বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে বলা হয় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম গ্রাজুয়েট। কিন্তু বঙ্কিমদের ব্যাচে ছাত্র সংখ্যা কতজন ছিলেন এ নিয়ে বিতর্ক বিস্তর। কেউ বলেন ৭, কেউ বলেন ১২, আবার কেউ বলেন ১৭। সংখ্যাটা যাই হোক না কেন, ওই ব্যাচের কোন ছাত্রই পরীক্ষায় গ্রাজুয়েট বা স্নাতক হিসাবে কৃতকার্য হতে পারেন নি। শেষ পর্যন্ত বঙ্কিমকে ৭ নম্বর বাড়তি নম্বর (গ্রেস নম্বর) দিয়ে গ্রাজুয়েট করা হয়েছিল। আর বঙ্কিমের ওই ব্যাচে একজন মুসলিম ছাত্র পড়তেন। আমরা কি জানি তার নাম? হ্যা তারই নাম আব্দুল জব্বার। বর্ধমানের মঙ্গলকোট থানার বিখ্যাত কাশিয়াড়া (বর্তমান নাম কাসেমনগর) গ্রামের সন্তান তিনি। বাবার নাম খান বাহাদুর গোলাম আসগর। জব্বারের জন্ম হয়েছিল বর্ধমান শহরের কাছে পারহাটা গ্রামে মামার বাড়িতে। ১৮৩৭ সালে তিনি জন্মগ্রহন করে। জব্বারের বাবা গোলাম আসগর তাকে ব্রিটিশ আমলেই ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত করেন। গোলাম আসগর ব্রিটিশ আমলেই বিচার বিভাগের ‘সদরে আলা’ পদে চাকুরি করতেন। জব্বার পারিবারিকসূত্রেই ভালো ইংরেজি জানতেন। বঙ্কিমের সঙ্গে পড়ার সময় ১৮৫৯ সালে বি.এ. ফাইনাল পরীক্ষা দেওয়ার আগেই ব্রিটিশ সরকার তাকে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটের চাকরী দেন। আর তখন থেকেও জব্বার ব্রিটিশ সরকারের নানান উচ্চপদ অলংকৃত করেন। ১৮৮৯-১৮৯৪ সাল পর্যন্ত প্রেসিডেন্সীর ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন। বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক পরিষদের মোট তিনবার সদস্য মনোনীত হন (১৮৮৪, ১৮৮৬ ও ১৮৯৩)। চাকুরি থেকে অবসর গ্রহণের পর ১৮৯৭ থেকে ১৯০২ সাল পর্যন্ত ছিলেন ভোপালের প্রধানমন্ত্রী হন। বাংলার মুসলিম নবজাগরণের অন্যতম অগ্রদূত নবাব আব্দুল লতিফের সঙ্গে নবাব আব্দুল জব্বারের খুব ভাল সম্পর্ক ছিল। নবাব আব্দুল লতিফের মতোই নবাব আব্দুল জব্বারও ছিলেন বাংলার নবজাগরণের অন্যতম প্রাণপুরুষ। মুসলিম সমাজকে আধুনিক ও বিজ্ঞান সম্মত শিক্ষায় এগিয়ে যেতে হবে, -নবাব আব্দুল জব্বার এটাই উপলব্ধি করেন। বিংশ শতাব্দীর প্রথমদিকে দক্ষিণ আফ্রিকার শ্বেতাঙ্গ সরকার যখন সেখানকার প্রবাসী ভারতীয়দের উপর অত্যাচার ও নির্যাতন চালায়, ভোপালের প্রধানমন্ত্রী হিসাবে আব্দুল জব্বার তার তীব্র প্রতিবাদ করেন। চাকুরিতে নিষ্ঠা ও ঠিকঠাক কর্তব্য পালনের জন্য ব্রিটিশ সরকার তাকে ‘খান বাহাদুর’ নবাব’ ও ‘সিআইই’ উপাধিও প্রদান করে ১৮৯৫ সালে। প্রখ্যাত সাংবাদিক, ‘দি মুসলমান’ (ইংরেজি) পত্রিকার সম্পাদক ও জাতীয় কংগ্রেসের নেতা মওলানা আব্দুল কাসেম (মুসলিম লীগের অবিসংবাদিত নেতা আবুল হাসেমের বাবা) তার ভাইপো ও জামাতা। বাংলাদেশের প্রখ্যাত লেখক বদরুদ্দিন ওমর, পশ্চিমবঙ্গের প্রাক্তন মন্ত্রী প্রয়াত মহবুব হাহেদী, সৈয়দ মানসুর হাবিবুল্লাহ, সৈয়দ সাহেদুল্লাহ, বাংলাদেশের চিত্র পরিচালক সৈয়দ হাসান ঈমাম ও লায়লা হাসান প্রমুখ নবাব আব্দুল জব্বারের আত্মিয়। ঢাকা মাদ্রাসার সুপার আব্দুল মোমিন তার ভাই। অন্য আরেক ভাই-এর আব্দুল মাজিদ। নবাব আব্দুল জব্বারের পূর্বপুরুষ আসেন সুদূর তুরস্কের বন্দর নগরী ইন্সতাম্বুল শহর থেকে। ইন্সতাম্বুল শহরের সাবেক নাম কনসটান্টিনোপাল। জব্বার সাহেব্দের পূর্বপুরুষের প্রকৃত পদবী ছিল ‘জাহেদি-কোরাইশি’। তাই নবাব আব্দুল জব্বারের বাবার প্রকৃত নাম ছিল গোলাম আসগার জাহেদি-কোরাইশি। মায়ের নাম ছিল ফজিলাতুন্নিসা। জব্বারের বংশের প্রথম পুরুষের নাম শাহাবুদ্দিন কবীর জাহেদি-কোরাইশি’। জব্বার শাহাবুদ্দিনের ১৭-তম পুরুষ। জব্বারের দুই বোনের নাম নাজরুন্নিসা ও রাবেয়া বিবি। ১৯১৮ সালে নবাব আব্দুল জব্বারের জীবনাবসান হয়। অবিভক্ত বঙ্গের হাতে গোনা কয়েকটি অভিজাত ও শিক্ষিত মুসলিম পরিবারের মধ্যে নবাব আব্দুল জব্বারদের পরিবার অন্যতম।
উনবিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে রাজা রামমোহন রায় ইউরোপীয় রেনেসাঁর প্রভাবে প্রভাবিত হয়ে বাংলায় যে নবজাগরণের সূচনা করেন তা বহুলভাবে ইতিহাসের পাতায় প্রচারিত। রামমোহনেরও অনেক আগে হাজী মহম্মদ মহসীন, কাজী ফকির মহম্মদ, তিতুমীর সহ বাংলার আরও অনেক মুসলিম মনিষী গণশিক্ষা ও ধর্মসংস্কার আন্দোলন করেছিলেন। ইতিহাসের পাতায় তা সেরকম ভাবে স্থান দেওয়া হয়না। পরবর্তীতে তাদেরই একজন অন্যতম যথার্থ উত্তরসূরী হলেন নবাব আব্দুল জব্বার। অথচ ইতিহাসের পাতায় নবাব আব্দুল জব্বারকে কেন অবজ্ঞা করা হল তা অনেকের কাছে লাখ টাকার প্রশ্ন। নতুন প্রজন্মের কাছে নবাব আব্দুল জব্বারদের ইতিহাস মেরে ফেলার জন্য কে বা কারা দায়ী?
লেখক মোহাম্মদ সাদউদ্দিন দৈনিক কালান্তর পত্রিকার সিনিয়র সাংবাদিক এবং কয়েকটি গ্রন্থের প্রণেতা। বর্তমানে কলম ধরেছেন dinkal.in এর জন্য। লেখকের সাথে ফেসবুকে যোগাযোগ করতে পারেন এখানে ক্লিক করে।