শিবাজী মহারাজ ৮ জন নারীর পাণিগ্রহণ করেন
রাজতন্ত্রের যুগে তো বটেই, ঔপনিবেশিক আমলেও রাজশক্তির সাথে জনসাধারণের সম্পর্ক ছিল ‘রাজা-প্রজা’র সম্পর্ক। কেউ কেউ রাজা, বাদশা বা উচ্চপদস্থ ব্রিটিশ কর্মচারীর কাছে বাড়তি খাতিরের প্রত্যাশায়, কেউবা নির্মম নিপীড়নের হাত থেকে বাঁচার তাড়নায় হাতজোড় করে বলতেন — ‘হুজুর আপনি আমার মা-বাপ!’ তেমনি কোন কোন ব্রাহ্মণ কখনও কোনো প্রাপ্তিযোগের প্রত্যাশায় অথবা করুণা লাভের স্বীকৃতিস্বরূপ শিবাজীকে তোয়াজ করে বলতেই পারেন — ‘রাজন, আপনি হলেন ব্রাহ্মণ প্রতিপালক!’ তার মানে এই নয় যে, ছত্রপতি শিবাজী কখনও ‘কুলশ্রেষ্ঠ’ বলে ব্রাহ্মণদের মাথায় ছাতা ধরেছিলেন।
ব্রাহ্মণ্যবাদী রাজনীতির বর্তমান উত্তরসূরীরা কিন্তু শিবাজীকে ব্রাহ্মণ প্রতিপালক হিসেবেই প্রতিপন্ন করতে ভীষণ উদগ্রীব। কিন্তু তা যে ইতিহাসের তথ্য ও যুক্তির ধোপে টিকছে না! আগের দিন আমরা ঐতিহাসিক স্যার যদুনাথ সরকারকে উদ্ধৃত করে দেখেছি যে, মহারাষ্ট্রের ব্রাহ্মণরা শিবাজীর ক্ষত্রিয়ত্ব অস্বীকার করার মধ্য দিয়ে তাঁর রাজ্যাভিষেকের বিরোধিতা করেছিলেন। সংস্কারগ্রস্ত ব্রাহ্মণ্যবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে বিরোধিতার যথেষ্ট কারণও ছিল। গোঁড়া ব্রাহ্মণরা বিশ্বাস করতেন যে, পরশুরামের কুঠারাঘাতে নিক্ষত্রীয় হয়ে গেছে সমগ্র বিশ্ব। সুতরাং ক্ষত্রিয়শূন্য হিন্দু ধর্মে রাজবংশজাত বা রাজকীয় গুণসম্পন্ন কেউ থাকতেই পারে না। তাদের এই বিশ্বাসকে প্রকারান্তরে বৈধতা দিয়েছিল স্বয়ং শিবাজীর জীবনেরই দুটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। প্রথমত, শিবাজীর উপনয়ন হয়নি। দ্বিতীয়ত, তার বিয়েও ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান অনুযায়ী হয়নি। তার প্রথম বিয়ে হয় ১৬৪০ সালে সাঈ ভোঁসলের সাথে। সে সময় পাত্র শিবাজীর বয়স মাত্র ১০ বছর, আর পাত্রীর বয়স সাত বছর মাত্র। মাত্র ৫০ বছরের জীবনে আরো ৭ জন নারীর পাণিগ্রহণ করেছিলেন শিবাজী মহারাজ। তাঁর সেই সাতজন রানীর নাম যথাক্রমে সোয়ারাবাঈ, পুতলাবাঈ,কাশীবাঈ, সগুনাবাঈ,মঞ্জুলাবাঈ, শকরারবাঈ ও গুণবতীবাঈ।
যে সমস্ত উগ্র হিন্দুত্ববাদীরা মুসলমানদের বহুবিবাহ — যা এখন প্রায় অবলুপ্তির পথে — নিয়ে বহু রকমের কটুকাটব্য করতে ভালোবাসেন এবং শিবাজীকে আদর্শ হিন্দু হিসেবে প্রতিষ্ঠা দেওয়ার জন্য পাগলপ্রায়, তাঁরা কি সামান্য এই ইতিহাসের খোঁজও রাখেন! এহ বাহ্য, তারা যে রামরাজ্য প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখছেন, সেই ভগবান রামচন্দ্রের বাবার কয়টি বিয়ে সে প্রশ্নও তোলা যায়!
যাই হোক, ‘অ-ক্ষত্রীয়’ শিবাজীর রাজ্যাভিষেকের অনুষ্ঠানে পৌরোহিত্য করতে মহারাষ্ট্রের কোনও ব্রাহ্মণ এগিয়ে আসেননি। ফলে বাধ্য হয়ে বারানসী থেকে গাগা ভট্ট নামে এক ব্রাহ্মণকে আনা হয়। গাগা ভট্ট ও তাঁর সঙ্গী-সাথীদের শিবাজী এত পরিমাণ সোনাদানা দান করেছিলেন যে, তাঁদের পক্ষে তা বয়ে নিয়ে যাওয়াই কষ্টকর হয়েছিল।
রাজানুগ্রহ তারাই পান, যারা রাজানুগত। সুতরাং ব্রাহ্মণ মাত্রই যে শিবাজীর অনুগ্রহ লাভ করেছেন এমনটা আদৌ নয়। একবার এক ব্রাহ্মণ কোন একটি অন্যায় করায় শিবাজী তাঁকে রীতিমতো চিঠি লিখে জানান যে, ব্রাহ্মণ বলে তাঁকে কোন রেয়াত করা হবে না। তিনি স্পষ্ট ভাষায় লেখেন, “যে শত্রু সুলভ আচরণ করবে, তাঁর সঙ্গে শত্রু হিসেবেই আচরণ করা হবে।” (কে ছিলেন শিবাজী — গোবিন্দ পানসারে)
‘ব্রাহ্মণের প্রতিপালক’ শিবাজীর সাথে মহারাষ্ট্রীয় ব্রাহ্মণদের সম্পর্ক যে মধুর ছিল না, সে বিষয়ে বহু তথ্য-প্রমাণ রয়েছে। দৃষ্টান্ত স্বরূপ একটি ঘটনা বলা যাক।
দিল্লির বাদশাহের অধীনে কর্মরত ছিলেন অত্যন্ত বিশ্বস্ত এবং অভিজাত ও প্রভাবশালী মির্জা রাজা জয়সিংহ। তিনি দিল্লীর নির্দেশে মহারাষ্ট্রে শিবাজীকে দমন করতে এলে মহারাষ্ট্রের ব্রাহ্মণরা শিবাজীর পরাজয় এবং জয়সিংহের জয় কামনায় ‘কোটি চন্ডী যজ্ঞ’ করেছিলেন। যজ্ঞের জন্য জয়সিংহ দু’কোটি টাকা বরাদ্দ করেছিলেন। নিয়োগ করেছিলেন ৪০০জন পুরোহিত, যারা তিন মাস ধরে দিনরাত জয়সিংহের বিজয় কামনায় প্রার্থনা করেছিলেন। (চলবে)