কেন আগামীকাল “সংবিধান বাঁচাও” আন্দোলনের ডাক দেওয়া হয়েছে কোলকাতার ধর্মতলায়? জানুন —-:

মনুবাদীদের হাত থেকে ভারতের সংবিধানকে বাঁচাতে আগামীকাল 6/12/18 তারিখ “সংবিধান বাঁচাও সমিতির” আহ্বানে কোলকাতার ধর্মতলায় এক মহাসমাবেশের ডাক দেওয়া হয়েছে। দেশ ও রাজ্যের বর্তমান পরিস্থিতিতে দলিত-মূলনিবাসী-বহুজন সমাজের কাছে এই আন্দোলন এক জীবন-মরনের লড়াই, অস্তিত্ব রক্ষার চূড়ান্ত লড়াই। তাই পশ্চিমবঙ্গের প্রায় সমস্ত মূলনিবাসী-বহুজন সংগঠন গুলির মিলিত প্রয়াসে এই মহাসমাবেশের আয়োজন করা হয়েছে। কেন এই সমাবেশের ডাক দেওয়া হলো তা সংক্ষেপে তুলে ধরা হলো —

বাবা সাহেব ডঃ বি. আর. আম্বেদকর মূলনিবাসী বহুজন সমাজের ধর্মীয়, সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ইত্যাদির কথা ভেবে সংবিধানের 15 নং, 16 নং, 17 নং, 19 নং, 23 নং, 46 নং, 47 নং, 244 নং, 330 নং, 332 নং, 334 নং, 335 নং, 338 নং, 340 নং, 341 নং ও 342 নং ধারার সৃষ্টি করেছিলেন। কিন্তু দেখা গিয়েছে যে, সংবিধানে দলিত-বহুজন মানুষের জন্য এই সকল সুযোগ-সুবিধা লিপিবদ্ধ থাকলেও বর্ণবাদী শাসক গোষ্ঠী গুলি তার ছিটেফোটা মাত্র কার্যকর করেছে।তথাপি সংবিধানের এই ছিটেফোটা সুযোগ-সুবিধাটুকু পেয়ে স্বাধীনতার 72 বছরে মূলনিবাসী-বহুজন সমাজ কিছুটা হলেও ঘুরে দাঁড়িয়েছেন। এই সংবিধান হলো তাদের একমাত্র রক্ষাকবচ। এই সংবিধানকে সামনে রেখে আজ সারা ভারতবর্ষের দলিতরা সংঘবদ্ধ হতে শুরু করেছেন, অত্যাচারের প্রতিবাদে রাজপথে নেমে আন্দোলনে ঝড় তুলেছেন। আর এই সব কারন গুলির জন্য বর্ণবাদীরা আজ চূড়ান্ত সতর্ক হয়ে, সজাক দৃষ্টিতে দলিত অধিকারকে ও দলিত আন্দোলনকে সর্বোপরি দলিত ঐক্যকে ভেঙ্গে তছনছ করতে নতুন ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছে। ব্রাহ্মন্যবাদীরা হিসেব করে দেখেছে যে, ডঃ আম্বেদকরের রচিত সংবিধানই হলো দলিত-বহুজনের উত্থানের একমাত্র চাবিকাঠি। তাই যে করেই হোক সংবিধানকে ধ্বংস করতেই হবে। ডঃ বি. আর. আম্বেদকরের মৃত্যুর পর থেকেই এদেশের বর্ণবাদী শাসক গোষ্ঠী সংবিধান থেকে দলিত বহুজনদের অধিকার গুলি ধীরে ধীরে খর্ব করতে শুরু করেছে। তারপরেও যতটুকু বাকী আছে এবার সেটুকুও সমূলে বিনষ্ট করতে গোটা সংবিধানকে ধ্বংস করতে উঠে পড়ে লেগেছে। তাই কট্টর হিন্দুত্ববাদী সংগঠন গুলি সারা দেশ জুড়ে সংবিধান পোড়াচ্ছে এবং মনুসংহিতাকে তাদের সংবিধান বানানোর জন্য উঠে পড়ে লেগেছে। ফলে এবার প্রতিবাদের পালা।আন্দোলনে রাস্তায় না নামলে সংবিধানের সঙ্গে সঙ্গে এদেশের দলিত মূলনিবাসী বহুজন সমাজও ধ্বংস হয়ে যাবে।ব্রাহ্মন্যবাদী শাসক গোষ্ঠী দলিত-বহুজনের যেসকল অধিকার গুলি থেকে বঞ্চিত করে রেখেছে বা ধ্বংস করেছে এবং তাদের প্রতি নির্যাতন ও অত্যাচার করছে নিন্মে অতি সংক্ষেপে তার মাত্র কয়েকটি তুলে ধরা হলো —

(1) স্বাধীনতার 72 বছরে SC/ST/OBC-দের চাকুরির ক্ষেত্রে সংরক্ষণ কোটার অর্ধেক পদও (42%) পূরণ করা হয়নি (12/7/16 সালের অনগ্রসর শ্রেনী কল্যান মন্ত্রকের রিপোর্ট)
(2) স্বাধীনতার 72 বছরে SC/ST/OBC ছাত্র- ছাত্রীদের স্টাইপেন্ডের মাত্র 19% টাকা সরকার ব্যয় করেছেন ( SC/ST ন্যাশনাল কমিশনের রিপোর্ট –2015)।
(3) SC/ST/OBC কার্ড পেতে চলছে চরম হয়রানি ও দুর্নীতি।
(4) ইতিমধ্যে দেশের 64% সরকারি ( রাজ্য-কেন্দ্র) সংস্থা গুলিকে বেসরকারীকরন করে দিয়ে (3/12/17- নিয়োগ যোজনা কমিশনের রিপোর্ট) SC/ST/OBC- দের সংরক্ষণ কোটাকে সুকৌশলে তুলে দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে।কারন বেসরকারি সংস্থায় সংরক্ষণ নেই — সেখানে টাকা এবং মামা-কাকার সুপারিশই আসল, যা বর্ণবাদীদের আছে।
(5) সারা দেশ জুড়ে উচ্চবর্ণের দ্বারা চলছে দলিত-বহুজন হত্যা-খুন-ধর্ষন। শুধু 2017 সালে ভারতে 41713 জন দলিত হত্যা ও দলিত নারী ধর্ষিতা হন ( সেন্ট্রাল ক্রাইম ব্যুরোর রিপোর্ট 3/2/ 18)।
(6) একদিকে যেমন দলিতদের উপর নির্মম খুন ধর্ষন চলছে, তার উপর আবার দলিতরক্ষা আইন “Actrocities Act”-কে প্রায় তুলে দেওয়া হয়েছে। ফলে এরপর দলিতদের কুকুর বিড়ালের মতো হত্যা করতে আর কোনো বাধা রইলো না।
(7) গৌরী লঙ্কেশ, দাভোলকর, কালবুর্গি, পানেসর, ইত্যাদি প্রতিবাদী লেখক লেখিকাদের একের পর খুন করে প্রতিবাদী মুখ বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে।
(8) পাঁচ দলিত লেখক ও মানবাধিকার কর্মী ভারভারা রাও, অরুন ফেরেউনা, ভার্নন গনজাল ভেস, সুধী ভরদ্বাজ এবং গৌতম নওলখাবকে অন্যায় ভাবে দীর্ঘকাল ধরে গ্রেপ্তার করে রেখেছে মনুবাদী সরকার। সুপ্রিম কোর্টের ভৎসনা স্বত্তেও তাঁদের ছাড়ছে না।তার একটাই কারন তাঁরা সকলে দলিতদের প্রতি বর্ণবাদীদের অন্যায় অত্যাচারের প্রতিবাদে শক্ত হাতে কলম ধরেছিলেন।
(9) গো-রক্ষার নামে সারাদেশ জুড়ে নির্মম ভাবে মানুষকে পিটিয়ে মারা হচ্ছে। অথচ এখনো পর্যন্ত তার মাত্র একটা বিচারও হয়নি। সরকারি মদতে চলছে এই হত্যা লীলা।
(10) বিগত দুবছরে উচ্চবর্ণের সঙ্গে দলিতদের সবচেয়ে বড় দুটি দাঙ্গা ঘটে গেল। প্রথমতঃ উত্তর প্রদেশের সাহারানপুরে দলিত ও ঠাকুরদের মধ্যে দাঙ্গা। দ্বিতীয়তঃ মহারাষ্ট্রের ভীমকোরেগাওয়ে দলিত ও উচ্চবর্ণের দাঙ্গা। এই দুটি দাঙ্গায় সরকারি মদতে কয়েকশ দলিতকে খুন ও দলিত নারীকে ধর্ষন করা হয়েছে। অথচ বর্ণবাদী মিডিয়া নীরব।
(11) সব বর্ণবাদী দলগুলি মিলিত হয়ে 2003 সালে “নাগরিকত্ব আইন” পাশ করিয়ে কয়েককোটি মানুষকে বেনাগরিক করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছে — যার 99% দলিত বহুজন।
এই সব কারন গুলির জন্য সংবিধানকে বাঁচাতে সারা দেশ জুড়ে চলছে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ। এই রাজ্যেও আন্দোলন শুরু হয়ে গিয়েছে।তাই আগামীকাল 6-ই ডিসেম্বর বাবাসাহেবের মৃত্যু দিবস উপলক্ষে কোলকাতার ধর্মতলায় এই আন্দোলনে দলে দলে যোগদান করে “সংবিধান বাঁচান, নিজেকে বাঁচান”। জয় ভীম, জয় ভারত।

Back To Top