মুসলিমদের বহু বিবাহঃ রটনা বনাম বাস্তব চিত্র

~~মোহাম্মদ সাদউদ্দিন

মুসলিমদের সম্পর্কে একটি অপপ্রচার রয়েছে যে বহু বিবাহ রয়েছে । এটির ফলে মুসলিমদের সংখ্যা হুড় হুড় করে বেড়ে যাচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গের মাটিতে এই অপপ্রচারটা এখন বেশি বেশি করে চাউর করছে হিন্দুত্ববাদী সংগঠন গুলি। এই সব হিন্দুত্ববাদী সংগঠনের কেউ কেউ ইসলাম ধর্মের পরিপূর্ণ রুপকার হজরত মহম্মদ (সাঃ) কে নিয়ে তার চরিত্রকে কলঙ্কিত করার চেষ্টা করে। জায়নাবাদী গোষ্ঠীর মিথ্যা মিথ্যা ইতিহাস পড়ে কোনও কোনও লেখক-লেখিকা নবীকেও কলঙ্কিত করেছেন। প্রথমেই যে কথাটি বলা দরকার , সেটি হল এটায় যে ,ইসলাম ধর্মে চারটি বিয়ে সরাসরি নয় , চারটি বিয়ের বিষয়টি অনুমোদন এবং শর্ত সাপেক্ষ । স্ত্রীর সন্তান ধারনের  অক্ষমতা, ভ্রষ্টাচার , কিংবা বনিবনা না হওয়ার ব্যাপার গুলি শর্তের মধ্যে পড়ে। তার পরও প্রাক ইসলামিক আরব সমাজে ৭০-৮০ টি করে বিয়ে হত । সেখানে তা কমাতে কমাতে চার-এ অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। বোঝা যায় যে , হজরত মহম্মদ (সাঃ) কত বড় দক্ষ সংগঠক, বিপ্লবী।

  শুধু ইসলাম ধর্মেই নয় , সব ধর্মের মানুষের মধ্যেই বহু বিবাহের প্রচলন রয়েছে। ভারতে কোঠর আইন থাকা সত্বেও হিন্দুদের বহু গামিতা কিংবা বহু বিবাহ কম নয়। ২০০৬ সালের ‘ন্যাশনাল ফ্যামিলি হেলথ সার্ভে’ রিপোর্ট অনুসারে বহুবিবাহের অনুপাত মুসলিমদের মধ্যে ২.৫ শতাংশ হিন্দুদের মধ্যে ১.৭ শতাংশ এবং খ্রিস্টানদের মধ্যে ২.১ শতাংশ (দ্রষ্টব্য ‘সত্যটা জানতে হবে, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি উদ্যোগ)।

আবার চারটি স্ত্রী থাকলে জনসংখ্যা বাড়বে , এই তত্বও সঠিক নয়। কারণ এক পুরুষের চারটি স্ত্রী থাকলে যে কটি সন্তান হবে, সেই চারটি মহিলা চার পুরুষের স্ত্রী হলেও সন্তানের সংখ্যা একই থাকবে। [দ্রস্তব্যঃ প্রাগুক,]।

বাংলার বা সীমান্তবর্তী এলাকায় মুসলিম সংখ্যা বৃদ্ধির অন্যতম কারণ মুসলিমদের বহু বিবাহ নয়। এর পিছনে রয়েছে দীর্ঘ দীর্ঘদিনের নানান ঐতিহাসিক কারন । আর সেই কারণ গুলির মধ্যে গুরুপ্তপূর্ণ হল নিম্নবিত্ত হিন্দুদের উপর ব্রাহ্মণ্যবাদীদের অত্যাচার।  বাংলার রাঢ় অঞ্চলের বিশেষ করে গঙ্গানদীর পশ্চিমতীরবর্তী জনপদ বীরভূম, মুর্শিদাবাদ, বর্ধমান, বাকুড়া -পুরুলিয়া , নদিয়া ও উত্তর ২৪ পরগণা ও হুগলীর একাংশে মুসলিমদের ব্যঙ্গ করে বলা হয় ‘নেড়ে’ । কেন বলা হয়? এর পিছনেও রয়েছে ঐতিহাসিক কারণ । বাংলার মাটিতে এক সময় বৌদ্ধদের  ব্যাপক প্রভাব ছিল। ব্রাহ্মণ্যবাদীরা মোটেই সহ্য করতে পারতো না। বৌদ্ধদের উপর ব্রাহ্মণ্যবাদীদের সীমাহীন অত্যাচার তাদেরকে ইসলামের পতাকার তলায় এসে মুক্তির পথ খুঁজে পায়। কিন্তু ব্রাহ্মণ্যবাদীদের অত্যাচার বা নির্যাতন থেকে রেহায় পাওয়ার জন্য ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করলেও তারা কিন্তু পূর্বধর্মের রীতিনীতি কে ভুলতে পারেনি। তাই তাদের মাথা আগের মতোই ন্যাড়া থাকত। তাই বৌদ্ধ থেকে ধর্মান্তরিত মুসলিমদের আজও ‘ন্যাড়ে’ বলা হয়। এটার ব্যাপক প্রচলন রাঢ় – বাংলায় বেশি। আরও উল্লেখ্য , ব্রাহ্মণ্যবাদীরা কিন্তু বৈষ্ণব ধর্মাবলম্বী মহাপ্রভু চৈতন্যদেবের উপর  কম অত্যাচার করেনি। মহাপ্রভুর চৈতন্যদেবের মৃত্যু কিন্তু আজও অন্তরালে থেকে গেল। বৈষ্ণবদের উপর ব্রাহ্মণ্যবাদীদের অত্যাচার কিন্তু কম নয়। তাই বাংলায় মুসলিমদের সংখ্যা বৃদ্ধির ঐতিহাসিক কারণটি হল ব্রাহ্মণ্যবাদীদের অন্যান্য নীচু জাতি হিন্দু ও  ধর্ম সম্প্রদায়ের  মানুষের উপর অত্যাচার ও নির্যাতন । আরও একটি কারন , বাংলায় সুফি সাধক ও পীর – ফকির- আউলিয়াদের প্রভাব। এদেরই সংস্পর্শে এসে অমুসলিমরা মুক্তির পথ খুঁজে পেয়েছে। আর আজকে বিজেপি সহ হিন্দুত্ববাদী সংগঠন গুলি ‘ঘরে ফেরানো’ -র কর্মসূচি নিচ্ছে স্রেফ ভোট ব্যাঙ্কের জন্য । বাংলার মাটিতে মুসলিমদের বহু বিবাহ ও অধিক সন্তানের হার কমে গিয়েছে। তবুও মুসলিমদের বহুবিবাহ নিয়ে হিন্দুত্ববাদী সংগঠন গুলির অপ্প্রচার অব্যাহত।

হিন্দুত্ববাদী সংগঠন গুলি রাজনৈতিক ফায়দা ও হিন্দু সেন্টিমেন্টকে আকর্ষণ করার জন্য আরও একটি তত্ব চাউর করছে। আর সেটি হল মুসলিম জনসংখ্যা এত দ্রুত  বাড়ছে যে শীঘ্রই হিন্দুরা সংখ্যালঘু হয়ে যাবে। বাস্তব কি সেকথায় বলছে? এপ্রসঙ্গে সাপ্রদায়িক সম্প্রীতি উদ্যোগ প্রকাশিত ‘সত্যটা জানতে হবে’ ( প্রকাশক রতন বসু মজুমদার ) পুস্তিকার বক্তব্য খুবই প্রনিধান যোগ্য বলে মনে করি। ঐ পুস্তিকায় দুই পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে ‘ ভারতের জনগণনার রিপোর্ট কিন্তু ঠিক উল্টো কথা বলছে। গত দুই দশক ধরে এদেশে মুসলিম জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার কমে চলেছে। ১৯৮১-৯১ দশকে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ছিল ৩২.৯ শতাংশ , ১৯৯১-২০০১ দশকে ২৯.৫২ শতাংশ , আর ২০০১- ২০১১ দশকে সেটা হয়েছে ২৪.৬০ শতাংশ । হিন্দু জনসংখ্যার বৃদ্ধির হার ২০০১ সালে ১৯.৯২ শতাংশ , ২০১১ সালে এটা হয়েছে ১৬.৭৬ শতাংশ । সুতরাং হিন্দুর থেকে বেশি হারে কমেছে মুসলিম জনসংখ্যা পশ্চিমবঙ্গে মুসলমান জনসংখ্যার কমতির হার আরও বেশি’। ঐ পুস্তিকারই দুই পৃষ্ঠায় আরও বলা হয়েছে যে, ‘অঙ্ক কষলে দেখা যাবে মুসলমানদের এখানকার বৃদ্ধির হার বজায় থাকলেও তাদের জনসংখ্যা ভারতের হিন্দু জনসংখ্যাকে ২২২০ সালের ছুঁতে পারবে না । কিন্তু তার কোন সম্ভবনা নেই। কারন যে হারে তাদের জনসংখ্যা কমে আসছে, তাতে তার অনেক আগেই জনসখ্যার দৌড়ে তারা পিছিয়ে পড়বে। ২০১১ সালের জনগণনার রিপোর্টে বলা হয়েছে, হিন্দু- মুসলিম এবং খ্রিষ্টানদের বৃদ্ধির হার ২০১১ -এর জনগণনায়  আরও কমবে বলে আসা করা য়ায়।………, । ‘ বিচারপতি রাজিন্দর সিং সাচারের সভাপতিত্বে ভারত সরকারের তৈরি এক কমিটির ২০০৬ সালে প্রকাশিত রিপোর্ট অনুযায়ী ২১০০ সালে এদেশে মুসলমানদের অনুপাত দাঁড়াবে মোট জনসংখ্যার ১৭ থেকে ২১ শতাংশের মধ্যে’। তাহলে নির্বিঘ্নে বলা যায়, পশ্চিমবঙ্গেও তার ব্যতিক্রম হবে না। এছাড়াও পশ্চিমবঙ্গে মুসলিম সম্প্রদায়ের শিক্ষার হার বৃদ্ধি পাচ্ছে। চেতনাও উন্নত হচ্ছে। নতুন প্রজন্মের মুসলিমরা এক- দুটির বেশি সন্তান নিচ্ছে না। তাই মুসলিম জনসংখ্যা বৃদ্ধি নিয়ে ভয়ের কোনও কারন নেই । অবিভক্ত  ভারত- পাকিস্তান – বাংলাদেশ নিয়ে মোট মুসলিম জনসংখ্যা ভারতে বসবাসকারী হিন্দু জনসংখ্যার চেয়ে । পরিবার পরিকল্পনায় বাংলাদেশ অনেকটা এগিয়ে । পাকিস্তানও এগিয়ে গেছে। আর ভারত- পাকিস্তান বাংলাদেশের মোট মুসলিম জনসংখ্যা ভারতে বসবাসকারী হিন্দু জনসংখ্যার চেয়ে অনেক কম। তারপরও হিন্দুত্ববাদীদের এত ভয় কেন?

Back To Top