বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ঃ সাম্প্রদায়িকতা, হিন্দুত্ববাদ এবং কিছু কথা – ১

মোহাম্মদ সাদউদ্দিন

ইদানিংকালে সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে নতুন করে আলোচনা হচ্ছে যে তিনি সাম্প্রদায়িক ছিলেন কি না। কেউ-কেউ এ কথাও বলছেন তিনি মোটেই সাম্প্রদায়িক ছিলেন না। আবার অনেকে একথাও ছোঁড়ে দিচ্ছেন যে,  ৯০ শতাংশ মুসলিম অধ্যুষিত বাংলাদেশ রাষ্ট্র যদি কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’-কে জাতীয় সঙ্গীত হিসাবে মেনে নিতে পারে তাহলে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়-এর ‘বন্দেমাতরম’ মানতে আপত্তি কোথায়? এ কথার জবাবে বলা যায় ‘আমার সোনার বাংলায়’ দেশকে ভালোবাসা ও তার প্রকৃতি নিয়ে গুণগান করা হয়েছে। আর বঙ্কিমচন্দ্রের ‘বন্দে মাতরম’ এ মাতৃবন্দনা ও দেব-দেবির গুণগানে মুখরিত যা ইসলাম ধর্মের মূল দর্শনে আঘাত করছে। মুসলিমদের আপত্তিটা ঠিক সেখানেই। তাই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও ‘বন্দেমাতরম’-এর অনেকাংশ নিয়ে আপত্তি করেছেন বঙ্কিমের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়েও। শুধু রবীন্দ্রনাথ নয়, পন্ডিত জহরলাল নেহরু, মহাত্মা গান্ধী ও মাওলানা আবুল কালাম আজাদের মতো জাতীয় নেতারা আপত্তি করেন ‘বন্দে মাতরম’ নিয়ে। কলকাতার তরুন লেখক ও গবেষক আমিনুল ইসলাম তার ‘বঙ্কিমচন্দ্রের মুসলমান চর্চা’ গ্রন্থের ‘বন্দে মাতরম : ধর্ম নিরপেক্ষতা, সমকালীন রাজনীতি ও রবীন্দ্রনাথ’ প্রবন্ধে যথার্থভাবেই বলেছেন, ‘দেশমাতা প্রতিমার রুপ ধরেন এবং ‘দশ প্রহরণ ধারিণী’ দেবী দুর্গায় রূপান্তরিত হন। জাতীয়তাবাদের উপর অনিবার্যভাবে হিন্দুত্বের রঙ এসে পড়ে। ফলে গীতটি (বন্দে মাতরম) জাতীয় আন্দোলনে প্রবল প্রেরণা সঞ্চার করলেও ভারতের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় একটা ধর্মনিরপেক্ষ সাম্রাজ্যবিরোধী আন্দোলন গড়ে তোলার দিকে এই গানের ভূমিকা অনুকুল ছিল না। এই কারণেই নেহরু, গান্ধীজী, মাওলানা আজাদ প্রমুখ নেতারা জাতীয় সঙ্গীত হিসাবে ‘বন্দেমাতরম’-এর বিরোধিতা করেন (পাতা ১৯৯)। নিশ্চয়ই পাঠক সমাজ বুঝতে পারছেন, ‘বন্দেমাতরম’ নিয়ে মুসলিম সমাজেরই নয়, অনেক বিদগ্ধ ব্যাক্তিত্বদের আপত্তি ছিল। পশ্চিমবঙ্গে অনেক তাবড় মুসলিম কংগ্রেস নেতাকেও ‘বন্দেমাতরম’ নিয়ে আপত্তির কথা বলতে শোনা গেছে’। আজও কলকাতায় প্রদেশ কংগ্রেস দপ্তর ‘বিধান ভবনে’ কোনও বিশিষ্ট জাতীয়তাবাদী নেতার জন্মদিন অথবা মৃত্যুদিন পালিত হলে সংশ্লিষ্ট নেতার প্রতিকৃতিতে মাল্যদান করতে অনেক মুসলিম নেতা কর্মীদের অনীহা দেখা যায়। ‘বিধানভবনে’ এই বাস্তব অভিজ্ঞতা দেখা গিয়েছে।

এখন বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় সাম্প্রদায়িক ছিলেন অথবা ছিলেন না এ ব্যাখাও আজকের দিনে প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে আবারও। বাংলাদেশের দুই প্রখ্যাত গবেষক, লেখক ও প্রাবন্ধিক আহমেদ ছফা ও আবুল কাসেম ফজলুল হকের মধ্যে একটি পরস্পর বিরোধী মতামত রয়েছে। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়-এর সাম্প্রদায়িকতা ও মুসলিম বিদ্বেষ নিয়ে পারস্পারিক মতভেদ থাকতেই পারে। কিন্তু এ কথা তো অস্বীকার করার কোনও উপায় নেই যে, ব্রিটিশ উপনিবেশবাদকে সমর্থন করতে গিয়ে সাহিত্যের মধ্যে সাম্প্রদায়িকতা ও হিন্দুত্ববাদের পুনর্জাগরন ঘটিয়েছেন এক শ্রেণীর লেখক সাহিত্যিকরা। অনেকেই এই অভিমত ব্যক্ত করেন যে, ১৮৫৭ সালের পর ভারতবর্ষে সাম্প্রদায়িকতা বিশাল ভাবে চাড়া দেয়। কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হবে ১৭৫৭ সাল থেকে ১৮৫৭ সাল পর্যন্ত বঙ্গ বা ভারতের মাটিতে সাম্প্রদায়িকতা বা ভেদাভেদের একটি চোরাস্রোত ছিল। পলাশীর যুদ্ধে দেশীয় বনিক সমাজ ও সামন্ত প্রভুদের মুসলিম নবাব সিরাজ-উদ-দোলাকে  বাদ দিয়ে ইংরেজদের শাসন অনেক আশীর্বাদই মনে হয়েছিল। কলকাতার বিখ্যাত জমিদার ও সামন্ত প্রভুরা নবাবকে হারানোর জন্য গোপন ডেরায় যে ব্লু প্রিন্ট তৈরি করেছিল তাতো হিন্দুত্ববাদকে প্রতিষ্ঠা করারই একটি কৌশল। ১৮৩০ সালে বঙ্কিম- গুরু ঈশ্বর গুপ্তর সংবাদ প্রভাকর পত্রিকার মাধ্যমে তা অনেকটাই হিন্দুত্ববাদ ও মুসলিম বিদ্বেষ প্রকাশ্যে আসে। গুরুর শুরু, আর শিষ্য বঙ্কিমের মধ্যে তা আরো প্রকট আকার ধারণ করে। বঙ্কিমের সাহিত্য প্রতিভার প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই বলছি বঙ্কিমের হিন্দুত্ববাদের জাগরণের দ্বারাই বঙ্গের বা অবিভক্ত ভারতে হিন্দুত্ববাদ বা হিন্দু সংগঠন গুলি গড়তে মন্ত্রের কাজ করে।

আজকের আর এস এস, বিশ্ব হিন্দু পরিষদ, হিন্দু মহাসভা, জনসংঘ, বিজেপি তারই ফসল। হিন্দু মেলা, জাতীয়সভা, আর্যসমাজ, আত্মীয় সভা-র যথার্থই উত্তরসূরি এই সংগঠনগুলি। এমনকি যে ব্রাহ্মসমাজকে আমরা প্রগতিশীল বলে মনে করি তাদেরও ছিল ভিতরে ভিতরে হিন্দুত্ববাদের পরশ। একথা কি অস্বীকার করা যায় মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘তত্ববোধিনী’ পত্রিকায়তো হিন্দুত্ববাদ এসেছে নানান কৌশলে। আবার তাঁর দুই ছেলে গগনেন্দ্রেনাথ ঠাকুর ও দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘হিন্দু মেলা’ সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। বাংলাদেশের বিশিষ্ট গবেষক, লেখক ও প্রাবন্ধিক আহমেদ ছফার এই সব বক্তব্যের সঙ্গে সহমত পোষণ করি। (দ্রষ্টব্য, আহমেদ ছফা সঞ্জীবনী, জাতীয় সাহিত্য- ১, সলিমুল্লাহ খান)। সলিমুল্লাহ খানের ‘আহমেদ ছফা সঞ্জীবনী’, জাতীয় সাহিত্য – ১ গ্রন্থের ‘বঙ্গভঙ্গ ও বঙ্কিমচন্দ্র’ নিবন্ধে আহমেদ ছফার একটি উক্তি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। উক্তিটি হল, ‘অদৃষ্টের কি নির্মম পরিহাস, যে বন্দে মাতরম সঙ্গীতের মাধ্যমে স্বদেশাত্মার মর্মবাণীটি আবিষ্কার করেছিলেন, সেই একই শক্তিমান মন্ত্র মহাকালের খড়গের রুপ ধারণ করে তার আপন মাতৃভূমিকে দ্বিখণ্ডিত করে ফেলল। মাতৃমুক্তির মন্ত্রের অপপ্রয়োগ করে বঙ্কিম মাতৃ অংগচ্ছেদের ব্যবস্থা পাকাপোক্ত করলেন’। (ছফা ১৯৯৭ : ২৬). আহমেদ ছফার এই বলিষ্ঠ উক্তির মাধ্যমেই বলা যায়, ভারতে দ্বিজাতি তত্বের প্রবক্তা কিন্তু মহম্মদ আলি জিন্না কিংবা মুসলিম লীগ নয়। ১৯৪০ সালে কংগ্রেসের লাহোর অধিবেশনে মুসলীম লীগের পাকিস্তান প্রস্তাব কিংবা ১৪ দফা উত্থাপিত ও গৃহীত হলেও দ্বিজাতিতত্বের বীজটি কিন্তু নিহিত ছিল হিন্দুত্ববাদী সংগঠন ও হিন্দুত্বজাগরণবাদী সাহিত্য সৃষ্টির মধ্য দিয়ে। সেই কাজটি ১৮৩০-৩১ সালে বঙ্কিম-গুরু ঈশ্বর গুপ্ত ‘সংবাদ প্রভাকর’-এর মধ্যে সৃষ্টি করেন। আর বঙ্কিম সাহিত্যে তা আরও প্রবল আকার ধারণ করে। আর শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় এসে আরও মহীরুহ রুপ নেয়। তাই আজও পশ্চিমবাংলার হিন্দুত্ববাদীরা প্রচার করে বেড়ায় যে অবিভক্ত বঙ্গের গর্ভ থেকে পশ্চিমবঙ্গকে শ্যামাপ্রসাদ বাবুরা ছিনিয়ে না নিতেন তাহলে কলকাতার বিধানসভা কিংবা রাইটার্স বিল্ডিং মু্সলীম লীগ কিংবা মুসলিমদের দখলে থাকতো। আজকের পশ্চিমবঙ্গের জন্ম যদি না হোত তাহলে সেই রাজ্যটির মুখমন্ত্রী প্রফুল্ল চন্দ্র ঘোষ, বিধানচন্দ্র রায়, জ্যোতি বসু, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য, সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায় ও মমতা ব্যানার্জি হতে পারতেন না।

১৯৪৭ এ ভারত ভাগ হওয়ার আগে অর্থাৎ ৫৫ দিন আগে বাংলা ভাগ হয়ে যায়। সে সময় জ্যোতি বসু সহ কমিউনিস্ট পার্টির (অবিভক্ত) ৩ সদস্যই বাংলা ভাগের পক্ষেই ভোট দেন। এটাও কি হিন্দুত্ববাদী শ্রেণী স্বার্থের জন্য? কলকাতায় বসবাসকারী অবিভক্ত বঙ্গের পূর্ব ও পশ্চিমাংশের জমিদার, ব্যবসায়ী বনিক সম্প্রদায়ের স্বার্থে ঘা লাগছিল বলেই কি ১৯০৫ সালের ব্রিটিশদের বঙ্গভঙ্গ নিয়ে ‘বাংলা ও বাঙালী’ গেল গেল বলে রব তুলে মায়া কান্না করা হয়েছিল? কারা তারা? তারাতো সবাই বঙ্কিমের ও শ্যামা প্রসাদের উত্তরসূরি। আর সেই বঙ্কিম ও শ্যামাপ্রসাদের উত্তসূরীরাই বাংলাকে ভাগ করে। তারাই কিন্তু শরৎচন্দ্র বসু, এ.কে. ফজলুল হক, আবুল হাসিম, সোহারাওয়ার্দী ও কিরণশঙ্কর রায়ের স্বাধীন বঙ্গভূমি প্রতিষ্ঠাকে বানচাল করে দেয়। ভারত ভেঙ্গে পাকিস্তান হয়েছে। আবার সাংস্কৃতিক আগ্রাসন ও পাক-উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করে বাংলাদেশ হলেও পশ্চিমবঙ্গের বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী এলাকায় বঙ্গসেনা, হিন্দু জাগরণ মঞ্চ, লিবারেশন টাইগার অব বাংলাদেশ (সংক্ষেপে এল টি বি, এরা সশস্ত্র), দুর্গা বাহিনী, আমরা বাঙালি, হিন্দু সংহতি, নারায়ণ সেনা- এদের প্রবল দাপট কেন? হিন্দু বাঙালি উদবাস্তুদের জন্য পৃথক ‘বঙ্গভূমি’ করার জন্য? এরা কাদের উত্তরসূরি? ব্রিটিশ উপনিবেশবাদের সাফাই গাইতে গিয়ে সাহিত্যের ক্ষেত্রে যারা হিন্দুত্ববাদ ও হিন্দুত্ববাদী দর্শনকে স্থান দিয়ে মুসলিম বিদ্বেষ তৈরি করেছেন সেই লেখকরাই কি এদের পূর্বসূরি নয়? এইসব লেখকদের জন্যইতো আজকের ভারতে ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে বিজেপি, আরএসএস, হিন্দু মহাসভা, বিশ্বহিন্দু পরিষদ। এই সব লেখকদের বা কবিদের তালিকায় ঈশ্বর গুপ্ত (১৮১২-১৮৫৯), নবীন চন্দ্র সেন (১৮৪৭-১৯০৯), রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮২৭-১৮৮৭), হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮৩৮-১৯০৩), এবং অবশ্যই বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। বঙ্কিম-উত্তর লেখকদের বা কবি কিংবা নাট্যকারদের মধ্যে দিজেন্দ্রলাল রায়ের নামও চলে আসে। আরও অসংখ্য কবি ও লেখকের নাম আসবে। তালিকায় নাট্যকার গিরিশচন্দ্রও বাদ যাবেনা।

 

পরবর্তী সংখ্যা খুব শীঘ্রই আসছে… 

Back To Top