নেতাজীর আদর্শ ও মোদীজির বয়ানবাজি

নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু


~ মুহাম্মদ সাহাবুদ্দিন

সেই মোদীজি। সেই ভাষণ। আরও একবার প্রতিশ্রুতি। আবারও গোটা জাতিকে সামনে রেখে। এবারের প্রতিশ্রুতি নেতাজী সুভাষচন্দ্রের নামে যিনি স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে হিমালয়সম সর্বোচ্চ সম্মানিত ব্যক্তিত্ব। এই মহান স্বাধীনতা সংগ্রামী রাষ্ট্রনেতার আদর্শ বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতি দিলেন দিল্লীর লালকেল্লায় দাড়িয়ে। আজাদ হিন্দ সরকারের ৭৫ বর্ষ পূর্তি উপলক্ষে আয়োজিত সরকারী অনুষ্ঠানে এই প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করলেন। বললেন ২০২২ সালের মধ্যে তিনি নেতাজীর আদর্শের বাস্তবায়ন ঘটাবেন দেশে। কিন্তু, প্রথম থেকেই এনিয়ে সন্দেহের বাতাবায়ন দানা বাঁধছে। মোদী বিরোধিতার সতীনী নিন্দা মন্দ নয়, এই সন্দেহ দানা বাঁধার বাস্তব কারণ রয়েছে। সব চাইতে বড় ও মুখ্য কারণ নেতাজী ও মোদীর অনুসৃত আদর্শের মধ্যে আকাশ-পাতাল / সুমেরু-কুমেরুর বৈপরীত্য। যদি ধরা যায় – মোদী সত্য সত্যই নেতাজীর আদর্শ বাস্তবায়ন করবেন, তাহলে মোদীজিকে তার এতদিনের লালিত সাধের সঙ্ঘাদর্শ ত্যাগ করতে হবে। মোদীজিকে আমরা যতটা জানি তাতে তিনি এমন পদক্ষেপ এক কদম এগোবেন বলে মনে হয় না। সঙ্ঘাদর্শ প্রতিষ্ঠা করতেই তো তিনি নিজ স্ত্রীকে ‘ত্যাগ’ করেছেন।  তবু মোদী হলাহল এই প্রতিশ্রুতির বাণী শোনালেন।

এমনিতে মোদীজির প্রতিশ্রুতি দানে সঙ্ঘীদের বিচলিত হবার কথা, কিন্তু তারা বিচলিত এমন লক্ষণ কৈ? আসলে মোদীজির এমন কথার কথা-র তাৎপর্য ভালই বোঝেন তারা। বোঝেন তো বটেই, পূর্ণ সমর্থনও করেন। রাজনীতিতে এমন অভিনেতা চরিত্রের ক্ষেত্রে নরেন্দ্র দামোদর দাস মোদীর জুড়ি মেলা দুষ্কর। এটা বুঝেই তো ২০১৪-র প্রাক নির্বাচনে প্রধান মন্ত্রীত্বের জন্য বাছাই তালিকার শীর্ষে রাখে আরএসএস। গুজরাট দাঙ্গায় মোদীজি তার যোগ্যতার সর্বোচ্চ প্রমাণও দিয়েছেন।

নেতাজী সুভাষচন্দ্র ও শ্রীমান নরেন্দ্র মোদীর চিন্তা-ভাবনা শুধু দ্বিমূখী নয়, বিপরীতমূখীও। নেতাজী যখন জীবিত নাই তখন এই দুয়ের বৈপরীত্য জানতে আমাদের কিছুটা অতীত মূখী হতে হবে। আজকের বিজেপির বিবর্তিত রুপ তার পূর্বসরী হিন্দু মহাসভার আত্মা থেকে। এই হিন্দু মহাসভা ছিল নেতাজীর রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের প্রধান প্রতিপক্ষ। অবশ্য, দুর্বল হিন্দু মহাসভাকে পুষ্টি যোগান দিয়েছে কংগ্রেসের সাম্প্রদায়িক মনস্ক গোষ্ঠী। তলায় তলায়  উস্কানি দাতা আরএসএস তো ছিলই। এই গোষ্ঠীর নেতাজী বিরোধী হওয়ার প্রধান কারণ ছিল- এদের কাছে ইংরেজরা শত্রু ছিল না, শত্রু ছিল মুসলমানরা। অন্যদিকে, নেতাজীর নিকট ইংরেজ শাসকরাই ছিল একমাত্র, এই শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াই- এ মুসলিমরা ছিল একান্ত বন্ধু। যখন স্বাধীনতা সংগ্রাম তুঙ্গে, তখনও দেখা গেছে হিন্দু মহাসভা আরএসএস স্বাধীনতা সংগ্রামের ছায়া-ছোঁয়া থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছে। এটা যে তাদের রামকৃষ্ণ- বিবেকানন্দ – সুলভ নির্লিপ্ততা, তা কিছু মোটেই নয়; বরং তারা ইংরেজদের সুহৃদ হয়ে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। এক্ষেত্রে বিজেপির প্রাণপুরুষ বাজপেয়ীর নামও জড়িয়ে গিয়েছে বিশেষতঃ বিয়াল্লিশের ‘ভারতছাড়ো’ আন্দোলন কালে। অবশ্য, তাদের দু একজন যে কক্ষচ্যুত হয়ে স্বাধীনতা আন্দোলন অয়নে ঢুকে পড়েনি তা নয়; সাময়িক মোহাবেশ কাটিয়ে তারা শেষ পর্যন্ত ইংরেজ সামনেই ফিরে গিয়েছে। এক্ষেত্রে সব চাইতে উজ্জ্বল উধাহরণটি হল দামোদর বিনায়ক সাভারকর। কেউ কেউ আবার তপস্যার জগতে ফিরে গিয়েছেন। তিনি আন্দামানের সেলুলার জেল থেকে মুক্তি পেতে ইংরেজ সরকারকে মুচলেকা লিখেছেন (১৩/১১/১৯৩১)। সেই মুচলেকায় তিনি স্বাধীনতা সংগ্রামের বিরুদ্ধে ইংরেজ সরকারকে সহযোগিতা প্রধানের অঙ্গীকার করেন। এমন কাপুরুষ মূলক আচারণের পরও তিনি ‘বীর’ উপাধীপ্রাপ্ত হন!

বর্ণবাদীদের পক্ষ হতে ইংরেজদের সহযোগিতার বিষয়টি কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছিল না। বঙ্কিমচন্দ্র তো কয়েক দশক আগেই ইংরেজ সরকারের গুণকীর্তন ও মুসলিম (শাসক)-দের ঘৃণা উগরে, গালমন্দ করে রোমান্স- উপন্যাস লিখেছেন। ‘আনন্দমঠ’ এক্ষেত্রে সবার উপরে। স্বাধীনতা যুদ্ধের চরম পর্বেও আরএসএস ইংরেজ সরকারের সহযোগিতার থেকেছে। আরএসএসের তৎকালীন সরসঙ্খচালক সর্বোচ্চ নেতা মাধবরাও সদাশির গোলওয়ালকর সিএ সবসময় তার হিন্দু ভাইদের উপদেশ দিয়ে বলছেন – “ হিন্দু ভাইরা, ব্রিটিশদের সঙ্গে লড়াই করে শক্তি ক্ষয় করো না। শক্তি জমা রাখো আমাদের ভিতরের শত্রুদের সঙ্গে লড়বার জন্য।” ( ‘অ্যা বাঞ্চ অফ থট’) এই জমা কৃত শক্তি কাদের বিরুদ্ধে কি ভাবে ব্যবহৃত হবে তার কথাও তিনি ব্যাখ্যা করেছেন তাঁর ‘উই অর আওয়ার নেশনহুড ডিফাইন্ড’ গ্রন্থে। বলা বাহুল্য, সেখানে তিনি মুসলিমদেরই প্রধান প্রতিপক্ষ করেছেন। সেই ঐতিহ্য আজও আরএসএস ও তার শাখা সংগঠন গুলি বহন করে চলেছে, নরেন্দ্র দামোদর মোদী তারই অন্যতম কান্ডারী। 

নেতাজী সুভাসচন্দ্র বসুর সঙ্গে নরেন্দ্র মোদীর সংঘ পরিবারের আদর্শগত ফারাক যে আকাশ-পাতাল তার নজির অনেক। মোদীরা চাইছেন এদেশে মনুর বর্ণবাদী ও নারী বিদ্বেষী অনুশাসন চালু করবেন। সেই লক্ষ্যেই তারা মেরুকরণের রাজনীতি করছেন পুরোদস্তুর। এই লক্ষ্যেই আসাম , উত্তরপ্রদেশ, গুজরাট সহ বিভিন্ন রাজ্যের বিধানসভা ও লোকসভা নির্বাচনে তারা মুসলিম প্রার্থী প্রায় শূন্যের কোঠায় নিয়ে এসেছেন। ‘সবকা সাথ সবকা বিকাশ’ শ্লোগান  দেয়া হলেও সঙ্ঘীরা বিভিন্ন শাখা সংগঠন কে লেলিয়ে দিয়ে সর্বত্র ত্রাসের পরিবেশ গড়ে তুলেছে। গোমাতা, লাভজিহাদ, ধর্মান্তর , ভারতমাতা, সন্ত্রাস ইত্যাদিকে কেন্দ্র করে তাদের এই সন্ত্রাস কার্য চলছে। নিজ হাতে আইন তুলে নিয়ে সন্ত্রাস চালাচ্ছে। গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা , মানবতা, সংবিধান , ন্যায়বিচার, প্রতিরোধ করে করে দেশকে ফ্যাসিবাদের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। রাজনীতির মেরুকরণ ঘটাতে মুসলিমদের যাবতীয় উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় বাঁধা সৃষ্টি করছে। মুসলিম উন্নয়ন প্রসঙ্গ উঠতেই মুসলিম তোষণের জিগীর তুলছে। অন্যদের সংরক্ষণ থাকলেও মুসলিম সংরক্ষণে প্রতিরোধে মরিয়া হয়ে উঠেছে। অথচ সাচার কমিটি, রঙ্গনাথ কমিশন মুসলিমদের দেশের সর্বাপেক্ষা পশ্চাদপদ জাতি হিসাবে চিহ্নিত করে তাদের উন্নয়ন সংরক্ষণের সুপারিশ করেছে। নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু এমন মুসলিম বিরোধী ষড়যন্ত্রের জঘন্য প্রবৃত্তিকে তীব্র ঘৃণা করেছেন এবং ন্যায্য অধিকার প্রদানে সর্বদা সোচ্চার থেকেছেন। বেঙ্গল অ্যাক্ট , কোলকাতা কর্পোরেশন-এর মত ক্ষেত্র গুলিতে এর প্রমাণ ছড়িয়ে রয়েছে। হিন্দু মহাসভা আরএসএস এর নেতাজীর এই ভাবনালোকের প্রধান প্রতিপক্ষ ছিল। সেই ঐতিহ্য মোদী জির আজকের সঙ্ঘ পরিবার বহন করে চলেছে , এটা জেনে-বুঝেও মোদীজি নেতাজীর আদর্শ প্রতিষ্ঠার কথা বলছেন।

নেতাজীর সারাজীবন জুড়ে রয়েছে মুসলিম অনুসঙ্গতা । তিনি সঙ্ঘীদের ন্যায় মুসলিম শাসকদের বিদেশী ও অচ্ছুৎ ভাবতেন না । মুসলিম শাসকদের বিষয়ে তাঁর মূল্যায়ন ছিল – “মুসলমান আগমনের পর এক নতুন সমন্বয় গড়ে উঠল। যদিও তারা হিন্দুদের ধর্ম গ্রহণ করেনি , তবু তারা ভারতকে নিজেদের দেশ রুপে গ্রহণ করেছে এবং এই দেশের আর সকল মানুষের সঙ্গে মিলেমিশে এক যুক্ত সামাজিক জীবনের অংশীদার হয়েছে – এই সঙ্গে একে অপরের আনন্দ ও দুঃখ বেদনায় শরীক হয়েছে।” ( নেতাজী ও জাতীয় সংহতি – নির্মল বসু, দি ইন্ডিয়ান স্ট্রাগল থেকে) । নেতাজী এখানে মুসলিম শাসকদের কথা বলেছেন , কিন্তু এদেশের ৯৮% মুসলমানই এদেশের ধর্মান্তরিত মানুষ যারা মুলতঃ বর্ণবাদের বঞ্ছনা , অত্যাচার , অপমান, থেকে বাঁচতে ধর্মান্তরিত হয়। এক কথায় আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় ১৯২৫ সালে ফরিদপুরের হিন্দু মহাসভার সম্মেলনে সভাপতির অভিভাষণে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেন- “ ছুঁৎমার্গগ্রস্ত উচ্চবর্ণের হিন্দুদিগের অবজ্ঞা ও উদাসীনতার ফলে অবনত শ্রেণীর লোকেরা দলেদলে মুসলমান ও খৃষ্টান ধর্ম গ্রহণ করিতেছে । কেনই বা করিবে না ? ইসলাম ধর্মে সাম্যবাদের পরাকাষ্ঠা বিদ্যমান । ডোম হউক , বাগদী হউক , সে যে দিন ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে সেই দিন হইতেই সমস্ত সামাজিক অধিকার অন্যের সহিত সমভাবে ভোগ করে। – হিন্দু সমাজে ইহাদিগকে ইতর জীবজন্তু অপেক্ষা ঘৃণা করে , এবং কোণঠাসা করিয়া রাখিয়াছে।”  ( আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ঃ সমাজ নির্মাণের সাধনা – ডঃ প্রনব কুমার চট্টোপাধ্যায় , স্বস্তিকা – ২ আগস্ট ২০১০ )। শুধু সেই দিন নয় , আজকের দিনেও অনেক দলিত নিম্নবর্ণের মানুষ একই কারণে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করছে বা করতে চাইছে।

নেতাজী সুভাষচন্দ্র মুসলিম শাসকদের বিশেষতঃ যারা ইংরেজদের বিরুদ্ধে বীরবিক্রমে লড়ায় করেছেন তাঁদের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছেন। এঁদের অন্যতম বাহাদুর শাহ্‌ , হায়দার আলি, টিপু সুলতান, সিরাজউদ্দৌলা  । সঙ্ঘীরা  এদের কাউকে সুনজরে দেখে মনে হয় না ; বরং এঁদের শত্রু যে ইংরেজরা এদেশকে নির্মম ভাবে শোষণ করে এদেশের সম্পদ ও খাদ্যশস্য নিজেদের দেশে পাচার করে এদেশের মানুষকে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষে ফেলে মৃত্যুমুখে ঠেলে দিয়েছে তাদেরই প্রশংসা করেছে। ইতিপূর্বে আমরা উল্লেখ করেছি।

চিত্তরঞ্জন দাস সুভাষচন্দ্র বসু-রা অখন্ড বাঙলার মডেল দিয়েই অখন্ড ভারত গড়তে চেয়েছিলেন । তাঁদের অখন্ড বাংলার মডেলই ভারত ভাগ প্রতিহত করতে পারতো। এই মডেলের বাস্তব রুপ ছিল ‘বেঙ্গল প্যাক্ট’(এপ্রিল – ১৯২৩)। এই প্যাক্টের মূলমন্ত্র ছিল হিন্দু – মুসলিম সম্প্রীতি ও সংখ্যানুপাতিক অধিকার। সঙ্খ্যানুপাতে আইনসভা ও অন্যান্য প্রশাসনিক ক্ষেত্র এবং চাকুরিতে সংরক্ষণের সংবিধানিক অধিকার দিয়ে মূলতঃ এই মূলমন্ত্রের সুর বেঁধে দেয়া হয়। কিন্তু বর্ণবাদী হিন্দু মহাসভা ও কংগ্রেসীদের একটা বড় অংশের মানসিকতা ছিল এর বিরুদ্ধে । তারা মুসলিম ও দলিতদের সাংবিধানিক অধিকারের বাইরে শুধু মৌখিক প্রতিশ্রুতি দিয়ে রাখতে চাই ছিল । তাদের আসল মনোভাবটা ছিল – কোন ন্যায় সঙ্গত অধিকার দিব না , কিন্তু তাবেদারী করাব । ভারতের বেশির ভাগ রাজ্যই হিন্দু অধ্যুষিত , সেখানে মুসলিমরা হিন্দু আধিপত্য মেনে নিয়ে থাকবে ; বাংলার মত রাজ্যে মুসলিমরা সংখ্যাগরিষ্ঠ হলেও তাদের কোন সংখ্যানুপাতিক প্রাধান্য থাকতে পারবে না। তাদের এই মনোভাব শুধুমাত্র মুসলিমদের বেলাতেই নয়, দলিত শূদ্র, নমঃশূদ্র প্রভৃতিদের ক্ষেত্রেও এই মনোভাব ছিল। গোলটেবিল , পুনাপ্যাক্টের লড়ায় ছিল। এই কারণেই । এটা ছিল একান্তভাবেই বর্ণবাদী আর্যগরিমার ফল। এই বর্ণবাদী  আর্যগরিমা বিষয়ে বিশিষ্ট দলিত ও উদ্বাস্তু আন্দোলনের নেতা , বহু গ্রন্থ প্রণেতা সুকৃতি রঞ্জন বিশ্বাস লিখেছেন- “বাংলার মহামনীষীদের এসব বিভিন্ন দাবির সমর্থন হল – বাঙলায় হিন্দুরা সংখ্যায় কম হলেও , যেহেতু তারা শিক্ষা, সংস্কৃতি ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বলীয়ান, তাই মুসলিমরা সংখ্যাগরিষ্ঠ হলেও ভবিষ্যৎ আইন পরিষদে , স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠান গুলিতে ও অন্যান্য সব ক্ষেত্রে উচ্চবর্ণ হিন্দু ভদ্রলোকশ্রেনীকে বেশি গুরুপ্ত মর্যাদা , প্রতিনিত্ব ও অধিকার দিতে হবে।” ( বঙ্গদেশের ভদ্রলোকশ্রেণী ও সাপ্রদায়িকতা, পৃঃ ৭৪)। চিত্তরঞ্জন , সুভাষচদ্র বসুরা হিন্দু-মুসলিমদের সংখ্যানুপাতিক সমমর্যাদা বিষয়ে বাস্তব পদক্ষেপ ও নিতে শুরু করেছিলেন। কোলকাতা কর্পোরেশন তার বড় দৃষ্টান্ত । সে সময় কিছু গুরুপ্তপূর্ণ পদ ও চাকুরিতে মুসলিমদের সুযোগ দেয়া হয় যার দরজা আগে প্রায় বন্ধই ছিল। কিন্তু এই পদক্ষেপ কে রুখে দিতে বর্ণবাদী হিন্দু মহাসভা ও কংগ্রেসীরা আদা-গুড় ও জল খেয়ে নামে। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন যখন ‘বেঙ্গল প্যাক্ট’- কে স্বরাজ্য পার্টি এবং বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেস কমিটিতে পাশ করিয়ে কংগ্রেসের সর্বভারতীয় বার্ষিক তখন অধিবেশন ( কোকনাদ সম্মেলনে) পাশ করাতে প্রস্তাবাকারে উত্থাপন করেন তখন তাকে সাম্প্রদায়িক বর্ণবাদীরা রুখে দেয়। ভোটাভোটিতে ফল দাঁড়ায় – ৪৫৮- ৬৭৮ । প্রবল রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব চিত্তরঞ্জন দাস এর পরও অখন্ড ভারতের স্বার্থে এই লড়াই এগিয়ে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন, কিন্তু তাঁর অকাল প্রয়াণ তা থমকে দেয়। এরপর এই কাজকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হাল ধরেন সুভাসচদ্র ও শরৎচন্দ্র ভ্রাতৃদ্বয়। কিন্তু তাঁরাও শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হন। মূলতঃ হিন্দু মহাসভা ও সাম্প্রদায়িক কংগ্রেসীদের অনড় মানসিকতায় ব্যর্থ ও হতাশ হয়ে নেতাজী স্বশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে দেশ স্বাধীন ও অখন্ড ভারত গঠনই যে নেতাজীর স্বপ্ন ছিল নিয়ে  গোপনে ছদ্মবেশে দেশ ছাড়েন । সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ বিরোধী অখন্ড ভারত গঠনই যে নেতাজীর স্বপ্ন ছিল তা তাঁর দেশ ত্যাগের পরবর্তীকালের যাবতীয় কর্মসূচী থেকেও তার প্রমাণ পাওয়া যায়। দেশে অবস্থান কালেও যেমন তিনি হিন্দু- মুসলিমদের নিয়েই রাজনৈতিক কর্মসূচী পরিচালনায় থাকেন, তেমনি দেশ ছাড়ার পরও । নেতাজীর এই ভূমিকা থেকে নরেন্দ্র মোদীরা শত সহস্র যোজন দুরেই নিজেদের রেখেছেন। বরং যে কারণে দেশ স্বাধীন ও অখন্ড রাখার ব্যাপারে হতাশ হয়ে দেশ ছাড়েন। সেই কারণ গুলিকেই সযত্নে আগলে রেখেছেন মোদী ও সহযোগীরা । নেতাজী বিরোধিতার ক্ষেত্রে নেহরু পরিবারকে অনেকে দায়ী করেন। মোদীও তাই করেছেন। বলেছেন একটি পরিবারকে বড় করতে নেতাজীকে ছোট করা হয়েছে। কিন্তু আসল সত্যটা হল – নেহরু নেতাজীর প্রতি ততটা বিরূপ ছিলেন না, হিন্দু মহাসভা বিরূপ ছিল। এই হিন্দু মহাসভা ও আজকের বিজেপি তো কার্যতঃ একই।

দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন , নেতাজী সুভাষচন্দ্র, শরৎচন্দ্র বসু, যতীন্দ্র মোহন সেনগুপ্ত, বীরেন্দ্র শাসমল, কিরণ শঙ্কর রায় প্রমূখদের অখন্ড ভারতের স্বপ্ন ব্যর্থ করে দিয়ে দেশ ভাগ মত্ত হাতির ন্যায় প্রমত্ত হয়ে ওঠে হিন্দু মহাসভা ও তাদের অনুগামী কংগ্রেসের সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী। এই পর্বে বাঙলা ভাগ তথা দেশ ভাগে যিনি মূল নেতৃত্বে ওঠে আসেন তিনি শ্যামাপ্রসাদ মুখোপ্যাধায় । তাঁর নেতৃত্বেই দেশ ভাগের দাবীতে প্রবলভাবে চিঠি- চাপাটি , স্মারকলিপি , প্রচারপত্র , জনসভা, প্রভৃতি প্রবলভাবে শুরু হয়। শেষ পর্যন্ত বাঙলা ভাগ তথা ভারত ভাগে বিধানসভা পরিষদের সদস্যদের ভোটাভোটির ব্যবস্থা করা হয় এক অদ্ভুত নিয়মে। তা হল হিন্দু-মুসলমানদের উভয় সদস্যদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা নয় , কোন একটা ধর্ম সম্প্রদায়ের অধিকাংশ সদস্য যদি দেশ ভাগের পক্ষে রায় দেয় তবেই দেশভাগ কার্যকর করা হবে। ফলে, হিন্দু- মুসলিম এর মিলিত মোট সদস্যের অধিকাংশ বাঙলা ভাগের ( পক্ষান্তরে দেশ ভাগের ) বিপক্ষে রায় দেওয়া স্বত্বেও দেশ ভাগের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়ে যায় । ১৯৪৭ সালের ২০ জুন যে ভোট গ্রহণ করা হয় তাতে মোট সদস্যের (২২০) ১২৭ জন সদস্য দেশ ভাগের বিপক্ষে এবং ৯৩ জন সদস্য দেশ ভাগের পক্ষে রায় দিলেও দেশ ভাগের সিদ্ধান্ত কার্যকর করা হয়। কারণ ৭৯ জন হিন্দু সদস্যের মধ্যে ৫৮ জন দেসভাগের পক্ষে রায় প্রদান করে। অন্য দিকে ১৪১ জন মুসলিম সদস্যের মধ্যে ১০৬ জন দেশ ভাগের বিপক্ষে রায় প্রধান করে। এমন প্রক্রিয়ায় সিদ্ধান্ত ছিল গণতন্ত্রের উপর প্রত্যক্ষ আঘাত। এই রায়ের ভিত্তিতেই দেশের দুটি গুরুপ্তপূর্ণ রাজ্যকে ( বাঙলা ও পাঞ্জাব) ভাগ করার মধ্য দিয়ে গোটা দেশকে দ্বিখন্ডিত করা হয়। লক্ষ লক্ষ নির্মম দুর্বিসহ  জীবনে যারা দেশ মাতার নামে নিক্ষেপ করে – যা থেকে তারা আজও মুক্তি পায়নি। আজ বড় ভক্ত সেজেছে তারাই সেদিন দেশকে ভাগ করার ক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকা গ্রহণ করে । দেশ ভাগের এই মর্মান্তিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হত না দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন নেতাজী সুভাষ চন্দ্রের ভাবনাকে গ্রহণ করা হত।

মোদীজিদের আরাধ্য পুরুষ শ্যামাপ্রসাদ মুখোপ্যাধায়। শ্যামাপ্রসাদ মুখোপ্যাধায় ছিলেন জমিদার ও বর্ণবাদী রাজনীতির পোষক। কংগ্রেসের অপেক্ষাকৃত নরম সাম্প্রদায়িক নীতি তাঁকে তুষ্ট করতে পারেনি বলে উগ্র সাম্প্রদায়িক রাজনীতির স্বার্থে তিনি কংগ্রেস ত্যাগ করেন কিন্তু হিন্দু মহাসভায় যোগ দেন। তিনি দ্বিজাতি তত্বেও এতটা ভক্ত ছিলেন যে হিন্দু-মুসলিম সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে যখন কাঙ্খিত দেশ ভাগের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় তখন উল্লসিত হয়ে বলেন – আজ হিন্দুদের মুক্তির দিন । শ্যামাপ্রসাদের কাছে হিন্দু বলতে বর্ণহিন্দুত্বই ছিল গ্রাহ্য। আসলে দলিত শূদ্র আদিবাসীদের আগে হিন্দু বলেই গ্রাহ্যই করা হত না; বরং ১৯২১ সালের আগে জন গণনায় তাদের হিন্দু গণ্য করতে আপত্তি জানানো হয়। এই সব প্রান্তিক জন গোষ্ঠীকে হিন্দু গন্য করার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায় যখন দেশে গণভোটের প্রসঙ্গ সামনে আসে। আর্য বর্ণবাদীরা সংখ্যালঘু হওয়ার ক্ষমতা থেকে ছিটকে যাওয়ার ভয়ে তারা এই সব পশ্চাদপদ সমাজের মানুষদের হঠাৎ দরদী হয়ে ওঠে। জনগণনায় তাদের হিন্দু গণ্য করতে চাপ দিতে থাকে। এমন কি হিন্দু করণের জন্য বিশেষ সংগঠন গড়ে কাজ শুরু করে। এই সব প্রান্তিক সমাজকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করলেও তাদের ন্যায্য অধিকার ও প্রাপ্য সম্মান দিতে রাজি ছিল না আর্য বর্ণবাদীরা । বরং তাদের বিষয়ে বরাবরই একটা ঘৃণার মানসিকতা রয়েই যায়। যে কারণে দেশ ভাগের পরও আজ পর্যন্ত এরা নানা ভাবে উপেক্ষিত- বঞ্চিত রয়ে গেছেন। এই সব প্রান্তিক সমাজও তাদের আত্মজ মুসলিমদের শ্যামাপ্রসাদ মুখোপ্যাধায় কত ঘৃণা করতেন তার প্রমাণ পাওয়া যায় একটি চিঠিতে । তিনি সর্দার বল্লভভাই প্যাটেলকে এক চিঠিতে উল্লেখ করেন – “ ইহারা ( মুসলমানরা) হইতেছে হিন্দু সমাজের তলানির নোংরা হইতে ধর্মান্তরিত এক দল মানুষ – যাহারা সবদিক দিয়া হীনতর । তাই, বাংলায় মুসলিম শাসন ও প্রাধান্য বজায় থাকিবার অর্থ সুপ্রাচীন হিন্দু সংস্কৃতিকে বিসর্জন দেওয়া – যা আমরা মানিয়া লইতে পারি না।’ ( জয়া চট্টপ্যাধায়ের ‘ বেঙ্গল ডিভাইডেড’ গ্রন্থে দুর্গাদাস বন্দ্যোপ্যাধায়ের ‘শ্যামাপ্রসাদ করসপডেন্স’ গ্রন্থ থেকে  উদ্ধৃত অংশ । দ্রঃ বঙ্গ প্রদেশের ‘ভদ্রলকশ্রেনী ও সাম্প্রদায়িকতা’ – সুকৃতি রঞ্জন বিশ্বাস, ষষ্ঠ অধ্যায়) এই মন্তব্য নিঃসন্দেহে হিটলার শাসিত জার্মানির আর্য অহমিকাকেই স্মরণ করিয়ে দেয়- সেখানে অনার্যদের শাসন করার কোন অধিকার নেই বলে মনে করা হতো। নেতাজী সমস্ত ধর্মসপ্রদায়ের মধ্যে মিলন ও সৌহার্দের সম্পর্ক গভীরভাবে কামনা করতেন। হরিপুরা সম্মেলনের ভাষণকালে বলেন- “সমাজের বিভিন্ন অংশের মানুষের বিশ্বাস, ধর্ম, সংস্কৃতির ব্যাপারে (স্বাধীন ভারতে) কোনরূপ হস্তক্ষেপ করা হবে না এবং বিভিন্ন ভাষা- গোষ্ঠী অধ্যুষিত অঞ্চলের সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য রক্ষা করা হবে।” ( নেতাজী দেশ ও জাতির সংহতি – নির্মল বসু)। ১২ সেপ্টেম্বর ১৯৪৪ রেঙ্গুন আজাদ হিন্দ রেডিও থেকে নেতাজী বলেন – “বন্ধুগণ , আমরা এক ঐক্যবদ্ধ ও স্বাধীন ভারতের জন্য লড়াই করছি। সুতরাং, আমাদের দেশকে ভাগ করার এবং একে টুকরো টুকরো করার সর্বপ্রকার প্রচেষ্টার বিরোধিতা করব আমরা।’’ ( সিলেক্টেড স্পিচেস অফ সুভাষচন্দ্র বসু , দ্রঃ প্রাগুক্ত)। মোদী- যোগীরা এই সব ভাবনার সম্পূর্ণ বিপরীত মূখী কাজ করে চলেছেন , অথচ মোদী বলছেন নেতাজীর আদর্শ বাস্তবায়ন কথা।

আসলে দেশে ফ্যাসিবাদী – বর্ণবাদী শাসন প্রতিষ্ঠায় মরিয়া হয়ে নীতি- নৈতিকতা বিসর্জন দিয়ে অনেক মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিয়ে চলেছেন মোদীজিরা। আগামীতে পশ্চিমবঙ্গকে কব্জায় আনতে বঙ্গের মনীষীদের গলায় ফুলের মালা চড়াচ্ছেন, মাথায় টুপি পরছেন, চড়া গলায় রবীন্দ্র সঙ্গীত গাইছেন, কিন্তু এঁরা আজ বেঁচে থাকলে যে দল ও সংগঠনকে সব চাইতে বেশি ঘৃণা করতেন সে দল ও সংগঠন হল বিজেপি আরএসএস । সম্প্রতি বল্লভভাই প্যাটেলের পৃথিবীর সর্বোচ্চ মূর্তি প্রতিষ্ঠা করে নিজেদের বল্লভপন্থী  পরিচয়ে মরিয়া হয়ে উঠেছেন । কিন্তু এই বল্লভভাই প্যাটেলই আরএসএস হিন্দু মহাসভাকে দেশের পক্ষে বিপদজ্জনক সন্ত্রাসবাদী আখ্যা দিয়ে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন । নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু হিন্দু মহাসভার রাজনৈতিকে কতটা ঘৃণা করতেন তার প্রমাণ নেতাজীর এই বক্তব্যে পাওয়া যায়। “ সন্যাসী ও সন্যাসিনীতিদের ত্রিশূল হাতে মহাসভা ভোটভিক্ষায় পাঠিয়েছেন। ত্রিশূল আর গেরুয়া বসন দেখলে হিন্দু মাত্রই শির নত করে । ধর্মের সুযোগ নিয়ে, ধর্মকে কলুষিত করে হিন্দু মহাসভা রাজনীতির ক্ষেত্রে দেখা দিয়েছে। এই বিশ্বাসঘাতকদের আপনারা রাষ্ট্রীয় জীবন থেকে সরিয়ে দিন । তাদের কথা কেউ শুনবেন না । আমরা চাই দেশের স্বাধীনতা প্রেমী নর-নারী এক প্রাণ হয়ে দেশের সেবা করুক।” ( তাপস সিনহাকৃত  ফেসবুক হতে, ২৫ শে জানুয়ারী ২০১৮। আইনজীবি আনিসুর রহমানের ‘ভাবো বাংলা ভাবো হতে’) নেতাজীর এই মন্তব্য একশ শতাংশই আজকের বিজেপির প্রতি প্রযোজ্য। মোদীজির কিছু মাত্র শালীনতাবোধ থাকতো তবে মতাদর্শের এই আকাশ-পাতাল প্রার্থক্য  স্বত্বেও নেতাজীর আদর্শ প্রতিষ্ঠার কথা নিশ্চয় বলতে পারতেন না।    

Back To Top