মুসলিম কর্নেল, যে নেতাজী কে বাচাতে তিনটে বুলেট বুকে নিয়েছিল

ব্রিটিশদের কাছ থেকে ভারত কে যারা স্বাধীন করেছিল আমরা তাদের কে ভুলতে বসেছি। অথচ আমাদের উচিত ছিল আমাদের দেশকে যারা আত্মবলিদান দিয়ে স্বাধীন করেছিল তাদের মনে রাখা কিন্তু আমরা তাদের প্রাপ্য তাদের কে দিতে ব্যর্থ।

হাজার হাজার স্বাধীনতা আন্দোলনকারীদের লড়াইয়ের ফসল আজকের এই ভারত। আজকে আলোচনা করব এমনই একজন কে নিয়ে যে তার কাজের জন্য যথেষ্ট আলো পায়নি, অথচ তার অবদান অনস্বীকার্য।

তিনি হচ্ছেন কর্নেল নিজামুদ্দিন, এই সাহসী বীর নেতাজীর ডানহাত ছিলেন। কর্নেল নিজামুদ্দিন মায়ানমারের জঙ্গলে লড়াই করার সময় নেতাজী কে বাচাতে বুলেটের সামনে ঝাপিয়ে পড়েছিলেন এবং তিনটে বুলেট নিজের বুকে নিয়ে নেতাজীকে প্রাণে বাচান। তার এই সাহস দেখে নেতাজী তাকে কর্নেল উপাধি দেন।

অজানা সত্যঃ 

নিজামুদ্দিন এর আসল নাম ছিল সাইফুদ্দিন। জন্ম ধাকবান, (বর্তমানে আজমগড়, উত্তরপ্রদেশ)। তার বাবা ইমাম আলি রেঙ্গুনে ক্যান্টিন চালাতেন। সে তার মার সাথেই থাকত।

যখন তার ২০ বছর বয়স সে বাড়ি থেকে পালিয়ে যায় এবং ব্রিটিশ আর্মি তে যোগ দেয়। নৌকা তে করে কলকাতা পৌঁছে সে ব্রিটিশ বাহিনী যোগ দেয়। এরপর একদিন সে দেখে যে ব্রিটিশ সেনাপতি কে বলতে যে ভারতীয় সেনাদের মরতে দাও এবং এগিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে চলো।

এইকথা শোনার পর তীব্র ঘৃণায় সে সেই ব্রিটিশ অফিসার কে হত্যা করে এবং সিঙ্গাপুর পালিয়ে যায়। সেখানে নাম পরিবর্তন করে নিজামুদ্দিন নাম নিয়ে নেতাজীর নেতৃত্বে থাকা ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মি তে যোগ দেন।  

নেতাজীকে বাচানোর কথা বলতে গিয়ে কর্নেল নিজামুদ্দিন ২০১৬ সালে দ্য টেলিগ্রাফ কে একটি সাক্ষাৎকারে বলেন, “আমরা জঙ্গল দিয়ে এগোচ্ছিলাম, ঠিক সেই সময় ব্যারেলের আওয়াজ শুনি এবং সাথে সাথেই নেতাজীর সামনে ঝাপিয়ে পড়ি। বুলেট শরীরে আঘাত করার সাথে সাথেই আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। যখন আমার জ্ঞান ফেরে, দেখি নেতাজী আমার পাশে দাঁড়িয়ে। ক্যাপ্টেন লক্ষী সেহগল আমার শরীর থেকে বুলেট বের করেছিল। এই ঘটনা ঘটেছিল ১৯৪৩ সালে।“

এরপর নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু একটি সাবমেরিনে করে জার্মানি হয়ে সিঙ্গাপুর পৌঁছান এবং সেখানে আজাদ হিন্দ বাহিনীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন। কর্নেল নিজামুদ্দিন নেতাজীর সঙ্গেই ছিলেন এবং নেতাজীর সব থেকে বড় বিশ্বাসী সাথী তে পরিণত হন। নিজামুদ্দিন নেতাজীর ড্রাইভার হিসেবে কাজ করতেন এবং মালয় রাজার দেওয়া ১২ সিলিন্ডারের গাড়িতে করে নেতাজী কে নিয়ে গাড়ি চালাতেন।

১৯৪৩ থেকে ১৯৪৪ পর্যন্ত নিজামুদ্দিন নেতাজীর কাধে কাধ মিলিয়ে মায়ানমারের জঙ্গলে ব্রিটিশ আর্মির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন। এরপরে আরো ৪ বছর তিনি নেতাজীর ছায়া হয়ে ছিলেন। নেতাজী যেখানেই গেছেন সেখানেই থেকেছেন এই বীর। সে জাপান, ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়া, মালয়েশিয়া বা সিঙ্গাপুর যেখানেই হোক না কেন।

১৯৪৫ সালে জাপান আত্মসমর্পণ করলে আজাদ হিন্দ দুর্বল হয়ে পড়ে এবং ১৯৪৫ এর নেতাজীর দুর্ঘটনার পরে নিজামুদ্দিন রেঙ্গুনে আব্জুন নিশা কে বিয়ে করেন এবং সেখানেই একটি ব্যাংকের ড্রাইভার হিসেবে কাজ করেন। সেখানেই তার দুই সন্তানের জন্ম হয়।

১৯৬৯ সালে তিনি ভারতে ফিরে আসেন। তিনি নিজের গ্রামে ফিরে এসে জীবনের আরেকটি অধ্যায় শুরু করেন। গ্রামের বাড়ির নাম রাখেন হিন্দ ভবন, বাড়ির ছাদে জাতীয় পতাকা। কারো সাথে দেখা হলেই জয় হিন্দ বলে সম্বোধন করতেন।

নিজামুদ্দিন তার শেষ নিশ্বাস পর্যন্ত সেই গ্রামেই বাস করেন। ২০১৭ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি তিনি শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। ১১৭ বছর বয়সে তিনি পৃথিবীকে বিদায় জানান। আশ্চর্যজনকভাবে এই স্বাধীনতা সংগ্রামী প্রচারের আলোয় আসেন অনেক পরে যখন তিনি বিশ্বের সব থেকে বয়স্ক ব্যক্তি হিসেবে বেচে থাকার দাবীদার হন।

যাইহোক, কর্নেল নিজামুদ্দিন এর কাহিনী যে আমাদের কে অনুপ্রেরণা দেবে এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই।

~অনুবাদঃ শুভো

This article can be found here.

Back To Top