাঁকে নারী লোলুপ বানিয়ে ছেড়েছেন। আর তবেই তো স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় সহ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্র-ছাত্রীরা ভাববে মুসলিম রাজা-রাজড়া আর সেনাপতি-সেনাবাহিনীরা কতোখানি নারী লোলুপ হতে পারে। আয়েশা-জগৎ সিংহের প্রণয়-কাহিনী নির্মাণ করতে গিয়ে ইতিহাসের বাস্তবতাকে গুলিয়ে দিয়েছেন বঙ্কিম। বঙ্কিমের বিখ্যাত আরেকটি উপন্যাস ‘কপাল কুন্ডলা’-য় মুসলিম নারীকে কলুষিত করা হয়েছে। ‘মৃণালিনী’ উপন্যাসে হিন্দু ধর্মীয় রাজ্য পুনরুদ্ধারের স্বপ্ন দেখিয়ে হিন্দুত্ববাদ ও হিন্দু জাগরণ ঘটিয়েছেন। ‘কমলা কান্তের দপ্তর’-এ আর্যভবনকৃত ভারতের সন্ধান দিয়েছেন। ‘চন্দ্রশেখর’ উপন্যাসে প্রতাপ-শৈবলনীর পাশাপাশি মীরকাশিম-দলনিবেগম পার্শ্ব কাহিনী জড়িয়ে মীরকাশিমকে হীন-চরিত্রে চিত্রিত করেছেন। আর উদার-দলদিরাজ সৎ তকি খাঁকে খলনায়ক বানিয়েছেন। ‘রাজ সিংহ’ উপন্যাসে মুসলিম জীবনের বিকৃত ঘটিয়েছেন। ‘আনন্দমঠ’ উপন্যাসে ‘বিদ্রোহী’ সন্ন্যাসীরা স্বদেস প্রেমে উদ্বেলিত হলেও তাতে মুসলিম-বিদ্রোহের তরঙ্গ। নবার ও মুসলিমদের ধ্বংস করতে সন্তান-সেনাদের মুখ দিয়ে রুঢ় ভাষা বলিয়ে নিয়েছেন। এই উপন্যাসে ইংরেজদের তুষ্ট করতে গিয়ে মুসলিম সম্প্রদায়কে ক্ষুদ্ধ ও আহত করেছেন তিনি। এই উপন্যাসে সত্যানন্দের মুখ দিয়ে লেখক যখন বলেন, –‘শত্রু কে ? শত্রু আর নাই। ইংরেজ মিত্র রাজা’। ‘আনন্দমঠ’ উপন্যাসে অন্যতম চিকিৎসক চরিত্র-র মাধ্যমে সত্যানন্দর প্রতি যে সংলাপ বসানো তা হল –‘সত্যানন্দ কাতর হইওনা। তুমি বুদ্ধির ভ্রমক্রমে দস্যুবৃত্তির দ্বারা ধন সংগ্রহ করিয়া রণ জয় করিয়াছ। পাপের কখনও পবিত্র ফল হয় না। অতএব তোমরা দেশের উদ্ধার করিতে পারবে না। যাহা হইবে, তাহা ভালই হইবে। ইংরেজ রাজা না হইলে সনাতন ধর্মের পুনরুদ্ধারের সম্ভাবনা নাই। …… ইংরেজ রাজ্যে প্রজা সুখী হইবে –নিষ্কণ্টকে ধর্মাচরণ করিবে। অতএব হে বুদ্ধিমান, –ইংরেজের সঙ্গে যুদ্ধে নিরস্ত্র হইয়া আমায় অনুসরণ কর’। হিন্দুত্ব পুনরুত্থান ও ব্রিটিশরাজকে অভিনন্দন জানানোর এর চেয়ে ভাল সংলাপ আর কী হতে পারে? সমগ্র ‘আনন্দমঠ’ জুড়ে এই অনুরনন। নিবন্ধের কলেবর বৃদ্ধি না করে এখানেই থামছি। বঙ্কিমচন্দ্রের ‘দেবী চৌধুরানী’-তে (১৮৮৪) রক্ষণশীল হিন্দুত্বের আহ্বানকে বঙ্কিমচন্দ্র বেশি করে ফোকাস করেছেন। আর ‘সীতারাম’ উপন্যাসে (১৮৮৭) উগ্র হিন্দুত্ববাদের প্রকাশ ঘটেছে বেশি। এ নিয়ে বিশ্লেষণের প্রয়োজন বলে মনে করি।

‘দেবী চৌধুরানী’ উপন্যাসে গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংসের শাসনকাল বিস্তৃত ও বিধৃত। নবাবী শাসন তখন নামে মাত্র। আবার ব্রিটিশ শাসনও সুপ্রতিষ্ঠিত নয়। একটি পারিবারিক কাহিনীর মাধ্যমে সেখানে বঙ্কিম অনুশীলন তত্বের বর্ণনা দিয়েছেন। বাড়ি থেকে পালিয়ে আসা এক গৃহবধূ প্রফুল্লার ‘দেবী চৌধুরানী’-তে পরিণত হওয়া, ভবানী পাঠক নামে ব্রাহ্মণ-ডাকাতের কাছে গীতার শিক্ষা অনুধারন করে কীভাবে প্রফুল্লা থেকে ডাকাতরানীতে পরিণত হয়ে ‘দেবী চৌধুরানী’-তে পরিণত, তার কাহিনীই প্রাধান্য পেয়েছে। আবার ভবানী পাঠকের কাছে যাবতীয় ঐশ্বর্য ত্যাগ করে কীভাবে আবার স্বামীর ঘরে এসে দেবী চৌধুরানী পুকুর ঘাটে বাসন মাজছে তারও বিস্তার ঘটিয়েছেন বঙ্কিমচন্দ্র। রক্ষণশীল হিন্দুত্বের বিস্তারই প্রাধান্য পেয়েছে। ‘দেবী চৌধুরানী’-র ভবানী পাঠক আনেকটাই ‘আনন্দমঠে’র সত্যানন্দ। ‘আনন্দমঠ’-এর সত্যানন্দ মহাপুরুষকে অবলম্বন করে হিমালয় শিখরে গমন করে, ভবানী পাঠকও পূর্ব প্রায়শ্চিত্তের জন্য দ্বীপান্তরে চলে যায়। আর এই ভাবে সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ‘দেবী চৌধুরানী’ তে রক্ষণশীল হিন্দুত্বকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন।

‘সীতারাম’ (১৮৮৭) উপন্যাসে আমাদের সাহিত্যসম্রাট ঋষি বঙ্কিমচন্দ্র রক্ষনশীল হিন্দুত্ব থেকে উগ্রহিন্দুত্বে চলে এলেন। মুসলিম শাসকদের হাতে হিন্দু নির্যাতনকে দেখাতে গিয়ে ইতিহাসকে অপ-ইতিহাসে পরিণত করেছেন। ইতিহাস-কে বিকৃত করেই তিনি ‘সীতারাম’ উপন্যাসে যুদ্ধে তোরাব খাঁকে সীতারামের হাতে খুন করিয়েছেন। অবশেষে ‘মহাপাপিষ্ঠ’ মুর্শিদকুলি খাঁ-র সৈন্য বাহিনী ভূষনা দখল করলেও সীতারামকে সপরিবারে বৈরিশূণ্য স্থানে পৌছে দিয়েছেন। চূড়ান্ত ইতিহাস বিকৃত করা হয়েছে উগ্র হিদুত্ববাদের বীরত্ব উন্মোচন করতে গিয়ে। ইতিহাস কি বলে? ইতিহাস এটাই বলে, তোরাব খাঁ শিকারে গেলে তাকে চিনতে না পেরে সীতারাম দলবল নিয়ে তাকে হত্যা করে। অবশেষে মুর্শিদকুলি খাঁ-র সৈন্য সামন্তর হাতে সীতারাম ধরা পড়ে যায়। অবশেষে মুর্শিদাবাদে এনে তাকে হত্যা করা হয়। ‘সীতারাম’ উপন্যাসে যেন মনে হচ্ছে মুসলিমদের প্রতি প্রতিশোধ নিয়ে উগ্র হিন্দুত্বেরই জাগরণ ঘটালেন। যেন মনে হচ্ছে মুসলিমদের প্রতি প্রতিশোধ নিয়ে উগ্র হিন্দুত্বের আস্ফালনকে চিত্রিত করেছেন বঙ্কিম। বঙ্কিমের একপেশে প্রবণতা বেশিমাত্রায় প্রকাশিত হয়েছে। উপন্যাসের ঘটনা বিন্যাস বা চরিত্র চিত্রণে এমন চিত্র কল্প ফুটে উঠেছে সেখানে সনাতন ধর্মের আধ্যাত্মিক ও শান্তির দিক বাদ দিয়ে গোড়ামি ও কঠোরতা প্রকাশ পেয়েছে। সীতারামের স্বজাতি প্রীতি ও ধর্মীয় জাতীয়তাবোধ যেভাবে প্রস্ফুটিত হয়েছে তাতো আজকের হিন্দুত্ববাদেরই বহিঃপ্রকাশ।

দ্বিতীয় অংশের জন্য এখানে ক্লিক করুন

প্রথম অংশের জন্য এখানে ক্লিক করুন

Back To Top