আরবিতে মুসলিম নাম আরও একটি অভিশাপ

~মোহাম্মদ সাদউদ্দিন~

   পশ্চিমবাংলায় কলকাতা মহানগরী সহ জেলার সদর শহর গুলিতে কোনও বাঙালি ছেলে-মেয়ে বা মুসলিমদের পক্ষে হিন্দু বাড়িতে ঘর ভাড়া পাওয়া দুস্কর। দু- একটি ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম অবশ্যই আছে যা ধর্তব্যের মধ্যে নেই। পশ্চিমবাংলায় শহরে হিন্দু-বাড়িতে মুসলিমদের ঘর ভাড়া না পাওয়ার ব্যাপারটি কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকার ২০১৮ সালের জুলাই মাসে কয়েক কিস্তিতে বের হয়েছিল। তার জন্য আনন্দবাজারকে অভিনন্দন। অবশ্যই অভিনন্দন জানাতেই হবে। আবার কোনও একটি দৈনিক পত্রিকা যখন ‘ হিন্দুরা কেন মুসলিমদের ঘৃণা করে’ লেখে তখনো বাহবা দিতেই হয়। ধর্মীয় সংখ্যালঘু হওয়া একটি অভিশাপ। এটি পৃথিবীর সব দেশেই। কিন্তু তার ফাঁকেও কয়েকটি প্রশ্ন থেকে যায়। এক বার কলেজ স্ট্রিটের আশ-পাশ এলাকায় একটি মন্দিরের কাছে কয়েক জন দাঁড়িয়ে আছি। ছোট একটি শনি মন্দির। পাখিতে পায়খানা করে দেওয়ায় একটু নোংরা হয়ে গিয়েছে। পুরুত মশায় সেই মল পরিষ্কার করছেন আর বলছেন এটা যদি কোনও মুসলিমদের মল হত তাহলে কাবাব তৈরি করে দিতাম। পাশ থেকে অন্যজন বলছে এটা আবার কি কথা? মুসলিমরা কি মানুষ নয়? প্রতি জবাবে সেই পুরোহিত বলছেন, খ্রিষ্টান – শিখ – বৌদ্ধ – সবার অন্যায় সহ্য করব। কিন্তু মুসলিমদের নয়। পাঠকবর্গ নিশ্চয় বুঝতে পারছেন, খোদ কলকাতা শহরে একজন মুসলিমদের উপর একজন হিন্দুর কত রাগ। কারণটা কি? একই ভাবে একজন মুসলমানের নাম শুনলে বলা হয়, তোমাদের আরবি ভাষার এই নাম গুলো খুব কঠিন। বাংলায় নাম রাখতে পারো না। সারা ভারতে এই আপত্তিটা কিন্তু বাংলা ভাষী হিন্দুরাই করে। হিন্দি বা অন্য ভাষার হিন্দুরা করে না । আবার তর্কের খাতিরে বলতে হয়, ইংরেজি ভাষাতে কঠিন নাম গুলি উচ্চারণ করতে কঠিন হয় না কেন? দক্ষিণ ভারতের মালয়ালম বা তামিল ভাষার অনেক কঠিন নাম উচ্চারণ করতে কষ্ট হয় না। অথচ মুসলিমদের আরবি ভাষার নাম উচ্চারণ করতে কষ্ট হয় কেন? এটা কি ঘৃণার মনোভাব থেকে? বাংলা ভাষায় কম করে আরবি – পার্শি-তুর্কী-উর্দু শব্দ রয়েছে ৬০০০-এর কমবেশি। আমরা যে ‘কাকা’ শব্দটি ব্যবহার করি, এটা তো একটি তুর্কী শব্দ। এভাবে দেখা গেছে আরবি-পার্শি-তুর্কী শব্দ গুলি বাংলা শব্দ ভাণ্ডারকে বিকশিত করেছে। সমৃদ্ধ করেছে। সেই শব্দ গুলি যখন উচ্চারণ করতে পারি তখন আরবি মার্কা মুসলিম নাম উচ্চারণ করতে কষ্ট লাগে কেন? আরবদের সঙ্গে , পারস্যবাসী বা তুর্কীদের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক কয়েক হাজার বছরের। বাংলা ভাষার পৃষ্ট-পোষকতা করেন বাংলার ক্ষমতাসীন তুর্কী সুলতান ও নবাবরা । অনুবাদ সাহিত্যের সূচনাকারীও তুর্কী সুলতানরা। গৌড়ের সুলতান বাদশাহ আলাউদ্দিন হোসেন শাহ মহাপ্রভু চৈতন্যদেবকে বৈষ্ণব ধর্ম প্রচার ও কীর্তন যাত্রা করার সব ধরনের অধিকার দেন সম্মানের সঙ্গেই। বাংলার নবাবরা বৈষ্ণব সাহিত্যের সুসংহত চর্চা করতেন। সুদীর্ঘ ৮০০ বছর ধরে বাংলায় বসবাসকারী মুসলিমদের আরবি নাম উচ্চারণ করতে এত কষ্ট কেন? ব্রিটিশরা যখন  ‘দত্ত’ পদটিকে ‘ডট’, ‘বন্দ্যোপাধ্যায়’ পদটিকে ‘ব্যান্ডো’, ‘চক্রবর্তী’কে ‘চ্যাকস’ বলে, কিংবা ‘বহরমপুর’ কে ‘বারহামপুর’, ‘বর্ধমান’কে ‘বার্ডওয়ান’ বলে তখন সেটিকে বেদ বাক্য বলে মনে হয়? ব্রিটিশদের বিকৃত উচ্চারণকে মন্ত্র বলে মনে হয়? ব্রিটিশদের দেওয়া ‘মুন্সী’, ‘খানবাহাদুর’, ‘রায়বাহাদুর’, ‘স্যার’, ‘খানচৌধুরী’, ‘রায়চৌধুরী’ গুলিকে, আজও আশীর্বাদ বলে মনে হয়! আমরা আজও জানতে সক্ষম হলাম না যে আরবি -পার্শি- শব্দের সঙ্গে সংস্কৃত শব্দের সাদৃশ্য বা মিল রয়েছে। আমরা এটা জানারও চেষ্টা করলাম না। আরবি বা পার্শিতে যেটাকে ‘হপ্তাহ’ বলা হয় বাংলায় সেটিই ‘সপ্তাহ’। ‘ঠাকুর’ শব্দটি এসেছে তুর্কী শব্দ ‘ট্যাগরি’ থেকে। তুর্কীদের দেবতার নাম  ‘ট্যাগরি’। ‘ট্যাগরি’ থেকে ‘ট্যাগরা’,। বাংলায় সেটিই হয়ে গেল ‘ঠাকুর’। ‘ঠাকুর’ দেবতা শব্দটি আমরা প্রায়ই ব্যবহার করি। সংস্কৃত ভাষায় ‘শত’ পার্শিতে ‘সদ’, সংস্কৃতে ‘আম্র’ পার্শিতে ‘আম’, আবার বাংলায়ও ‘আম’, সংস্কৃতে ‘দেব’ পার্শিতে ‘দেও’, সংস্কৃত ‘মাস’ পার্শিতে ‘মাহ’, সংস্কৃত ‘শৃগাল’ পার্শিতে ‘শেগাল’, সংস্কৃত ‘অল্ল’ পার্শিতে ‘আল্লাহ’। আবার সংস্কৃত ‘চন্দন’ আরবিতে ‘সন্দন’, সংস্কৃত ‘হলাহল’ আরবিতে ‘হলাহল’, সংস্কৃত ‘ আর্য’ আরবিতে ‘আরিয়া’, ইংরেজিতে ‘অ্যারিয়ান’, সংস্কৃত ‘আপদ’ আরবিতে ‘আফৎ’, এই ভাবে অজস্র উধাহরণ দেওয়া যায়।

আসলে বহুদিন পর্যন্ত  আর্যরা প্রথম দিকে ইরানে (পূর্বতন পারস্য) বসবাস করার ফলে সংস্কৃত-আরবি-ফার্সি শব্দের মধ্যে সাদৃশ্য ঘটে যায়। ইতিহাসটা যদি এই রকম হয় তাহলে বাঙালি হিন্দুদের মুখে ‘আরবি’ শব্দ উচ্চারণ করতে কষ্ট হয় কেন? এর মধ্যে কি একটি সুপ্ত বিদ্বেষ বা ঘৃণা কাজ করছে! আমার মনে হয় সেটাই সত্য। পশ্চিমবঙ্গের দক্ষ বাঙালি শ্রমিকরা যখন পশ্চিমবঙ্গের বাইরে অন্য কোনও রাজ্যে কাজ করতে যান তখন তাদের কে আরবি /পার্শি নাম হওয়ার জন্য এবং বাংলায় কথা বলার জন্য ‘বাংলাদেশী’ হিসাবে সন্দেহের কবলে পড়তে হয়। ‘বাংলাদেশি’ থেকে জঙ্গি। তারপর জেল। দীর্ঘদিন কারাবাস করে বেকসুর খালাস হয়ে গেলেও তখন জীবন স্তব্ধ হয়ে যায়। এটাই অনিবার্য পরিণতি বাঙালি মুসলমান হওয়ার জন্য । আবার আরবি বা পার্শি শব্দের নাম হওয়ার জন্য স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা ভোটার তালিকায় নামের ভুল হয়। পাসপোর্ট করার ক্ষেত্রে সমস্যা দেখা দেয়। বিমান বন্দরে অপদস্ত হতে হয়। খ্যাতিম্যান চলচ্চিত্র অভিনেতা শাহরুখ খান । ভারতের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি মিসাইলম্যান প্রয়াত আব্দুল কালামকেও রেহাই দেওয়া হয়নি। কেন এই রকম হবে? কেন? আমি আমার স্কুল-কলেজ- বিশ্ববিদ্যালয় অথবা কর্ম জীবনে দেখেছি আমার অনেক হিন্দু বাঙালি বন্ধু উপহাসের ছলে বলত, তোমাদের নাম গুলো উচ্চারণ করা খুবই কঠিন। আমি জবাবে বলতাম , ভারতের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী(১৯৯৬) এ ই ডি দেবেগৌড়ার পুরোনাম হাল্লিহাদিন দেদ্দেগোড়া কি ভাবে উচ্চারিত হয়। কেরালার প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ই এম এস নাম্বুদিরিবাদের বিশাল নাম কীভাবে উচ্চারিত হয়? তাহলে বাঙালি মুসলিমদের নাম উচ্চারণ করতে এত কষ্ট কেন? একথা কোন হিন্দীভাষী বা অন্য কোনও ভাষী ভারতীয় বলেন না।

১৯৪৭ সালে ভারত স্বাধীনতা লাভ করেছে বিভাজনের মধ্যেই। সেই বিভাজন থেকে রেহাই পায়নি পাঞ্জাব ও বঙ্গপ্রদেশে। পাঞ্জাবে এধরনের সমস্যা প্রকট হয়নি। বাংলায় হিন্দু-মুসলিম সুপ্ত সাম্প্রদায়িকতা কিন্তু রয়ে গেছে। দেশ এমন ধর্মের ভিত্তিতে ভাগ হল যে দুই দেশের মানুষ নিরাপদে থাকতে পারাপার করেছেন। আর এই পারাপারের বিষয়টি মানুষের মনে সাপ্রদায়িকতার চিহ্ন এঁকে দিয়েছে যার রেশ আজও যায়নি। ‘৪৭’-সালে বিভাজন হওয়ার পর পশ্চিমবাংলায় ১৯৬৪ সালে সব চেয়ে বড় দাঙ্গা হয়েছে। সেই দাঙ্গাকে থামিয়ে ছিল ট্রাম শ্রমিক ও বাম্পন্থীরাই । এপ্রসঙ্গটি  অত্যন্ত ভালভাবে বর্ণিত কথা সাহিত্যিক ও কবি গোলাম কুদ্দুসের ‘হিন্দুস্থানি’ উপন্যাসে। এটি শারদীয় কালান্তর – ২০০৪ সালে বেরিয়েছিল। কিন্তু ৬৪ সালের আগে ৫০ -এর দশকে আরও কয়েকটি দাঙ্গা রাজনৈতিক মদতে লাগানো হয়েছিল যেন পশ্চিমবঙ্গের মুসলিমরা পালিয়ে যাক। ঠিক একই ভাবে তৎকালীন পূর্বপাকিস্থানেও (অধুনা বাংলাদেশ) খান সেনাদের হামলা ও আক্রমণে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে বাঙালি হিন্দুরাও চলে আসে পশ্চিমবঙ্গে। ফলে পারাপার করা মানুষের মধ্যে সাম্প্রদায়িকতার ক্ষত চিহ্ন থেকে গেছে আজও। আর হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলি আবার নতুন করে ঘোলা জলে মাছ ধরছে রাজনৈতিক ফায়দা তোলার জন্য। তাই পশ্চিমবাংলায় সুপ্ত ,সুক্ষ ও ছদ্মবেশী সাম্প্রদায়িকতা থেকে গিয়েছে এখনই।

এর ফলে মুসলিম নাম গুলো শুনলে মুখ সিটকানো হয় কিংবা আরবি শব্দের নাম উচ্চারণ করতে কষ্ট হয়। আবার বাংলাদেশীদের ‘মালাউন’ নামক গালি শুনতে হয়। কেউ কেউ ‘কাফের’ও বলে । হিন্দু- মুসলিম এই জটিল জ্যামিতি ও আবর্ত আর আমাদের কতদিন বহন করতে হবে? হিন্দুদের ‘মালাউন’ আম মুসলিমদের ‘যবন’ কিংবা ‘ম্লেচ্ছ’ আমাদের কতদিন শুনতে হবে ? সন্দেহ – বিশ্বাস- অবিশ্বাস- সংশয় নিয়ে আর আমাদের কতদিন থাকতে হবে? ইতিহাস তুমি তার জবাব দেবে?

বাঙালি মুসলিমদের এক বিরাট অঙ্কের দক্ষ শ্রমিক ( স্কিল লেবার) পশ্চিমবঙ্গের বাইরে জরি, কাপড়ে নক্সা, ( ফামের পুতুল, রাজমিস্ত্রী , ইটের ভাঁটা, ঠিকা শ্রমিক হিসাবে ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে কাজ করতে যান । এখন আবার তাদের কে ‘লাভজিহাদের’ নামে শিকার হতে হচ্ছে। এক্ষেত্রে মালদার আফরাজুল তার জ্বলন্ত উদাহরণ । রাজস্থানে কাজ করতে যাওয়া এক হিন্দু মেয়েও তার সঙ্গে কাজ করত । এক আর এস এস নেতা ‘লাভজেহাদের’ তকমা লাগিয়ে তাকে নৃশংসভাবে খুন করল। এব্যাপারে পশ্চিমবঙ্গ সহ ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে প্রতিবাদের ঝড় উঠে। পশ্চিমবঙ্গের দক্ষ বাঙালি মুসলিম শ্রমিকদের ভিন্ন রাজ্যেও নিরাপত্তা নেই আফরাজুলের ঘটনা তার জ্বলন্ত উধাহরণ । পশ্চিমবাংলায় তারা সঠিক মূল্য পান না, আবার পশ্চিমবঙ্গের বাইরে গেলে রাজস্থান- গুজরাট- পাঞ্জাব- হরিয়ানা- তামিলনাড়ু প্রভৃতি রাজ্যে লাভজেহাদের নামে তাদের খুন হতে হচ্ছে। আরবি নাম ও বাংলায় কথা বলার জন্য তাদের গায়ে লাগিয়ে দেওয়া হচ্ছে বাংলাদেশী জঙ্গীর তকমা। এই অভিশাপ থেকে মুক্তি কোথায়? ভিন রাজ্যে কাজ করতে যাওয়া বাঙালি হিন্দু – মুসলিম তরুণদের ক্ষেত্রে একই ঘটনা ঘটছে।

Back To Top