সংরক্ষনের রাজনৈতিক চমক এবং সংবিধানের মৌলিক বৈশিষ্ট্য

~তারিক আনোয়ার

নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকার যে সময় সময়ে বিভিন্ন চমক দিতে পছন্দ করে সেটা আমরা আগেও দেখেছি নোট বন্দী, গঙ্গার শুদ্ধি, স্বচ্ছ ভারত অভিযান বা আরও বিভিন্ন প্রকল্পের সৌজন্যে। যদিও প্রতিটা নতুন প্রকল্প ঘোষণার আগে অনেক স্বপ্ন দেখানো হয় কিন্তু কোনোটারই ফল প্রত্যাশা পূরণের ধারে কাছেও পৌছতে পারেনি। নোট বন্দীর ফলে কালো ধন ফেরত আসেনি, গঙ্গাশুদ্ধি প্রকল্প খাতের টাকার খুব সামান্যই খরচ হয়েছে, স্বচ্ছ ভারত প্রকল্পে অতিরঞ্জন এবং বাড়তি কর ছাড়া দেশবাসি কিছুই পায়নি।

কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভায় আর্থিক ভাবে পিছিয়ে পড়া তথাকথিত উচ্চবর্গীয় শ্রেণীর জন্য 10% সংরক্ষন পাস করে এবং লোকসভা ভোটের মাত্র 5 মাস আগে ও শীত কালীন অধিবেশনের শেষ দিনে বিলটি সাংবিধানিক সংশোধনী বিল হিসেবে সংসদে পেশ করার মাধ্যমে এই সরকার এটা বুঝিয়ে দিলো যে সংখ্যাগুরুদের মন পেতে আর দ্বিতীয় বার ক্ষমতায় আসার জন্য তারা কতটা মরিয়া। যদিও এর সাংবিধানিক বৈধতা নিয়ে যথেষ্ট প্রশ্ন আছে।

আমাদের সংবিধান প্রণেতারা সামাজিক ও শিক্ষাক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়া শ্রেণী, তপশিলি জাতি ও উপজাতিদের উন্নতির স্বার্থে এবং সামাজিক মূলস্রোতে তাদের আরও প্রতিনিধিত্ব বাড়ানোর উদ্দেশ্যে সংরক্ষনকে বৈধ করেন এবং যেটা সংবিধানের 15 ও 16 নম্বর অনুচ্ছেদে বর্ণিত আছে। এখানে বিশেষ ভাবে লক্ষণীয় যে আর্থিক ভাবে তাদের উন্নতি করা কিন্তু মূল উদ্দেশ্য ছিল না, সামাজিক অন্তর্ভুক্তি করণই মূল উদ্দেশ্য ছিল যেটা সমাজের তথাকথিত উচ্চ শ্রেণীর মানুষ অস্বীকার করে এসেছে শতাধিক বছর ধরে। সুতরাং এটাকে সংবিধানের অন্যতম মৌলিক বৈশিষ্ট্য হিসেবে গণ্য করা যায়।

সংরক্ষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ

1973 সালে বিখ্যাত কেশবানন্দ ভারতী কেসের রায়ে মাননীয় সুপ্রিম কোর্ট এটা পরিষ্কার করে দেয় যে সাংবিধানিক সংশোধনী আইনের মাধ্যমে সংসদ সংবিধানের এমন কেন সংশোধন করতে পারবে না যেটা সংবিধানের মৌলিক গঠন বা বৈশিষ্ট্যের পরিপন্থি। সুতরাং সরকারকে এই সংরক্ষনকে সাংবিধানিক বৈধ প্রমান করতে হলে এটা দেখাতে হবে যে আর্থিক ভাবে পিছিয়ে পড়া তথাকথিত উচ্চশ্রেণীর মানুষরা সামাজিক ভাবেও পিছিয়ে বা সামাজিক মূলস্রোতের বাইরে আছে কিন্তু সেটা প্রমানের কোনো গবেষণা মূলক তথ্য সরকার এখনো পর্যন্ত রাখতে পারেনি।

এই বিল অনুযায়ী সংরক্ষণের লাভ পেতে হলে তথাকথিত উচ্চশ্রেণীর কোনো পরিবারের বাৎসরিক আয় 8 লাখ টাকার কম হতে হবে। এটা সহজেই অনুমেয় যে,  এর ফলে 80% এরও বেশি পরিবার এই শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত হবে। যদি সরকার একটি পরিসংখ্যান বের করার সাহস করে যে কত জন তথাকথিত উচ্চশ্রেণীর মানুষ বিভিন্ন সরকারী দপ্তর বা সরকারী কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরিরত তাহলে দেখা যাবে 10% এর অনেক বেশি ইতিপূর্বেই এই শ্রেণীর লোক সেখানে বর্তমান। সুতরাং এই সংরক্ষনটি এমন যেন কারও পকেটে থাকা চকোলেট নিয়ে তারই মুখে দিয়ে কৃতিত্ব দাবি করার মত।

সরকারের এই সিদ্ধান্ত সুপ্রিম কোর্টের 1963 সালের সেই আদেশ কেও লংঘন করে যেখানে একই বছরে কোনো সরকারী চাকরিক্ষেত্রে 50% এর বেশি সংরক্ষন দেওয়াকে  অসাংবিধানিক ঘোষণা করা হয়েছে।

আর্থিকভাবে পিছিয়ে পড়া শ্রেণীর উন্নতির জন্য ইতিপূর্বেই ইন্দিরা আবাস যোজনা, মনরেগা বা 100 দিনের কাজের প্রকল্প, স্কিল ডেভেলপমেন্ট প্রকল্প ও আরও অনেক প্রকল্প বর্তমান আছে এবং সরকার চাইলে আরও অনেক প্রকল্প চালু করতেই পারে কিন্তু আর্থিক উন্নতির জন্য সংরক্ষন সংবিধানের মৌলিক গঠনের পরিপন্থী।

সংরক্ষণের দাবীতে হার্দিক প্যাটেলের নেতৃত্বে জনসভা, স্থান গুজরাট

নরোসিমা রাও সরকার 1991 সালে অনেকটা একই রকম সংরক্ষণ বলবৎ করার চেষ্টা করেছিল কিন্তু সেটা 1992 সালে বিখ্যাত ইন্দিরা সাউনি কেসের রায়ে মাননীয় সুপ্রিম কোর্ট প্রত্যাখান করেছিল কারণ এটাকে আমাদের সংবিধান সমর্থন করে না।

এই সরকার দলিত ও সংখালঘুদের ব্যাপারে কতটা উদাসীন সেটা দেশের বিভিন্ন প্রান্তে এই শ্রেণীর উপর অত্যাচারের ঘটনায় প্রধানমন্ত্রীর মৌনতা ও এর প্রতিকারের জন্য কোনো নীতিগত সিদ্ধান্ত না নেওয়াতেই প্রকাশ পায়।

সুতরাং, সংখ্যা গুরু শ্রেণীর মন পেতে বর্তমান সরকারের এই সাংবিধানিক সংশোধনী আইনের মাধ্যমে সংবিধানের মৌলিক বৈশিষ্টের পরিবর্তনের প্রচেষ্টার অন্তরে কোনো গভীর ষড়যন্ত্র থাকতেই পারে এবং পরবর্তী কালে যার বহিঃপ্রকাশ ঘটতে পারে অন্য কোন সাংবিধানিক সংশোধনী বিল এর সৌজন্যে যা হয়তো ভারতের জাতীয় সংহতির পক্ষে বিপজ্জনক হতে পারে।

Back To Top