গো রাজনীতি গোহারান হারবে…

~অশোক মজুমদার

গরু অতি নিরিহ প্রাণী। আমাদের চাষবাস থেকে পরিবহণ সবকিছুর সঙ্গেই তার নিবিড় যোগাযোগ। গ্রামীণ পরিবারে সে যেন বাড়িরই একজন। কালি, ধলী, মঙ্গলা এমন কত তার ডাকনাম। বিজেপির দুঃশাসন এমন একটা নিরীহ প্রাণীকে গোরক্ষার নামে দেশজোড়া সাম্প্রদায়িক উন্মাদনার সঙ্গে জুড়ে দিয়েছে। এ গরুর রঙ লাল, মাতা নয়, এ গরু যেন এক রক্তপিপাসু দানব। বাঁশিতে মধুর সুর তোলা রাখাল নয়, তাকে পাহারা দেয় ত্রিশূল, বল্লম, বন্দুকধারী মাথায় গেরুয়া ফেট্টি বাঁধা গুন্ডারা। এমন গোরক্ষকদের আমরা বাঙালিরা তো বটেই, গোটা দেশের লোক দেখেনি। গোটা দেশবাসীর চোখের সামনে একটু একটু করে এই আজব প্রাণী ও তার হিংস্র রক্ষকদের তৈরি করেছেন মোদী-শাহ অ্যান্ড কোং। গোহত্যার গুজবের জেরে উত্তরপ্রদেশের বুলন্দশহরের সিওয়ানে কর্তব্য সচেতন ও অসাম্প্রদায়িক পুলিশ অফিসার সুবোধ সিং এর মৃত্যু বিজেপির ধর্মের নামে দেশকে ভাগ করার ঘৃণ্য রাজনীতিকে আবার সামনে নিয়ে এল।

রাজনীতি, অর্থনীতি, সুশাসন, উন্নয়ন সবকিছুতে ব্যর্থ এই দলটির এছাড়া আর কোন উপায়ও নেই। গোরক্ষার নামে মানুষ ক্ষেপিয়ে দাঙ্গা বাঁধানো এখন তাদের ক্ষমতায় টিঁকে থাকার শেষ অস্ত্র। অবশ্য তাদের এ ভাবনাটাও ভুল, কারণ, যতদিন যাচ্ছে মানুষ তাদের এই খেলাটা বুঝে ফেলছেন। মজার ব্যাপার হল, হিন্দু ধর্মের কোথাও গোরক্ষার এই হিংস্র উপায়ের কথা লেখা নেই। গোমাতার যারা পুজো করেন সেই নিষ্ঠাবান হিন্দুরাও গোরক্ষার নামে কিছু গুন্ডার এই যুক্তিহীন সন্ত্রাসের বিরোধী। এমন অতিসাম্প্রদায়িকতার রাজনীতি অটল-আদবানির বিজেপিও কোনদিন দেখেনি। মোদী-শাহদের বিজেপি সত্যি অন্যরকম। কর্পোরেটদের সঙ্গে মিলে দেশ লুণ্ঠন; মুষ্টিমেয় কিছু ধনী পরিবারের সুবিধা করে দেওয়া; দেশের সম্পদ লুটেরাদের দেশ থেকে পালানোর সুযোগ করে দেওয়া; ডিমনিটাইজেশনের নামে দেশের মানুষদের নিঃস্ব করে দেওয়া এমন বিজেপিকে আমরা এর আগে দেখিনি।

ভোট যত এগিয়ে আসছে ততই উন্মোচিত হচ্ছে তাদের একের পর এক নানা অপকর্মের বৃতান্ত। যত আঁটঘাট বেঁধে তারা কাজে নামুক না কেন প্রতিটি অপকর্মই মানুষের কাছে ধরা পড়ে যাচ্ছে। যেমন ইতিমধ্যেই প্রশ্ন উঠে গেছে বুলন্দশহরে খুন হওয়া সুবোধ সিং এর মৃত্যু নিয়েও। এই প্রশ্ন তুলেছেন তার বাড়ির লোকেরা। তাদের মতে, ২০১৫সালে বাড়িতে গোমাংস রাখার মিথ্যা অভিযোগে গণপিটুনিতে মৃত মহম্মদ আখলাকের মৃত্যুর তদন্ত করতে গিয়ে সত্য ঘটনাটা জেনে ফেলার অপরাধে তাকে মরতে হল। বলে রাখা ভাল, তদন্তে জানা গেছে আখলাকের ফ্রিজে কোন গোমাংস ছিল না, ছিল মাটন।

সুবোধের মৃত্যু যেন বলিউডের ক্রাইম থ্রিলারের গল্প। মিথ্যা অভিযোগে ধর্মীয় উন্মাদনা সৃষ্টি করে একজনকে মারা হল। আবার তদন্তকারী পুলিশ অফিসার সেই সত্যটা জেনে ফেলার পর তাকে খুন করতে ব্যবহার করা হল সেই উন্মাদনাই। এমনভাবে ব্যাপারটা সাজানো হয়েছে যে সুবোধ যেন একদল উন্মত্ত জনতার গণহিংসার শিকার হয়েছেন। প্রথমে রটানো হয়েছিল সুবোধের মৃত্যু হয়েছে উন্মত্ত জনতার গণপিটুনিতে। তার যে বুলেটে মৃত্যু হয়েছে সে কথা তখনও সামনে আসেনি। এখন আবার বলা হচ্ছে পুলিশের অনিচ্ছাকৃত গুলিতে তার মৃত্যু হয়েছে। আক্রমণকারীরা বুঝতে পেরেছিল এই পুলিশ অফিসার ধর্মের নামে মানুষের বিভাজন মানেন না তাই তাকে সরিয়ে দেওয়া ছাড়া আর কোন পথ নেই। এটাও বোঝা কঠিন, গোরক্ষকদের হাতে লাঠিসোটা থাকতে পারে, গোমাতার অবমাননা হয়েছে ভেবে তারা ক্ষিপ্ত হয়ে তাণ্ডবও চালাতে পারেন কিন্তু পাকা ক্রিমিনালদের মত পুলিশের বুকে গুলি করার সাহস তাদের এল কোথা থেকে? সেই আগ্নেয়াস্ত্রই বা তাদের কে দিল?

যোগী আদিত্যনাথের আমলে উত্তরপ্রদেশ সত্যি অগ্নিগর্ভ। ২০১৭সালে তিনি ক্ষমতায় আসার পর থেকেই চলছে গোরক্ষার নামে বিজেপির ঠ্যাঙাড়ে বাহিনীর তাণ্ডব। এবছরই উত্তরপ্রদেশের উন্মত্ত গোরক্ষকদের হিংসার বলি হয়েছেন ৪জন। গত বছর গোরক্ষকদের উস্কানিতে ঘটেছে ১১টি হিংসাত্মক ঘটনা। প্রতিটি ঘটনাতে গোরক্ষার নামে হিন্দুত্বের ধ্বজাধারীরা ঝাঁপিয়ে পড়েছে অন্য ধর্মের মানুষদের ওপর। কোথাও গেছে প্রাণ, কোথাও আহত হয়েছেন মানুষ আবার কোথাও বা ধ্বংস হয়েছে তাদের সম্পত্তি। অভিযুক্তদের অনেকেই বিজেপি সমর্থক, কেউবা বজরং দল বা বিজেপির অন্য কোন শাখা সংগঠনের সদস্য। নিজেদের বিরোধীদের দেশ থেকে তাড়াতে যে কোন উপায় বা ব্যবস্থা নেওয়ার ব্যাপারে তাদের কোন আপত্তি নেই। প্রশ্ন উঠেছে বুলন্দশহরের ঘটনাটিকে নিয়ে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর আচরণেও। তিনি এখনও ঘটনাস্থলে যান নি, সেসময় তিনি দেখেছেন কাবাডি ম্যাচ এবং লাইট অ্যান্ড সাউন্ড শো।

আখলাক হত্যাকান্ড মামলা বানচাল করে দেওয়া এবং সুবোধের মৃত্যুর কারণটিকে অস্পষ্ট করে দেওয়াই এর মূল উদ্দেশ্য। রাষ্ট্রীয় প্রশ্রয়ে এমন ঘটনা লাগাতার ঘটতে থাকলে সত্যি সাধারণ মানুষদের আর কোন যাওয়ার জায়গা থাকেনা। সুবোধকে খুন করে বিরোধীদের একটা হুঁশিয়ারি দিতে চেয়েছিলেন গোরক্ষকরা। কিন্তু মৃতের শরীরে পাওয়া পুলিশের বুলেট তাদের সে হিসেব গণ্ডগোল করে দিয়েছে। গরুর রাজনীতি করতে করতে মানুষকেই গরু ভাবতে শুরু করে দিয়েছেন মোদীরা। তারা ভাবছেন দেশের মানুষ তাদের ওপর চালাকিটা বুঝবেন না। কিন্তু মানুষ তাদের নিজেদের জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে গোরক্ষকদের সাইনবোর্ডের আড়ালে বিজেপির চালাকিটা ধরে ফেলেছেন।

মোদী-শাহরা বুঝতেই পারছেন না তাদের এই গো রাজনীতির কী প্রতিক্রিয়া হচ্ছে সাধারণ মানুষদের মধ্যে। আমার মার কথাই বলি, তিনি কোন রাজনীতির লোক নন। আমাকে সেদিন মা হঠাৎ বললো, গরু নিয়ে কী সব গণ্ডগোল হচ্ছে বল তো? শুনছি তা নিয়েও লোকে মারামারি করছে? একটা পোষা উপকারি প্রাণীকে নিয়ে এত হৈ চৈ কীসের? এর মধ্যেও রাজনীতি? মানুষের এই প্রতিক্রিয়াটাই বিজেপির থিঙ্ক ট্যাঙ্করা বুঝতে পারছেন না। বুঝতে পারবেন বাংলা দিয়ে বিজেপির রথযাত্রার সময়। বাংলার মানুষের বোধবুদ্ধি ও কাণ্ডজ্ঞান তাদের রথ ও গরু নিয়ে ঘৃণ্য রাজনীতি রুখে দেবে।

আগেকার দিনে রাজারা সাম্রাজ্য বিস্তারের জন্য অশ্বমেধ যজ্ঞ করে একটা ঘোড়া ছেড়ে দিতেন। সেই ঘোড়া অপ্রতিহত গতিতে যতদূর যেতে পারতো ততদূর বিস্তৃত হত তাদের সাম্রাজ্য। কোন জায়গায় ঘোড়া আটকালে রাজারা যে আটকেছে তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করতেন। রাজাদের আমল আজ আর নেই, মহারাজ মোদী ঘোড়ার বদলে ছেড়ে দিয়েছেন গরু। সৈন্যের বদলে সেই গরুর সঙ্গে আছে গোরক্ষক নামধারী গুন্ডারা। বিজেপির আমলে অশ্বমেধ নয়, হচ্ছে নরমেধ যজ্ঞ। এই নরমেধ যজ্ঞের বলি হচ্ছেন সুবোধ সিং এর মত সৎ পুলিশ অফিসাররা। দেখেশুনে ঠেকে শেখা মানুষ আগামী নির্বাচনে বিজেপিকে গোহারান হারিয়েই মানুষকে গরু ছাগল ভেবে নেওয়ার এই রাজনীতির জবাব দেবেন।

Back To Top