ভারত সর্বদা প্যালেস্টাইনের স্বাধীনতার পক্ষেই ছিল, ভবিষ্যতেও যেন থাকে

~ড. শামসুল আলম, (প্রাক্তন অধ্যক্ষ, লেখক ও অ্যাক্টিভিস্ট)

জাতিসংঘ ( UN) ১৯৪৭ সালে যখন প্যালেস্টাইনকে দু টুকরো বা দুই রাষ্ট্র করার ন্যক্কারজনক পরিকল্পনা নেয়, তখন ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু তাকে মেনে নেন নি এবং তিনি প্যালেস্টাইন বিশেষ কমিটিতে( UNSCOP) পাঠান স্যার আব্দুর রহমানকে ভারতের প্রতিনিধি হিসাবে। তিনি আব্দুর রহমানকে একটা দীর্ঘ চিঠি লিখে বলেন, ” আমি যে চিঠি দিচ্ছি সেটা কংগ্রেস এবং অন্তর্বর্তী সরকারের সিদ্ধান্ত যার শরীক অবিভক্ত গোটা উপমহাদেশ । ” তিনি তার চিঠিতে স্পষ্টত জানিয়ে দেন, ভারতবর্ষ প্যালেস্টাইন বিভাজন চায় না। ভারতবর্ষ চায় ঐক্যবদ্ধ প্যালেস্টাইন সেকুলার যুক্তরাষ্ট্র যেখানে ইহুদিরা ধর্মীয় সংখ্যালঘিষ্ঠ হিসাবে ধর্মীয় এবং অন্যান্য অধিকার ভোগ করবে। কিন্তুু কোন পৃথক ইজরায়লি রাষ্ট্র হবে না। তিনি তার চিঠিতে আরো বলেন, আরব জাতির মতামতের বিরুদ্ধে গিয়ে জাতিসংঘের কোন সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়া উচিত নয়। কিন্তু আরব দেশগুলোর সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ভারত ভোট দেয় সাধারণ সভায় এবং ইহুদীবাদী ঈঙ্গ- মার্কিন চাপে যে ভোট হয় তাতে ৩৩-১৩ ভোটে দুই রাষ্ট্রের সিদ্ধান্ত পাশ হয় ১৮১ নামক প্রস্তাবে। তথাপি ভারত ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত ইজরায়েলকে মেনে নেয়নি যতোদিন PLO র ইয়াসির আরাফাত তা মেনেছিলেন। ১৯৯৩ এর অসলো চুক্তিতে। প্রসঙ্গত, ১৯৮৩ সালে সপ্তম দিল্লির নির্জোট সম্মেলনে ইন্দিরা গান্ধী ইয়াসির আরাফাতকে ফিলিস্তিনী রাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের সম্মান দেন এবং ঐ সম্মেলন প্যালেস্টাইনের সমস্ত দখলিকৃত জায়গা ছেড়ে দেবার জন্য ইজরায়েলকে চাপ সৃষ্টি করা হয়।

২০০০ সালে অটল বিহারী বাজপেয়ীও স্বাধীন প্যালেস্টাইনের পক্ষে এবং ইজরায়েলের বিরুদ্ধে অনড় থাকেন। মোদীর নেতৃত্বাধীন বিজেপি সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে ভারতের প্যালেস্টাইন সংক্রান্ত বিদেশ নীতি ডিগবাজী খায়। ২০১৭ সালে মোদী ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী যিনি ইজরায়েল গিয়ে প্যালেস্টাইনের রাজধানী রামাল্লা সফর করেননি এবং এমন অনেক প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত চুক্তি করেন যা ভারতের সার্বভৌমিকতাকেও ক্ষুণ্ণ করে। এরপর মোসাদ এবং পেগাসাস এনে ভারতীয় রাজনীতির অঙ্গনে বিরোধী এবং প্রতিবাদীদের শায়েস্তা করার চেষ্টা হয় এবং তারপর সবচেয়ে কলঙ্কময় বিষয় হল, ইজরায়লি বন্দর হাইফাকে আদানীর হাতে তুলে দেয় ইজরায়েলের নিতেনেহু মোদীর সাথে চুক্তি করার পর। আজ হাইফাকে ভারত- আরব- ইউরো করিডর করতে উদ্যত মোদী- নিতেনেহু -বাইডেন। এটা আমাদের দেশের স্বার্থের সাথে সংগতিহীন।

গত ৭ অক্টোবর গাজা জলে স্থলে অন্তরিক্ষে অবরুদ্ধ হবার জন্য যখন গাজার ২৩ লাখ মানুষ মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা কষছে, তখন স্বাধীনতা সংগ্রামী সশস্ত্র হামাস আঘাত হানে ইজরায়েলে। বহির্বিশ্বে সবচেয়ে আগে ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোদী কঠোরভাষায় নিন্দা করেন হামাসকে জঙ্গী বাহিনী আখ্যা দিয়ে এবং তিনি সর্বশক্তি দিয়ে ইজরায়েলের পাশে থাকার অঙ্গীকার করেন যা ৭৬ বছরের ভারতবর্ষের নিরবচ্ছিন্ন ফিলিস্তিনী সংহতির বুকে বজ্রাঘাতের সমতুল্য বললে কোন অত্যুক্তি হবে না।

এটা খুব লজ্জার যখন শুনতে হয়, মোদীর সহপাটি যোগী এবং তার উত্তরপ্রদেশ সরকার আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়াদের বিরুদ্ধে FIR করা হয়েছে ফিলিস্তিনীদের প্রতি সংহতি জ্ঞাপন করার কারণে। এমন কি, ঐ রাজ্যে এবং বিজেপি শাসিত নানা রাজ্যে অসংখ্য মিথ্যা মামলা দেওয়া হয়েছে কিছু যুবকদের নামে নিছক ফিলিস্তিনী ভাইবোনদের দুর্দশার পাশে থাকার জন্য। মোদীজির জমানায় ইজরায়েলের হয়ে কেউ ব্যাট ধরলে তাকে পুরস্কৃত করা হচ্ছে। ইয়াতি নরসিংহানন্দ নামে একজন ফ্যাসিস্ট সাম্প্রদায়িক যোগী একদা মুসলিম গনহত্যার জিগির তুলে বহাল তবিয়তে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। সম্প্রতি তিনি যখন ইজরায়েলে ১৫০০ স্বেচ্ছাসেবক নিয়ে গিয়ে ফিলিস্তিনীদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরবেন বলেন,তখন তিনি দিব্যি গদি মিডিয়া এবং শাসকের প্রিয়ভাজন হলেন।

সবচেয়ে দুঃখজনক হল, আল জাজিরা সুলুক সন্ধান করে জেনেছে যে, হামাস বাহিনীকে শিশু ঘাতক, কিশোর পাচারকারী, মেয়ে ধর্ষক হিসাবে চিত্রিত করছে বিজেপি আই টি সেল এবং BOOM নামের ওয়েবসাইট। সারা দুনিয়া জেনে গেছে হামাস শুধু আজ নয়, কখনোই এ জাতীয় নৃশংস কাজে যুক্ত ছিল না। গোয়েবেলীয় মিথ্যাচারের আর একটা অংশ হল ৪০টা শিশুর মাথা কাটায় যুক্ত হামাস। সবটাই হচ্ছে আন্তর্জাতিক ঈঙ্গ- মাকিন ষড়যন্ত্রের অংশ যার অংশীদার আজকে ভারতও।

আমরা মহান মাতৃভূমি ভারতের নাগরিক হয়ে নেহেরু – ইন্দিরার ফিলিস্তিনী স্বাধীনতার লড়াইয়ের স্বপক্ষীয় বিদেশ নীতির পাশে আছি এবং থাকবো। আর ধিক্কার দিই RSS – BJP চালিত ইজরায়লী মৌলবাদী বন্ধুত্বকে যা এ দেশে হিন্দু মুসলিম মেরুকরণ করায় এবং প্যালেস্টাইনের লড়াইকে হেয় প্রতিপন্ন করে যার মূলে নিহিত আছে বাইডেন- সনুক- নিতেনেহু – মোদীর ইসলামজুজু এবং আরব ফিলিস্তিনী স্বাধীনতা দমন। জাতিধর্ম নির্বিশেষে সারা দুনিয়ার শান্তিকামী জনগন আজ এক হচ্ছে মাঠে ময়দানে নিজভূমে পরবাসী প্যালেস্টাইনের পক্ষে এবং দখলদার হানাদার ইজরায়েলী বর্বর আগ্রাসন ও অবরোধের বিরুদ্ধে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back To Top