মুর্শিদাবাদে ওয়াকফ সম্পত্তি উদ্ধারঃ বোর্ডকে গুরুত্ব দিচ্ছে না জেলা প্রশাসন

 

পশ্চিমবঙ্গ ওয়াকফ বোর্ডের নির্দেশ অমান্য করে চলেছে মুর্শিদাবাদ জেলাপ্রশাসন গত কয়েক মাস ধরে। ‘আফসার আলি ওয়াকফ এস্টেট’ এর সম্পত্তি অন্য নামের রেকর্ড সংশোধন করে রাজ্য ওয়াকফ এস্টেট এর নামে রেকর্ড করার জন্য রাজ্য ওয়াকফ বোর্ড ভূমি-রাজস্ব দপ্তরকে চিঠি লেখে। কয়েক মাস পরেও সেই কাজ করেনি সেই দপ্তর। ‘আফসার আলি ওয়াকফ এস্টেট’ অবস্থিত মুর্শিদাবাদ জেলার বেলডাঙ্গা ২ ব্লকের শক্তিপুর থানার মিলকি গ্রামে।

 

ঘটনার সুত্রপাত ১৯৫৮ সাল। দলিল পত্র অনুযায়ী, ১৭৯৩ সালের দিকে এলাকার বিখ্যাত দানবীর মরহুম আফসার আলি মসজিদের নামে প্রায় ১১০ বিঘা সম্পত্তি ওয়াকফ করেন। যতদিন তিনি জীবিত ছিলেন তিনিই সেই জমির মুতাওয়াল্লি (রক্ষণাবেক্ষণকারী) থাকলেও তাঁর মৃত্যুর পর বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন জনের হাতে যায় মুতাওয়াল্লির রাশ। শেষ পর্যন্ত ১৯৫৮ সালে গোলামপীর নামে এক ব্যক্তিকে ওই সম্পত্তির মুতাওয়াল্লি বানানো হয়। কিন্তু সেই সময় থেকেই শুরু হয় ওয়াকফ সম্পত্তি নিজ নামে দখলের ষড়যন্ত্র। পরবর্তিতে গোলামপীরের তিন সন্তানের হাতে অর্থাৎ বাগবুল মঞ্জু, ইকবাল মঞ্জু ও কবির মঞ্জুর হাতে সেই ওয়াকফ সম্পত্তি আসলে তারা ধীরে ধীরে সেই সম্পত্তি বিক্রি করার প্রচেষ্টা চালায়। গ্রামবাসীরা বাঁধা দিলে থানা পুলিশ দেখিয়ে বারবার জেলে পুরার হুমকিও দেয়। এমতাবস্থায় ২০০৬ সালের শেষ দিকে বাগবুল মঞ্জু অবৈধ ভাবে সেই ওয়াকফ সম্পত্তির প্রায় ১৫ বিঘা বিক্রি করে দেয় এবং আরো ১০ বিঘা জমি বিক্রি করার প্রচেষ্টা চালায়। সেই গ্রামেরই আনোয়ার হোসেন ও ইউসুফ হোসেন বাধা দিলে তাদের নামে মিথ্যা কেস দিয়ে দুই মাস জেলে পাঠানো হয়। কিন্তু তাতেও দমে যাননি ওই দুই লড়াকু ব্যক্তি। টানা দুই মাস পর জেল থেকে বেরিয়ে আসার পর ২০০৭ সালে ওয়াকফ বোর্ডের দ্বারস্থ হন তাঁরা। কিন্তু কাজ না হওয়ায় শেষ পর্যন্ত ওই বছরেই হাইকোর্টে পিটিশন দায়ের করা হয়। পরপর চারবার পিটিশনে হাইকোর্ট ওয়াকফ বোর্ডকে ওই জমির ব্যাপারে দ্রুত হস্তক্ষেপের নির্দেশ দেয়। সেই মতো ওয়াকফ বোর্ড ২০০৮ সালের প্রথম দিকে মসজিদের সেই ওয়াকফ সম্পত্তি খতিয়ে দেখতে দল পাঠায় এবং বাগবুল মঞ্জুদেরকে মুতাওয়াল্লি থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। পরবর্তিতে আবার ওয়াকফ বোর্ড এর প্রতিনিধি দল এসে গ্রাম সরেজমিনে খতিয়ে দেখে গ্রামবাসীদের সাথে কথা বলে নতুন মুতাওয়াল্লি হিসাবে পাঁচ জনের কমিটি গঠন করেন। সেই মতো নতুন মুতাওয়াল্লি কমিটির সভাপতি নির্বাচিত হন আনোয়ার হোসেন এবং সেক্রেটারি হন ইউসুফ হোসেন। কিন্তু বাঁধা আসে মুতাওয়াল্লি হস্তান্তরের সময়। আগের মুতাওয়াল্লি তথা গোলাম পীরের ছেলে বাগবুল মঞ্জু এই সিদ্ধান্ত প্রথমে মেনে নিলেও ১১০ বিঘা সম্পত্তির লোভ থেকে সরে আসতে পারেনি। তাই বোর্ড থেকে বারবার জমি হস্তান্তরের কথা বলে বিএলআরও অফিসে ডাকলে এবং সেই বাগবুল মঞ্জুর কথা মতো বিএলআরও বারবার তারিখ পরিবর্তন করলেও শেষ পর্যন্ত হাজির হয়নি। এমতাবস্থায় দীর্ঘদিন অতিবাহিত হয়ে যাওয়ায় ওই ১১০ বিঘা সম্পত্তির নতুন মুতাওয়াল্লি আনোয়ার হোসেন ও ইউসুফ হোসেন বহরমপুরের এসডিও এবং মুর্শিদাবাদের ডিএমের দ্বারস্থ হন। তাঁরাও বিষয়টি খতিয়ে দেখে দ্রত সেই জমি এই পাঁচজনের নামে হস্তান্তররের কথা বলে বিএলআরওকে চিঠি দেন। কিন্তু বাগবুল মঞ্জুর চক্রান্তে সেই বিএলআরও সুনানীর তারিখ পরিবর্তন করতে থাকে। তাই বাধ্য হয়েই নতুন করে ফের ওয়াকফ বোর্ডের দ্বারস্থ হন নতুন মুতাওয়াল্লিরা। সেই মতো প্রাথমিক ভাবে ৪৫ বিঘা জমি উদ্ধারের পরামর্শ দেওয়া হয় তাদের। কিন্তু সেই জমি উদ্ধারের ক্ষেত্রেও বিএলআরও টালবাহানা করছেন বলে অভিযোগ। এদিকে, তলে তলে সেই ১১০ বিঘা জমি বিক্রি করার অপচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে বাগবুল।  ফলে সেই ১১০ বিঘা জমির ভবিষ্যত এখন অনিশ্চয়তার মুখে।

 

এবিষয়ে স্থানীয় বিএলআরও’র বক্তব্য, ওয়াকফ ট্রাইবুনাল থেকে যেভাবে আমাকে নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে সেই অনুযায়ী আমি কেস ডিসপোজ করে রেখেছি। ওই জমির বেশিরভাগ অংশটাই বাগবুলদের দখলে রয়েছে। ডিপার্টমেন্ট -এর দখল ছাড়া তো রেকর্ড হয় না, তাই ওই জমিটার ব্যাপারে ওয়াকফ বোর্ড কে চিঠি করে জানানো হয়েছে, পরবর্তিতে কি পদ্ধতিতে সেটা রেকর্ড হবে সেটা যেন আমাদের জানানো হয়।  আমরা অর্ডারসিপ দিয়ে রেখেছি। বেলডাঙা -২ ব্লকের বিডিও এস.আর.মালি বলেন, আমি এখানে নতুন এসেছি। খুব বেশি বিষয়টা জানা নেই। তবে ওখানে ওয়াকফ সম্পত্তি নিয়ে দুই পক্ষের  রেকর্ড নিয়ে একটা গন্ডগোল রয়েছে। পুরো জায়গাটা ওয়াকফের নামে দান করা থাকলেও সেটা মসজিদের কিছু অংশ ওয়াকফের নামে আছে এবং বাকি অংশ নিজেদের দখলে আছে। ওটা বোর্ডের নির্দেশ মতো গ্রামবাসীদের হাতে তুলে দেওয়ার কথা রয়েছে। বিএলআরও অফিসেই রেজিস্ট্রি সংক্রান্ত গন্ডগোল রয়েছে। ওটা ওরাই ভালো বলতে পারবেন।

 

অন্যদিকে, এই বিষয়ে রেজিনগর বিধারসভার বিধায়ক রবিউল আলম চৌধুরির বক্তব্য, সমস্যাটা দীর্ঘদিনের। ওয়াকফ বোর্ড নতুন কমিটি গঠন করে তাকে মুতাওয়াল্লি প্রদান করলেও পুরানো মোতায়াল্লিরা সেই জমি ছাড়তে চাইছে না। এটা নিয়েই টালবাহানা করছে। ওয়াকফ বোর্ড এর বক্তব্য, যারা মসজিদের সেই ওয়াকফ সম্পত্তি নিয়ে ছিনিমিনি খেলছে তাদের দায়িত্বে রাখা হয়নি, তাই নতুন মুতাওয়াল্লি করা হয়েছে। জেলার সংশ্লিষ্ট আধিকারিকদের বলেছি নতুন কমিটির নামে রেকর্ড করে দিতে। বিষয়টি অবহিত আছেন জেলার এমন অনেক বিশিষ্ট জনের অভিমত বিষয়টি জেলার ভূমি রাজস্ব দপ্তরের ওয়াকফ বোর্ডের নির্দেশকে অমান্য করা ছাড়া কিছু নয়। এর পিছনে শাসকদলের একাংশের হাত আছে।

Back To Top