বাবরি মসজিদ রায় হিন্দুরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলনকে আরও এক ধাপ এগিয়ে দিল

সুপ্রিমকোর্ট

~তায়েদুল ইসলাম

বাবরি মসজিদ রায় যে রাজনৈতিক রায় এবং সরকারের ফরমায়েসী রায় এ বিষয়ে কারোরই কোন দ্বিমত নেই। ইতিমধ্যেই এই রায়ের বিরুদ্ধে দেশে বিদেশে নানা রকম প্রতিবাদ শুরু হয়েছে। কিন্তু কেউ কেউ এই রায়ের সঠিক মূল্যায়ন করতে ব্যর্থ হচ্ছেন। অনেক বড় রাজনৈতিক নেতা বলছেন মোদী সরকার ব্যর্থতাকে আড়াল করতে জনগণের দৃষ্টিকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার জন্য এ সব কাজ করছে। এ মূল্যায়ন ঠিক নয়। কারণ ব্যর্থতা তখন হয় যখন করতে চায় পারে না। কিন্তু মোদী সরকার জনগণের কল্যাণ করতেই চায় না। চায় ধনিক শ্রেণীর কল্যাণ করতে। ফলে মোদী সরকার যা করছে তা ব্যর্থতা নয়। বরং সফলতা। অন্য কারণ হল কতকগুলি বিষয় বিজেপি তথা আরএসএস ও সংঘপরিবার এর দীর্ঘ দিনের কর্মসূচি। কৌশল হিসেবে কোনটাকে কখনো কখনো হিমায়িত রাখে বা কম গুরুত্ব দেয়।  বাবরি মসজিদ ধ্বংস করে তার জমিতে রামমন্দির নির্মাণ আন্দোলন শুধু মাত্র একটি মসজিদ-মন্দিরের সমস্যা নয়। হিন্দু-মুসলমানের সমস্যা নয়। সাম্প্রদায়িক সমস্যা নয়। ধর্মীয় সমস্যাও নয়। বাবরি মসজিদের জায়গায় রামমন্দির নির্মাণ একটি রাজনৈতিক কর্মসূচি।এ কথা বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ বলেছেন বার বার।  বাবরি মসজিদের জায়গায় রামমন্দির নির্মাণ আন্দোলন ভারতকে হিন্দুরাষ্ট্রে পরিণত করার আন্দোলনের অংশ। এই রায় একই সাথে দুটো কাজ করল। এক দিকে  হিন্দুরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলনকে এক ধাপ এগিয়ে দিল। অন্য দিকে ভারত রাষ্ট্রের বর্তমান মৌলিক কাঠামো ধ্বংসের পথকে প্রশস্ত করল। কারণ ভারতকে হিন্দুরাষ্ট্রে পরিণত করতে হলে বর্তমান মৌলিক কাঠামোকে ধ্বংস করেই করতে হবে। তাই বাবরি মসজিদের জায়গায় রামমন্দির নির্মাণ আন্দোলন আসলে বর্তমান ভারতরাষ্ট্রকে ধ্বংসের আন্দোলন। ফলে এ লড়াই হিন্দুরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা বনাম বর্তমান ভারত রাষ্ট্র রক্ষার লড়াই। যেমন ভারত রাষ্ট্রের বর্তমান কাঠামোকে রক্ষা করার দায়িত্ব শুধুমাত্র মুসলিমদের নয় তেমনি বাবরি মসজিদকে রক্ষার দায়িত্ব কেবলমাত্র মুসলিমদের নয়। ভারতকে রক্ষার দায়িত্ব যেমন বাবরি মসজিদের জায়গায় রামমন্দির নির্মাণ আন্দোলনের বিরোধী সবার তেমন বাবরি মসজিদ রক্ষার দায়িত্বও আরএসএস ও সংঘপরিবার বিরোধী সবার।
আধুনিক হিন্দুরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রথম স্বপ্ন দেখেছিল সাভারকার । ১৯২৩ সালে ” হিন্দুত্ব ” নামক নিবন্ধ লেখে হিন্দুরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কথা বলেছিল । সে নিবন্ধের শতবর্ষ পূরণ হবে তিন বছর পর ২০২৩ এ। ” হিন্দুত্ব” এ বলা হিন্দুরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আরএসএস তৈরি করা হয়েছে ১৯২৫ এ। তারও শতবর্ষ পূর্তি হবে পাঁচ বছর পর। হিন্দুরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলনকারীদের পরিকল্পনা ২০২৩ থেকে ২০২৫ এর মধ্যেই হিন্দুরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার বৃত্তকে সম্পন্ন করা। সে লক্ষ্যে পৌঁছানোর একটি ধাপ ছিল বাবরি মসজিদ ধ্বংস। সর্বোচ্চ আদালতের রায় সে পথেই আর একটি ধাপ।
আরএসএস , সংঘপরিবার ও বিজেপি এই কর্মসূচির কথা কখনও গোপন করেনি। এ তাদের ঘোষিত স্থায়ী কর্মসূচি। কিন্তু এর বিরুদ্ধে কেউ কোন আন্দোলন গড়ে তোলেননি। এমনকি মুসলিমরাও বিষয়টির প্রতি গুরুত্ব দেয়নি। ১৯৯২ সালে বাবরি মসজিদ ধ্বংসের আগে ১৯৮৯ সাল থেকেই রামমন্দিরের জন্য ইট পাথর সংগ্ৰহের কাজ শুরু করে। ধ্বংশের পর থেকেই মন্দির নির্মাণের পাথর কেটে দেওয়ার দেওয়াল গড়ার উপযুক্ত করার কাজ চলছে। বিরোধীরা এই কাজ বন্ধ করার জন্য দেশজুড়ে কোন গণআন্দোলন গড়ে তোলেনি। গত শতাব্দীর আটের দশক থেকেই ভিটি রাজশেকর হন্যে হয়ে মুসলিম ও দলিতদের দ্বারে দ্বারে ঘুরেছেন পরিস্থিতির ভয়াবহতা সম্পর্কে সচেতন হওয়ার জন্য। এক দিকে লেখেছেন, নেতাদের বাড়ি বাড়ি ঘুরেছেন। অন্য দিকে মুসলিম ও দলিতদের বড় বড় সভায় গিয়ে বক্তব্য রেখেছেন।  কেউ কথা কানে তোলেনি। তিনি বার বার তথ্য ও যুক্তি দিয়ে বুঝিয়েছেন ভারতে হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিস্ট শক্তি ইসরাইলের পরামর্শ ও সহযোগিতায় মুসলিম মুক্ত স্পেন গঠনের মডেল প্রয়োগ করছে। আমরা কেউ সতর্ক হয়নি। বাবরি মসজিদ রায়ের পর হা হুতাশ করলে চলবে?

বাবরি মসজিদ


হিন্দুরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা আন্দোলনকারীরা রাষ্ট্র ও সমাজের প্রতিটি স্তর ও কোণায় নিজেদের লোক ঢুকাতে সফল হয়েছে। এমনকি মুসলিম সমাজের মধ্যেও প্রবেশ করতে সফল হয়েছে। বিভিন্ন ব্যক্তি ও সংগঠনের নেতৃত্বকে প্রভাবিত করতে পেরেছে। সংগঠন গড়ে তুলেছে । যেমন অল ইন্ডিয়া ইমাম অর্গানাইজেশন, মুসলিম রাষ্ট্রীয় মঞ্চ, সদভাবনা প্রভৃতি। প্রথম দুটি আরএসএস পরিচালিত বলে সকলেই জানলেও সদভাবনা র বিষয়টি খুব স্পষ্ট নয়। গত কয়েক বছর ধরে কলকাতায় সদভাবনার হয়ে কাজ করেছেন এমন ব্যক্তি ও সংগঠন যারা নিজেরাই ইসলামিক বলে দাবি করে এবং অনেক মুসলিমও তাই মনে করেন। এ সবের ফলেই বাবরি মসজিদ রায় নিয়ে মুসলিমদের যে প্রতিক্রিয়া হওয়ার কথা ছিল তা দেখা গেল না। আশার কথা অনেক সুপ্রিম কোর্ট, হাইকোর্ট এর প্রাক্তন বিচারপতি, আইনজীবী, মানবাধিকার সংস্থা, সামাজিক সংগঠন ও রাজনৈতিক নেতৃত্ব দেশের বর্তমান মৌলিক কাঠামোকে রক্ষা করতে এগিয়ে আসছেন।
হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিস্টদের তিনটি প্রধান কর্মসূচি ছিল। সংবিধানের ৩৭০ ধারা বাতিল, বাবরি মসজিদের জায়গায় রামমন্দির নির্মাণ, অভিন্ন দেওয়ানি আচরণ বিধি। ইতিমধ্যেই দুটি সম্পূর্ণ করেছে। এবার অভিন্ন দেওয়ানি আইন তৈরির পালা। তারপর আসবে কাশী, মথুরা ইত্যাদি। ৩৭০ ধারা বাতিল এবং বাবরি মসজিদের জায়গায় রামমন্দির নির্মাণ এর ক্ষেত্রে বিরোধীরা যে ভূমিকা পালন করল তা যদি অব্যাহত রাখে তা হলে অভিন্ন দেওয়ানি বিধিকে আটকানো যাবে না। আমরা কি ঐক্যবদ্ধ হয়ে রুখে দাঁড়াব , না কি এ ভাবেই চলব ?

মতামত লেখকের নিজস্ব।

Back To Top