ভাষা দিবসে প্রাসঙ্গিক ভাবনা

~তায়েদুল ইসলাম

এখন রাত দশটা। আর দু ঘন্টা পর শুরু হবে মহান একুশে ফেব্রুয়ারি। ইংরেজি ক্যালেন্ডার অনুযায়ী রাত বারোটায় শুরু হয় নতুন তারিখ। কালের নিয়মে আমাদের জীবনে ফিরে এলো আরো একটি মহান একুশে ফেব্রুয়ারি। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। আর পাঁচটি আন্তর্জাতিক দিবসের মত অনেক কথা, আলোচনা, অনুষ্ঠান হবে। বড় বড় কথা হবে। কিন্তু আর পাঁচটা দিবসের মতই তার শিক্ষা আমরা সারা বছর অনুশীলন করি কত জন? আমাদের রাজনীতি, শিক্ষা -সংস্কৃতি নীতি, ভাষা নীতি নির্ধারণে মাতৃভাষা দিবসের প্রভাব থাকে কতটুকু? এই বিষয়ে ভাবনা চিন্তা করার আগে একটু দেখে নেওয়া যাক ভাষা আন্দোলনের আদি কথা।
১৯৫২ সালে পাকিস্তানের একটি প্রদেশ পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকার রাজপথে ছাত্ররা মিছিল বের করেন একমাত্র উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার বিরুদ্ধে। পুলিশ সেই মিছিলের ওপর গুলি চালায়। গুলিতে শহীদ হন কয়েক জন ছাত্র।
স্বাধীন ভারতের রাষ্ট্রভাষা কী হবে তা নিয়ে বিতর্ক দেখা দিয়েছিল বৃটিশ ভারতেই। তখন অমুসলিমরা সাধারণ ভাবে বলেছিলেন হিন্দিকে রাষ্ট্রভাষা করার কথা। আর মুসলিমরা বলেছিলেন উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার কথা। রাষ্ট্রভাষার বিষয়টি দাঁড়িয়েছিল হিন্দি উর্দুর দ্বন্দ্ব। ১৯৩৮ সালের ১ অক্টোবর All India Muslim Educational Conference এর সভাপতির ভাষণে একে ফজলুল হক দাবি করেন হিন্দিকে নয় , উর্দুকে করতে হবে ভারতের সাধারণ ভাষা ( lingua franca)। ১৯৪০ সালে নাগপুরে অনুষ্ঠিত হিন্দি সাহিত্য সম্মেলনে মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী বলেন মুসলিম রাজা বাদশাহরা উর্দু ভাষার উন্নয়ন করেছেন। যদি মুসলিমরা উর্দু ভাষার উন্নতি চান তা হলে সে দায়িত্ব নিতে হবে মুসলিম সমাজকে। স্বাধীন ভারত রাষ্ট্রকে নয়।
বৃটিশ ভারতে মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষার সূচনা করেছি বৃটিশরাই। ১৮৫৭ সালে প্রতিষ্ঠা করা হয় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়। ১৯১৭ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় গঠন করে স্যাডলার কমিশন। এই কমিশনের চেয়ারম্যান ছিলেন ডঃ এম ই স্যাডলার ( Dr M.E.Sadler) । তিনি ছিলেন বৃটেনের লিডস বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ব্যবস্থার কী ভাবে উন্নয়ন করা যায় তার সুপারিশ করার জন্য গঠন করা হয়েছিল স্যাডলার কমিশন। কমিশন সুপারিশ করে বিদ্যালয়ে মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষা দিতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয় এই সুপারিশ গ্ৰহন করে এবং বিদ্যালয়ে বাংলা ভাষার মাধ্যমে শিক্ষা চালু করে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ১৯৪০ সালে প্রথম বাংলা ভাষার মাধ্যমে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষা গ্ৰহন করে। অর্থাৎ ভারত রাষ্ট্র দু ভাগ হওয়ার আগেই বৃটিশ ভারতের বাংলা প্রদেশে বাংলা ভাষা ছিল বিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষার মাধ্যম। পরবর্তী সময়ে এটাই হয়ে উঠেছিল রাষ্ট্রভাষা বাংলা আন্দোলনের অন্যতম চালিকা শক্তি।
অবিভক্ত পাকিস্তানে এক বার কথা উঠেছিল বাংলাকে লেখা হোক রোমান অক্ষরে। যুক্তি ছিল এর ফলে সমগ্ৰ পাকিস্তানের অবাঙালিদের সুবিধা হবে বাংলা ভাষা শিখতে। এর বিরুদ্ধে বাংলাভাষীরা তুলেছিলেন প্রবল প্রতিবাদ। এটাকে তাঁরা দেখেছিলেন বাংলা ভাষাকে ধ্বংস করার একটি ষড়যন্ত্র হিসেবে। এই তুমুল প্রতিবাদ ছিল পরবর্তীতে রাষ্ট্রভাষা বাংলা আন্দোলনের অন্যতম উপাদান। এর অনেক আগে সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায় অভিমত দিয়েছিলেন রোমান অক্ষরে বাংলা ভাষাকে লিখলে সারা ভারতের মানুষের পক্ষে তা শেখা সহজ হবে। তাঁর সে অভিমতকেও ভারতীয় বাংলাভাষীরা মেনে নেননি।
বৃটিশ ভারতে মাতৃভাষা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার আলোচনা শুরু হয় অনেক আগে। মূলত তা ছিল মাতৃভাষা বাংলার মাধ্যমে শিক্ষা, সাহিত্য সংস্কৃতি চর্চার পক্ষে লেখনী যুদ্ধ। কিন্তু মাতৃভাষা বাংলার জন্য সংগঠিত আন্দোলন শুরু করে তমুদ্দুন মজলিস নামে একটি সংগঠন। সংগঠনটি তৈরি হয় ১৯৪৭ সালের ১ লা সেপ্টেম্বর। বাংলা ভাষা আন্দোলন শুরু হয় ১৯৪৮ সালে। চূড়ান্ত রুপ নেয় ১৯৫২ সালে। ১৯৪৮ পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান পূর্ব পাকিস্তান সফরে আসেন। ২৭ নভেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জিমনেসিয়াম মাঠে এক বিশাল ছাত্রসমাবেশে ভাষণ দেন। ঐ সভায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক গোলাম আযম বাংলা ভাষার দাবিতে দাবিপত্র প্রদান করেন প্রধানমন্ত্রীকে। কাজটি সে সময় ছিল খুবই সাহসিকতার। তিনি ১৯৪৮–১৯৪৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। ১৯৫২ সালে তিনি ছিলেন রংপুর কারমাইকেল কলেজের অধ্যাপক। রংপুরে ভাষা আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়ার কারণে তাঁকে গ্ৰেপ্তার হতে হয়। তারও আগে ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ ঢাকাতে ভাষা আন্দোলনে পিকেটিং করার সময় তিনি গ্ৰেপ্তার হয়েছিলেন।
অনেকেই বলে থাকেন মাতৃভাষা আন্দোলন ছিল পরবর্তীকালে স্বাধীন বাংলাদেশ গঠনের প্রথম পদক্ষেপ। কিন্তু এটি সঠিক নয়। তমুদ্দুন মজলিস এর সদস্যরা চেয়েছিলেন পাকিস্তান রাষ্ট্রের মধ্যে বাংলা ভাষাভাষী মানুষদের আত্মমর্যাদা প্রতিষ্ঠা। সমস্ত স্তরে মাতৃভাষা বাংলার মাধ্যমে শিক্ষার সরকারী ব্যবস্থা। কেন্দ্রিয় সরকারের চাকরির প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় বাংলায় পরীক্ষা দেওয়ার ব্যবস্থা। পরে রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নে সুস্পষ্ট দাবি ছিল উর্দুর পাশাপাশি বাংলাকেও রাষ্ট্রভাষা করতে হবে। তাঁরা উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার বিরোধী ছিলেন না। কিন্তু কেন্দ্রিয় শাসকরা চেয়েছিলেন শুধুমাত্র উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করতে। তবে এটা ঠিক বাংলা ভাষীদের যে চেতনা বোধ বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানাতে চালিত করেছিল সেই চেতনা বোধই পরবর্তীতে কেন্দ্রিয় সরকারের শোষণ ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে চালিত করেছিল। সেই আন্দোলনই ক্রমশঃ স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে রুপান্তরিত হয়।
১৯৬১ সালে ১৯ মে আসামের শিলচরে মাতৃভাষা বাংলা ভাষার দাবিতে আন্দোলনকারীদের ওপর পুলিশ গুলি চালিয়ে এগারো জনকে শহীদ করে।
আমরা এপার বাংলার বাঙালিরা আগে ২১ ফেব্রুয়ারি বা ১৯ মে যথাযথ গুরুত্ব দিয়ে ব্যপক হারে পালন করিনি। কিছুটা শহর কেন্দ্রিক আলাপ আলোচনা, লেখালেখির মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। এ প্রবণতা ক্রমশঃ ভাঙছে। আলোচনা, লেখালেখি, বিভিন্ন ধরনের কর্মসূচি ক্রমশঃ গ্ৰাম বাংলায় ছড়াচ্ছে। ধারে ভারে সংখ্যায় উদ্দীপনায়। তা স্বত্বেও দেখা যাচ্ছে ২১ ফেব্রুয়ারি যে গুরুত্ব পাচ্ছে ১৯ মে সে গুরুত্ব পাচ্ছে না। নির্দিষ্ট দিনে অনুষ্ঠানের মধ্যে মাতৃভাষার প্রতি যে ভালবাসা মমত্ববোধ দেখাচ্ছি ব্যক্তি, পরিবার এবং সমাজ জীবনে তা দেখাচ্ছি না। বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে হিন্দি আগ্ৰাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন করার কথা ভাবছি না। এমনকি হিন্দি আগ্ৰাসনের বিরুদ্ধে দক্ষিণ ভারত যে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারছে আমরা বাঙালিরা সে টুকুও চেষ্টা করছি না। এ দুর্বলতা বা স্ববিরোধিতার কারণ আমাদের খুঁজে বের করতে হবে। তাই না হলে মায়ের ভাষার প্রতি সম্মান প্রদর্শন লোক দেখানো হয়ে যাবে। রফিক, সালাম, জাব্বার,বরকতদের আত্মার প্রতি অসম্মান করা হবে। হিতেশ। বিশ্বাস,সুকমোল পুরকায়স্থ,বীরেন্দ্র সূত্রধররা আমাদের আন্তরিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back To Top