সংবিধানের ৩০ ধারা ও মাইনোরিটিদের  শিক্ষার অধিকার

~মুন্সী আবুল কাশেম

ইংরেজরা সুদূর বিলেত থেকে ব্যবসা করতে এদেশে এসেছিল । নবাব বাড়ির ঝগড়া ঝাটির সুযোগ নিয়ে পুরো দেশটায় দখল করে নিল। কমবেশি ২০০ বছর তারা এদেশ শাসন করেছিল- শোষণ করেছিল। কিছু লোককে কাছে টেনেছিল, বাকি লোকদের দূরে ঠেলে দিয়েছিল। যাদের কাছে টেনেছিল তাদের পরিচয় হল জোতদার, জমিদার, মিলমালিক, বড়লোক। ভদ্র ভাষায় যাদের বলা হয়েছিল ‘হ্যাভ’। তাদের জন্য তৈরি হয়েছিল শহর যেগুলি পাকা বাড়ি, পাকা রাস্তা, স্কুল, কলেজ, হাসপাতাল, বৈদ্যুতিক আলো ইত্যাদি দিয়ে সাজানো। বাকি দেশটা ছিল অন্ধকারে ঢাকা। যেখানে না ছিল আলো, না ছিল রাস্তা, না ছিল স্কুল, না ছিল হাসপাতাল। সেগুলিকে বলা হত অজ পাড়া গাঁ।

স্বাভাবিক কারণে দেশের মানব সমাজ দু ভাগে ভাগ হল- শিক্ষিত শহরবাসী ও অশিক্ষিত গ্রামবাসী। শহর ছিল উচ্চ বর্গীয়দের বাস আর গ্রাম হল নিন্ম বর্গের –‘হ্যাভ নট’ দের।

গ্রাম্য নিন্মবর্গের সিংহ ভাগ ছিল মুসলিম ও নিম্নমানের হিন্দু যাদের পরবর্তী কালে বলা হয়েছিল তপসিলি/ উপ- তপসিলি সম্প্রদায়। মুসলিমদের ডাক নাম ছিল কফিলদ্দিন সরদার , আকবর সাফুই, দিলদার লস্কর, আর হিন্দু তপসিলি লোকদের নাম ছিল মনোরঞ্জন সরদার, শৈলেন সাফুই, নিতাই  লস্কর। উভয় সম্প্রদয়ের জীবনযাত্রা ছিল একই রকমের। অশিক্ষা, অজ্ঞতা, দুঃখভরা জীবন।

অবশেষে ইংরেজরা চলে গেল। এদেশে কায়েম হল গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা – ভোটের হিসাবে শাসক গোষ্ঠী তৈরী হবে। তারা দেশ চালাবে। তবে রাজা-বাদশাদের মত নিজের ইচ্ছায় নয়- লিখিত-সংবিধান অনুযায়ী। এই সংবিধান গণতন্ত্রের রক্ষাকবচ।

সংবিধানে লেখা হয়েছে দেশের সব মানুষ এক, সকলের জন্য সমান আইন। সমান অধিকার। কিছু মানুষ বললেন- সে আবার কি কথা? শহরে আলো আছে, বাতাস আছে, স্কুল আছে , কলেজ আছে, পড়াশোনার সুযোগ আছে, আর গ্রামে তার কিছুই নেই। লেখাপড়া শেখার সুবাদে শহরের লোকেরা সরকারী দপ্তরে কাজ পাবে। অন্য সরকারী সুযোগ সুবিধা ভোগ করবে, তাদের বুদ্ধি বিকশিত হবে, বুদ্ধিদীপ্ত দক্ষতা বাড়বে। কিন্তু গ্রামের কি পাবে? আধারে ঢাকা গ্রামে স্কুল নেই, কলেজ নেই, লেখাপড়া করার সুযোগ নেই। তারা সমান অধিকারের সুযোগ পাবে কি ভাবে?

ব্যাপারটা ভাববার বিষয় বৈকি। জাতীয় সরকারের বিশেষ সাহায্য না পেলে তারা উঠবে কি ভাবে? এর উত্তরে লেখা হল যারা তপসিলি বা উপ- তপসিলি সম্প্রদায়ের মানুষ তাদের সামগ্রিক মান উন্নয়নে লেখাপড়া শেখার এ সরকারি দপ্তরে কাজের সুযোগ পাওয়ার জন্য বিশেষ ছাড় দেওয়া হবে ( সংবিধান-১৫(৪))। কিছুটা সুবিধা হল বটে মনোরঞ্জন সরদার, শৈলেন সাফুই, নিতাই লস্করদের।

কিন্ত গাঁ – গ্রামে বসবাসকারি কফিলদ্দি সরদার, আকবর সাফুই, দিলদার লস্করদের কি হবে? সংবিধান তাদের জন্য বিশেষ কোন ছাড়ের ব্যবস্থা করেনি। তাহলে উপায়? উত্তর খুঁজে পাওয়া যায়নি। তারা তৈলাক্ত বাঁশে আরোহণ করতে গিয়ে পিছলে পড়ে যাচ্ছে। কে তাদের ঠেকাবে?

সংবিধান অবশ্য তাদের হতাশ করেনি। সংবিধানে বলা হয়েছে ভোট গুনতির হিসাবে যারা সংখ্যায় কম, যারা কখনই রাজ ক্ষমতা লাভে সমর্থ হবেনা- তাদের শিক্ষার সুযোগ করে দিতে হবে। তাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অধিকার দিতে হবে, তাদের ছেলে মেয়েদের শক্ত হাতে কলম ধরতে শেখাতে হবে। এটি সংবিধানের ৩০ ধারা। সংবিধানে এই ধারা লিপিবদ্ধ হল ১৯৪৯ সালের ২৬ শে নভেম্বর। বলা হয়েছে ৩০(১)- ‘সকল সখ্যালঘুগণ, ধর্ম বা ভাষা ভিত্তিক যাই হোক তাদের পছন্দ মতো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান করতে ও পরিচালনা করার অধিকারী থাকবেন’। ৩০(২) ‘ রাজ্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহে আর্থিক সহায়তা প্রদানকালীন, কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সম্পর্কিত এই কারনের ভিক্তিতে বাছবিচার করবে না যে, এটি সংখ্যালঘু দ্বারা পরিচালিত, সেটি ধর্ম বা ভাষা যা কিছুর উপর ভিত্তি করে হোক’।

30(1) – All minorities whether based on religion or language, shall have the right to establish and administer educational institutions of their choice’.

30(2) – ‘The state shall not, in granting aid to educational institution, discriminate against any educational institution on the ground that is under the management of a minority, whether based on religion or language’.

Minority বলতে অবশ্য মুসলিম জনগোষ্ঠীকে বোঝায় না- এ দেশের খ্রিষ্টান, বৌদ্ধ, জৈন, শিখ, ইত্যাদি জনগোষ্ঠী ধর্মীয় সংখ্যালঘু অন্তর্ভুক্ত। তবে মুসলিম জনগোষ্ঠী বৃহত্তম সংখ্যায় সংখ্যালঘু।

এই বিধানের মূল কথা – সংখ্যালঘু উন্নত মানের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করুক, স্বাধিকার বলে সেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করুক, উপযুক্ত মানের শিক্ষায় সমাজকে উদ্বুদ্ধ করুক যাতে তাদের ভবিষ্যৎ তীব্র রাষ্ট্রীয় সাফল্য পেতে পারে। প্রতিযোগিতার রণাঙ্গনে সবাই সমান – তাদের ধর্ম, বংশ মর্যাদা, শ্রেণী, সংখ্যা, লিঙ্গ,যাই হোক না কেন। ৩০ ধারার বিধিমতে প্রতিষ্ঠিত বিদ্যালয় ও মহাবিদ্যালয়ের শিক্ষা এমন পর্যায়ে নিয়ে যেতে হবে যেখানে ছেলে মেয়েরা প্রতিযোগিতা মূলক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবার শক্তি অর্জন করতে পারে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপনের এটি তাদের চয়েস বা পছন্দ মাফিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান । সংবিধানে ৩০(১) ধারা প্রবর্তনে সার্থকতা সেখানেই। মুসলিম সংখ্যালঘুসহ অন্যান্য সংখ্যালঘু সমাজ যারা সংবিধান প্রদত্ত শিক্ষা ও সরকারী চাকুরির ক্ষেত্রে বিশেষ সুযোগের অধিকারী নয় তাদের জন্যই ৩০(১) ধারার প্রবর্তন।

শিক্ষা প্রবর্তনের স্থাপনের অধিকারটায় শেষ কথা নয়, সংবিধানের ৩০(১) ধারায় বলা হয়েছে সেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিচালনার ক্ষেত্রে প্রতিস্থানের সংখ্যালঘু সংস্থার স্বাধিকার থাকবে। বিভিন্ন আদালতের রায়ে এই মত প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যে সংখ্যালঘু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় কমিটি গঠন শিক্ষক নিয়োগ, ছাত্র-ছাত্রী ভর্তি ইত্যাদি বিষয়ে সংখ্যা সমাজের অধিকার বজায় থাকবে।

সমস্যার কথা মুসলিম সংখ্যালঘু সমাজ প্রতিষ্ঠিত শিক্ষা প্রতিস্থানের চলতি ব্যবহার নির্ভর হবে কিভাবে? এদেশের পশ্চাৎপদ জনজাতির ভিতর থেকে যে জনগোষ্ঠীর উত্থান , ব্রিটিশ আমলে যে জনগোষ্ঠী চরম উৎপীড়নের স্বীকার, যার আর্থসামাজিক ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়া, দৈহিক পরিশ্রমের বিনিময়ে যে সমাজের অধিকাংশ মানুষের জীবিকা নির্বাহ হয়- তারা কি পারবে বেসরকারি সংখ্যালঘু প্রতিষ্ঠানে বেতন দিয়ে ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা করাতে? উত্তর হবে নঞর্থক।

ঐতিহ্যবাহী হুগলী মাদ্রাসা রাজ্য সরকার দ্বারা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।

সংখ্যালঘু সমাজের সৌভাগ্যের কথা যে এর উত্তর সংবিধানে দেওয়া আছে। ৩০(২) ধারায় বলা হয়েছে সংখ্যালঘু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় সরকারী আর্থিক অনুদানে যেন কোন প্রকার বৈষম্য না হয়। দেশের অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় সরকারী অনুদান যে হারে বরাদ্দ হয় সংখালঘু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জন্য তার কোন ব্যতিক্রম হবেনা।

নিঃসন্দেহে বলা যায় মুসলিম সমাজের জন্য এটি এক অনন্য সাধারণ অধিকার। এই অধিকার কার্যকারী হলে মুসলিম সমাজের ছেলেমেয়েরা উপযুক্ত মানের লেখাপড়া শিখে বৃহত্তর সমাজের ছেলেমেয়েদের সঙ্গে তীব্র প্রতিযোগিতা মুলক পরীক্ষায় অংশ নিতে পারত এবং সরকারী প্রাশাসনিক ক্ষমতা দখল করতে পারত। যেমন পারে স্বয়ং– শাসিত প্রতিষ্ঠান রামকৃষ্ণ মিশন ও খ্রিষ্টান মিশনারী স্কুল।

কিন্তু হলো কই? ১৯৪৯ সালে ২৬ শে নভেম্বর যে ধারায় আত্মপ্রকাশ হয়েছে তা অচর্চিত রয়ে গেল ২০০৮ সালের ৩০ শে জুন পর্যন্ত। এই দীর্ঘ সময়ের মধ্যে সংবিধানের ৩০ ধারার মৌলিক অধিকার বাস্তবে প্রয়োগ হয়নি। রাজ্য সরকার করে নি কিংবা সংখ্যালঘু মুসলমান সমাজ এ নিয়ে বিশেষ আন্দোলন করেছিল বলেছিল শোনা যায় নি। দু- একটি ক্ষেত্রে ক্ষীণকন্ঠে মুসলিম সংখ্যালঘুদের দু এক জন আওয়াজ তুলেছিলেন বটে কিন্তূ তা অচিরে হাওয়ায় মিলিয়ে যায়।

আমাদের রাজ্যে অবশ্য পুরোপুরি সরকারি ব্যবস্থাপনায় ও সরকারী আর্থিক সাহায্যে সিনিয়র মাদ্রাসা (পরিবর্তিত পাঠ্যসূচী অনুযায়ী) ও হাই মাদ্রাসা (রিফরমড মাদ্রাসা) পরিচালিত হচ্ছে। এই সব মাদ্রাসা পরিচালনার পূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন সরকার মনোনীত মাদ্রাসা বোর্ড। মাদ্রাসাগুলি পরিচালিত হয় সরকার নির্ধারিত নিয়মে গঠিত কমিটির মাধ্যমে। মাদ্রাসা বোর্ড কমিটি অনুমোদন দেন অথবা প্রয়োজনে বাতিল করেন। শিক্ষক নির্বাচনের দায়িত্ব থাকে মাদ্রাসা বোর্ডের উপর। এক কথায় বলা যায় পুরোপুরি সরকারি নিয়ন্ত্রনাধীন। দেশের দুর্বল শ্রেণীর জন্য সাধারণ শিক্ষা বিস্তারের যে দায়িত্ব সরকারের উপর ন্যস্ত আছে এগুলি তারই বাস্তব প্রয়োগ ( সংবিধানের ৪৬ ধারা)

এই সব মাদ্রাসাগুলি সরকারি ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত হয় তাই এগুলি কোন ভাবেই সংবিধানের ৩০ ধারার অন্তর্ভুক্ত হওয়ার কথা নয়। ৩০ ধারার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন ও পরিচালনার অধিকার একান্তই নাগরিকদের মৌলিক অধিকার-সরকার সম্মতি প্রদান করবেন এবং আর্থিক সাহায্য দেবেন কিন্তু পরিচালনায় অহেতুক হস্তক্ষেপ করবেন না এটি ৩০ ধারার বিধান।

৩০ ধারার অধিকার বলে প্রতিষ্ঠিত সংখ্যালঘু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসাবে গণ্য করা সমীচীন নয়। ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান স্থাপন ও পরিচালনার অধিকার দেওয়া আছে সংবিধানের ২৫ ও ২৬ ধারায়। জনশৃঙ্খলা, নৈতিকতা ও জনস্বাস্থ্য রক্ষার অঙ্গীকারে যে কোন ধর্মীয় সম্প্রদায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন ও পরিচালনা করতে পারে। সাধারণ ভাবে রাষ্ট্র তার উপর হস্তক্ষেপ করেন না । সে সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় সরকারি অর্থ বরাদ্দ করার নিয়ম নেই।

সরকারি অনুদানে ও সরকারি ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত সিনিয়র মাদ্রাসা ও হাই মাদ্রাসা (সংখ্যায় ৬১৪) থেকে পাশ করা ছেলেমেয়েরা উচ্চশিক্ষা লাভে অথবা রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত প্রতিযোগিতা মূলক  পরীক্ষায় কতটা সাফল্য পাচ্ছে তার পরিসংখ্যান নিয়ে বিদ্বজ্জন মহলে যথেষ্ট হতাশার সুর প্রতিধ্বনিত হতে থাকে। দেশের বৃহৎ সংখ্যায় সংখ্যালঘু সমাজ জাতীয় জীবনের মূলস্রোত থেকে ক্রমশঃ পিছিয়ে পড়লে সামগ্রিক ভাবে দেশের ক্ষতি। কেন্দ্রীয় সরকারের চিন্তা ভাবনায় এলো – মুসলিম সমাজকে এই অবক্ষয় থেকে বাঁচাতে হবে।

এই সংকট থেকে পরিত্রাণ লাভের প্রত্যাশায় মহামান্য কেন্দ্রীয় সরকার ২০০৫ সালে মাননীয় বিচারপতি রাজিন্দর সাচার সাহেবের নেতৃত্বে উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন শিক্ষা কমিশন গঠন করেন (সংবিধানের ৩৪০ ধার) আর্থ – সামাজিক ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়া মুসলিম সমাজে শিক্ষার উন্নয়ন ঘটিয়ে প্রতিযোগিতার বাজারে বৃহত্তর সমাজের সঙ্গে সমন্বয় ঘটানো যায় কি না তার পন্থা উদ্ভাবনের দায়িত্ব দেয়া হয় এই মহামান্য সাচার কমিশনকে । এই কমিশনের রিপোর্টে ধ্বনিত হল ৩০ ধারার ডাক । কোয়্যালিটেটিভ এডুকেশনের জন্য মুসলিম সমাজ নিজ উদ্যোগে উপযুক্ত মর্যাদার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করবেন – পরিচালনা করবেন। সরকার তার পাশে থাকবেন।

ভারত সরকার ২০০৪ সালের ১১ই নভেম্বর National commission for minority Educational institutions Act-2004 প্রণয়ন করেন। সংখ্যালঘু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপনের নিয়ম কানুন বিধিবদ্ধ এবং ভারতের (জন্মু কাশ্মীর ছাড়া) সব রাজ্যে নির্দিষ্ট নিয়মে সংখ্যালঘু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠায় উৎসাহ দেওয়া এই আইনের মুখ্য উদ্দেশ্য। সারা দেশে মুসলিম সংখ্যালঘুদের মধ্যে স্ব-শাসিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপনে উৎসাহ দেওয়ার দায়িত্ব এই কমিশনের উপর ন্যস্ত হয়।

সে ডাকে সাড়া দিয়ে পশ্চিমবঙ্গ সরকার ২০০৮ সালে ৩০ শে জুন তারিখে প্রকাশ করলেন – Guidelines for recognition of educational institution as minority Educational institution in West Bengal : Minority Affairs and madrasah education department ,Govt. of West Bengal, GO No. 942 – MD dt. 30.06.2008 স্বাধীনোত্তর পশ্চিমবঙ্গে সরকারি অনুমোদিত ও সাহায্য প্রাপ্ত মাদ্রাসাগুলি দেখভালের দায়িত্ব পালন করত মাদ্রাসা এডুকেশন ডিপার্টমেন্ট – যোগ হল মাইনরিটি অ্যাফেয়ার্স। নতুন বিভাগ হল মাইনরিটি অ্যাফেয়ার্স অ্যান্ড মাদ্রাসা এডুকেশন ডিপার্টমেন্ট।

এই গাইড সূচনায় বলা হল ‘For identification of such minority educational institution already established and are being administered as such the state Government shall verify the status of institutions in the light of norms prescribed hereunder and issue necessary certificate so that such institutions can be associated with various state-aid- schemes for education intervention in minority development’.

নতুন সংখ্যালঘু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপনের উৎসাহ এখানে অনুপস্থিত। ঈঙ্গিত এই যে এই রাজ্যে ইতিমধ্যে যে সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সংখ্যালঘু মুসলিম সমাজ দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সে গুলিকে চিহ্নিত করা এবং সেগুলিকে সংখ্যালঘু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মর্যাদা দেওয়া যাতে ঐ সব প্রতিষ্ঠানের পক্ষে সরকারি সাহায্য বরাদ্দ করা যায়। চিহ্নিত করণের কাজটি সুস্থভাবে করার জন্য ঐ গাইড লাইনের ১ (৯) ধারার সংযোজন উল্লেখ করা প্রয়োজন – ১(৯) ধারা – Notwithstanding anything contained in the foregoing criteria the state Government may suo moto declare any educational institutional institution as minority Educational institution which in the opinion of the Gov. Satisfied the spirit of art 30(1) of the constitution of India and was recognized and aided by Govt. before coming effect of the procedure herein prescribed. সরকারের মতে যে সকল সংখ্যালঘু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সরকারি অনুমোদন পেয়েছে এবং সরকারি আর্থিক সাহায্য পাচ্ছে তাদের পক্ষেই সরকার নিজ বিবেচনায় ৩০(১) ধারা অনুযায়ী সংখ্যালঘু প্রতিষ্ঠানের মর্যাদা দেবেন।

এই বিধির বাস্তব প্রয়োগ করতে গিয়ে রাজ্য সরকার স্বাধীনতার পর এ পর্যন্ত যে সকল সিনিয়র ও হাই মাদ্রাসা সরকার অনুমদিত ও সাহায্য প্রাপ্ত হয়েছে কেবল মাত্র সেগুলির পক্ষে সংখ্যালঘু স্ট্যাটাস বরাদ্দ করেন (২০১০ সাল সংখ্যায় ৬১৪)। সরকারি দয়ার দানে পাওয়া মাইনরিটি স্ট্যাটাস সার্টিফিকেট মাদাসা গুলির কতটা উপকার হয়েছে টা নিয়ে অবশ্যই নানা বিতর্ক আছে, তবে এর ফলে মাদ্রাসাগুলি নানাবিধ জটিল আইনি গেরোয় আটকে যাওয়ার সম্ভবনার সুত্রপাত হয়েছে।

(ক) ৩০ ধারার মূল কথা সংখ্যালঘু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় পুরোপুরি সরকার নিয়ন্ত্রনমুক্ত হবে। পরিচালনা সমিতি গঠনে , শিক্ষক নিয়োগে কোন সরকারী হস্তক্ষেপ হবে না।

প্রশ্ন উঠলো যে সব সরকারি মাদ্রাসা ইতিমধ্যে পুরোপুরি সরকারি নিয়ন্ত্রনে পরিচালিত হচ্ছে মাইনরিটি স্ট্যাটাস পাওয়ার পর সেগলিকে সরকারি নিয়ন্ত্রনমুক্ত করা কি সংগত বা সম্ভব হবে?

সরকারি হাইমাদ্রাসা ও সিনিয়র মাদ্রাসায় যে সব শিক্ষক সরকারি বিধানে নিযুক্ত হয়েছেন তারা কি রাজি হবেন সরকার সুযোগ সুবিধা প্রত্যাহারে?

সরকারি পরিচালনাধীন মাদ্রাসার শিক্ষক নিয়োগের পূর্ণ ক্ষমতা কি মাদ্রাসা কমিটির হাতে থাকবে?

মাদ্রাসা পরিচালনা সমিতির গঠনের পদ্ধতি বা কি হবে?

তাছাড়া ধারার অধিকার ব্যক্তির বা সমষ্টিগত নাগরিকের মৌলিক এই অধিকার অধিকারের সুযোগ সরকার ব্যবহার করবেন কিভাবে?

(খ)  মুসলিম সংখ্যালঘুদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হাই মাদ্রাসা ও সিনিয়ার মাদ্রাসাগুলি যদি সংখ্যালঘু স্ট্যাটাস পেতে পারে তাহলে মুসলিম সমাজ প্রতিষ্ঠিত ও পরিচালিত স্কুল / কলেজগুলির পক্ষে রাজ্যসরকার সংখ্যালঘু স্ট্যাটাস বরাদ্দ করবেন না কেন?

(গ) যে সমস্ত মুসলিম শিক্ষা প্রতিষ্ঠান (স্কুল/কলেজ) কেন্দ্রীয় সরকারের National Commission for minority Educational institutions পক্ষ থেকে মাইনরিটি স্ট্যাটাস প্রাপ্ত স্কুল /কলেজ হিসাবে ঘোষিত হয়েছে সেগুলির পক্ষে সরকারী সকল প্রকার গ্রান্ট বরাদ্দ হবেনা কেন?

(ঘ) মাইনরিটি স্ট্যাটাস প্রাপ্ত স্কুল / কলেজ দেখভালের দায়িত্ব Minority Affairs and madrasah Education Department এর হাতে থাকবে নাকি অন্য কোন সরকারি সংস্থার হাতে দেওয়া হবে?

স্যার সৈয়দ আহমেদ প্রতিষ্ঠিত আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়

এ সব প্রশ্নের পাশাপাশি ৯৪২ – এম .ডি গাইড লাইনএ V(4) ধারাটি পর্যালোচনা করার প্রয়োজন – There shall be no discrimination for such Minority education institutional for providing other aids by Government in consonance with the spirit of Article 30(2) of the Constitution of India. এই ধারায় other aid কথাটি সংযোজিত হয়েছে কিন্তু সনবিধানের ৩০(২) ধারায় বলা আছে।

-৩০(২) The state shall not , in granting aid to education al institutions discriminate against any educational institution on the ground that under the management of minority, whether based on religion or language.’ সরকারি অনুদান পাওয়ার ক্ষেত্রে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গুলি কোনরুপ আর্থিক বৈষম্যের স্বীকার হবেনা। সংবিধানে বলা হয়েছে No discrimination in granting aid সংবিধানে other aid  কথটি উল্লেখ নেই। প্রশ্ন দেখা দিচ্ছে সংবিধানিক কোন অধিকার কাটছাঁট ক্ষমতা রাজ্য সরকারের আছে কি? উত্তর না।

GO 942 MD dt. 30.06.2008 Guideline নতুন কোন সংখ্যালঘু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের স্থাপনের সুযোগ বা উৎসাহ দেওয়া হয়নি। ২০০৪ সালে কেন্দ্রীয় সরকার সংখ্যালঘু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপনের অধিকার কার্যকারী করার জন্য নানা বিধ আইন প্রণয়ন করেছিলেন এবং রাজ্যগুলি যাতে সেই অধিকার কার্যকারী করেন তার নির্দেশ দিয়েছেন। কিন্তু দুঃখের বিষয় রাজ্য সরকার প্রণীত উক্ত গাইড লাইনে কেন্দ্রীয় সরকারের এই নির্দেশ (সাচার কমিটি মতামত) মান্যতা পায়নি।

২০১২ সালের ১০ এপ্রিল তারিখে পশ্চিমবঙ্গ সরকার মাইনরিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নতুন গাইড লাইন প্রকাশ করেন। ঐ গাইড লাইনের বিষয় বস্তু ছিল Guideline for grant of no objection certificate and minority educational institution status certificate to a minority educational institution- No.378MD(v)-33/09-5th April 2012. এই গাইড লাইনের মাধ্যমে পূর্বতন গাইড লাইনে (GO942MD) কিছু পরিবর্তন করা হয় । বলা হয়েছে নতুন কোন সংখ্যালঘু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান করতে হলে রাজ্য সরকারের ভারপ্রাপ্ত অফিসারের কাছে No objection certificate এর জন্য নির্দিষ্ট নিয়ম পদ্ধতি অনুযায়ী আবেদন করতে হবে। রাজ্য সরকার যথানিয়মে আবেদন বিবেচনা করবেন এবং প্রয়োজনীয় পারমিশান বা নির্দেশ দেবেন। রাজ্য সরকারের আদেশের সঙ্গে সহমত না হলে মাইনরিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি কেন্দ্রীয় সরকারের National Commission for Minority Education  Institutions এর দরবারে পুনর্বিবেচনার জন্য আবেদন করতে পারবেন।

অনুরুপ ভাবে প্রতিষ্ঠিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলি মাইনরিটি স্ট্যাটাস পাবার জন্য নির্দিষ্ট বিধিমতে রাজ্য সরকারের দপ্তরে আবেদন করতে পারবেন- পূর্ব No objection certificate  না থাকলেও। রাজ্য সরকার বিবেচনা করবেন প্রয়োজন হলে কেন্দ্রীয়  National Commission  এর দপ্তরে আপিল করা যাবে।

কেন্দ্রীয় National Commission 11(f) ধারা অনুযায়ী মাইনরিটি স্ট্যাটাস  সংক্রান্ত যে কোন আবেদন বা অভিযোগ বিবেচনা করতে পারবেন এবং যথা নিয়মে প্রতিষ্ঠানের পক্ষে মাইনরিটি স্ট্যাটাস সার্টিফিকেট দিতে পারবেন, যেটি সর্বক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে।

রাজ্য সরকার No objection পাবার জন্য যেমন নির্দিষ্ট বিধি আছে তেমনি প্রতিষ্ঠিত কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জন্য মাইনরিটি স্ট্যাটাস লাভে নির্দিষ্ট বিধি আছে – তবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি রাজ্য সরকারের Recognized হতে হবে।

কোন কোন মহল এরূপ প্রশ্ন উঠেছে যে যেহেতু সংবিধানের ৩০ ধারার বিধান নাগরিকের মৌলিক অধিকার এর পর্যায়ভুক্ত তাই মাইনরিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জন্য পূর্ব No objection এর প্রয়োজন হবে কেন? সরকারের দায়িত্ব নাগরিকের মৌলিক অধিকার বাস্তবায়নে প্রটেকশান দেওয়া যদি না সে অধিকার অপরের ক্ষতির কারণ হয়। কোয়্যালেটেটিভ শিক্ষার প্রসারে নিবেদিত মাইনরিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সমাজের মঙ্গল ও উন্নয়নে হাতিয়ার। সে কারণ মাইনরিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠায় সরকারের আনকন্ডিশনাল সাহায্য ও সম্মতি প্রয়োজন।

দুঃখের সঙ্গে উল্লেখ করা যেতে পারে যে মাইনরিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পক্ষে সরকারি যাবতীয় গ্রান্ট বরাদ্দ হবে- এটি ৩০ ধারার বিধান কিন্তু রাজ্য সরকার ২০১২ (No.378MD(v)-13M(v)-33/09-5th April 2012)। এর বিধানে 7(9) ধারার মাধ্যমে পূর্বতন বিধানের ২০০৮ এর V(4) ধারাটি অবিকৃত অবস্থায় বজায় রেখেছেন।সে হল ‘There shall be no discrimination for such minority Educational institutions for providing other aids by the Government in consonance with the spirit of Article 30(2) of the constitution of India’। সংবিধানে উল্লেখিত  No discrimination in granting aid  এর রাজ্য সরকারের প্রণীত বিধিমতে other aid এর ব্যাখ্যা নিয়ে আমলা তান্ত্রিক দ্বন্দ্ব অদ্যাবধি অব্যাহত। ফলে ভাগ্যহত মাইনরিটি স্ট্যাটাস প্রাপ্ত  শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গুলি (স্কুল/ কলেজ) কোন রকম গ্রান্ট পাচ্ছেনা। সংখ্যালঘু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পক্ষে আর্থিক অনুদানের লাভের সংবিধানিক অধিকার আছে কিন্তু বিধির বিধানে তার অবস্থান হিমঘরে।

কে বাঁচাবে শিক্ষায় ও আর্থিক- সামাজিক ক্ষেত্রে পেছিয়ে পড়া মুসলিম সমাজকে?

 

(লেখাটি মুন্সী আবুল কাশেম প্রণীত “৩০ ধারার ডাইরি” বই থেকে অনুমতিক্রমে এখানে প্রকাশ করা হল। আবুল কাসেম মুন্সী সাহেব একাধারে প্রাবন্ধিক, সমাজসেবী, আইনজীবী এবং সেই সাথে বিখ্যাত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ‘শিশু বিকাশ অ্যাকাডেমির’ প্রতিষ্ঠাতা এবং সাধারণ সম্পাদক।)

(কেমন লাগছে আমাদের কাজ? মতামত জানান কমেন্ট করে অথবা মেল করুন mydinkal@gmail.com -এই ঠিকানায়। যদি ভালো লাগে তাহলে শেয়ার করতে ভুলবেন না।)

 

Back To Top