৩০০০ কোটি টাকার মূর্তি ও দুর্ভোগ

~প্রশান্ত রায়

পৃথিবীর সর্ব্বোচ স্ট্যাচু বসাতে কয়েক লাখ আদিবাসী ভুমিপুত্রদের সর্বস্য কেড়ে নেওয়া হলো। তবুও গোটা দেশের মানুষ নীরব, প্রতিবাদহীন—

যারা গুজরাটকে দেশের উন্নত রাজ্য ও শিল্প সমৃদ্ধ রাজ্য বলে ফাঁপা বুলি আওড়ান, তারা কি জানেন যে গুজরাটে আদিবাসী ভূমিপুত্রের অবস্থান কোথায়? তাঁদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও উন্নয়ণের হার কী ? 2017 সালের মার্চ মাসের কেন্দ্রীয় গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রক ও সমাজ কল্যান বিভাগের একটি রিপোর্টে জানা যায় যে, “আদিবাসীদের উন্নয়নে দেশের সবচেয়ে পিছিয়ে পড়া পাঁচটি রাজ্যের মধ্যে গুজরাট অন্যতম ” (27/03/2017 – Times of India-য় প্রকাশিত রিপোর্ট)। এই রাজ্যের একটি চূড়ান্ত অনুন্নত আদিবাসী অধ্যুষিত জেলার নাম “নর্মদা”, যেখানে 3 হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে গড়ে উঠেছে পৃথিবীর সর্ব্বোচ স্ট্যাচু। অথচ এই অঞ্চলের প্রায় পাঁচ লাখ মানুষের একটি প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্র নেই, একটি ইউনিভার্সিটি নেই, কলেজ নেই(কেন্দ্রীয় আদিবাসী উন্নয়ন পর্ষদের রিপোর্ট — 2017)। এই মূর্তি নির্মানের ফলে ঐ অঞ্চলের আদিবাসীদের যে মর্মান্তিক বঞ্চনা ও অনাহার দারিদ্র্যতার মুখে ঠেলে দেওয়া হয়েছে তার করুন চিত্র তুলে ধরা হলো —

গুজরাটের নর্মদা জেলার নর্মদা নদীর তীরবর্তী আদিবাসী অধ্যুষিত অঞ্চলে নির্মান করা হলো পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচু 182 মিটারের সর্দার বল্লভ ভাই প্যাটেলের মৃর্তি, বিশাল পার্ক ও কৃত্রিম লেক। এই নর্মদার তীরে গাছপালা ঘেরা শান্ত সুনির্মল পরিবেশে কয়েক লাখ আদিবাসী বসবাস করেন। নর্মদার তীরবর্তী এই অঞ্চল গুলিতে জমির উর্বরতা খুবই ভালো। পরিশ্রমী আদিবাসী জাতি এই উর্বর জমিতে সোনার ফসল ফলায়। ফলে আর্থিক ভাবে সচ্ছল এই অঞ্চলের আদিবাসীরা। এভাবে সুখে-শান্তিতে দিন কাটছিলো তাঁদের। কিন্তু বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো হঠাৎ তাঁদের কাছে খবর এলো যে, এই অঞ্চলে মূর্তি বসানো হবে, বড়ো পার্ক তৈরী করা হবে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই শুরু হয়ে যায় জোর করে জমি অধিগ্রহণ। 2013 সালে গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন এই মূর্তির ভিত্তি প্রস্তর করেছিলেন নরেন্দ্র মোদি। 2014 সালের 31-শে অক্টোবর এই মূর্তি তৈরির কাজ শুরু হয়।আদিবাসীদের কাছ থেকে জোর করে জমি অধিগ্রহণের প্রথম দিন থেকেই এই অঞ্চলের কয়েক লাখ মানুষ এর বিরোধিতা করে আসছেন এবং তাঁদর ন্যায্য দাবিদাওয়া গুলো সরকারের কাছে তুলে ধরেছিলেন। 74 টি গ্রামের পঞ্চায়েত প্রধানেরা প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি দেন। এছাড়া একাধিক আদিবাসী সংগঠন তাদের অভিযোগ জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রপতি, গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রীকে একাধিক বার চিঠি দেন। কিন্তু কোনো নেতা-মন্ত্রী এই অসহায় মানুষ গুলির কথায় কর্ণপাত করেন নি। সরকার প্রথম দিকে তাঁদের সমস্ত দাবি মেনে নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিলেও অবশেষে সরল প্রান আদিবাসীদের জমি অধিগ্রহণের পর সমস্ত প্রতিশ্রুতির কথা সরকার ভুলে যায়। নির্বিচারে বড় বড় কাছ কেটে 30 হাজার বর্গমিটার জুড়ে তৈরি হয় এই পার্ক। 18 বর্গ কিমি জায়গা জুড়ে একটি কৃত্রিম লেক বা সরোবর তৈরি করা হয়েছে, যা এই মূর্তিকে চারদিক থেকে ঘিরে রেখেছে। এই কৃত্রিম লেক তৈরি করতে নর্মদা নদীর উপর কৃত্রিম বাঁধ দেওয়া হয়েছে। মূর্তির কাছে প্রত্যেক রাজ্যকে তাদের অতিথিশালা বা ভবন তৈরির জন্য জমিও দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে গুজরাট সরকার — যার জন্যে কয়েকশো একর জায়গা বরাদ্দ রেখেছে। মোটামুটি কথা এখানে শুধু মাত্র বিশ্বের সর্ব্বোচ মূর্তিই বসানো হলো না, এটিকে একটি আধুনিক ও বিলাসবহুল, প্রমোদপূর্ণ ঝকঝকে শহর হিসেবেও গড়ে তোলা হয়েছে — যে শহরে বাবুরা ছুটি কাটাতে যাবেন আর আনন্দ ফূর্তিতে ঢুবে থাকবেন। কিন্তু কেউ জানবে না যে কাদের বুকের উপর গড়ে তোলা হয়েছে এই শহর, কাদের নিঃস্ব-রিক্ত করে, চরম বঞ্চিত করে গড়ে উঠেছে এই ইমারত — ইতিহাসেও তাঁদের নাম লেখা থাকবে না। তাঁরাতো চির বঞ্চিত অভাগা জাতি, তাঁরাতো আদিবাসী। এই ক্ষমতালিপ্সু শাসক শ্রেনীর কাছে আদিবাসীরা আবার মানুষ নাকি ? তাঁদের দুঃখ-যন্ত্রনা, ব্যাথা-বেদনা ও বঞ্চনায় তথাকথিত সভ্য সমাজের কিছু যায় আসে ?

31 অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এই মূর্তি ও পার্ক উদ্বোধন করেন। ঐদিন সাতপুরা, ধরমপুর, কাপারদা, চিখাল, বনসদা, রাঙ্গুভার, ভারুচ, সোনগা, রাজপিপলা ইত্যাদি অঞ্চলের কয়েক লাখ আদিবাসী বিক্ষোভে ফেটে পড়েন, মূর্তি উদ্বোধন অনুষ্ঠান বয়কটের ডাক দেন। একদিকে মূর্তি উদ্বোধন করছেন মোদি, অন্যদিকে ঐ অঞ্চলের 117 টি গ্রামের আদিবাসীরা “অরন্ধন পালন” করেন। হাজার হাজার আদিবাসী রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ দেখিয়েছেন, কালো বেলুন উড়িয়েছেন। অনেকগুলো আদিবাসী সংগঠন এই বিক্ষোভে সামিল হয়েছে। বিক্ষোভকারীদের দমন করতে নর্মদা ও লাগোয়া একাধিক জেলায় বিশাল পুলিশবাহিনী মোতায়েন করা হয়েছিল। আদিবাসী নেতা প্রফুল্ল বাসব সহ 300 আদিবাসীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। জেলের মধ্যে এখনো পর্যন্ত তাঁদের উপর অকথ্য অত্যাচার ও নিপীড়ন চালানো হচ্ছে। ভারুচের স্থানীয় পঞ্চায়েত প্রধান বাহাদুর ভাসাভাও চোখের জলে বুক ভাসিয়ে বলেন –“বল্লভভাই প্যাটেলের মূর্তি বানিয়ে আদিবাসীদের কবর খোঁড়া হয়েছে।” এই আন্দোলনের নেতা প্রফুল্ল বাসব বলেন–“এই বিক্ষোভ প্রমান করে রাজ্যের ক্ষমতাসীন বিজেপি সরকারের উপর কতটা বিক্ষুদ্ধ হয়ে রয়েছে সমগ্র আদিবাসী সমাজ। এই মূর্তি নির্মানের ফলে কয়েল লাখ আদিবাসীকে মৃত্যুর মুখে দাঁড় করিয়ে দেওয়া হলো। আদিবাসীদের প্রতি এতোবড় বঞ্চনা ইতিহাসে বিরল।”

যে সকল কারনে আদিবাসীরা এই মূর্তি ও পার্ক নির্মানের বিরোধিতা করেছেন তা অতি সংক্ষেপে তুলে ধরা হলো —
(1) প্রায় 20 হাজার আদিবাসীকে তাঁদের ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ করে বাস্তুহারা করা হয়েছে। এখনো পর্যন্ত মাত্র 10% মানুষকে পুনর্বাসন দেওয়া হয়েছে অত্যন্ত অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে।
(2) প্রায় 75 হাজার আদিবাসীর উর্বর চাষের জমি কেড়ে নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে মাত্র 12% মানুষকে জমি দেওয়া হয়েছে — যা অত্যন্ত অনুর্বর এবং চাষাবাদের একেবারেই অনুপযুক্ত। 
(3) ঐ সুবিশাল আদিবাসী অঞ্চলের চাষাবাদ, কৃষিকাজ সম্পূর্ণ ভাবে নির্ভর করে নর্মদা নদীর জলের উপর। কিন্তু আশ্চর্য ঘটনা হলো, বল্লভভাই প্যাটেলের মূর্তিকে কেন্দ্র করে ঐ অঞ্চলে এক বিরাট কৃত্রিম লেক ও বিলাসবহুল পর্যটন কেন্দ্র গড়ে তোলা হয়েছে নর্মদা নদীর উপর বাঁধ নির্মান করে। ফলে ঐ অঞ্চলের চাষের জমির কথা না ভেবে নর্মদা নদীর জলকে এখন কৃত্রিম লেক এবং পর্যটন কেন্দ্রের জন্যে ব্যবহার করা হচ্ছে। নর্মদা নদীর উপর এই বাঁধ নির্মানের ফলে কয়েকশো গ্রামের চাষীদের জলের অভাবে চাষাবাদ প্রায় বন্ধের মুখে। কৃষিকাজ হারিয়ে তাঁরা এখন অনাহারে মৃত্যুর প্রহর গুনছে।
(4) অরন্যের অধিকার আদিবাসীদের সাংবিধানিক অধিকার। কিন্তু বিশাল মূর্তি নির্মান এবং তাকে কেন্দ্র করে পার্ক তৈরি, কৃত্রিম লেক তৈরি, নদীর উপর বাঁধ নির্মান ইত্যাদির ফলে ঐ অঞ্চলে নির্বিচারে ধ্বংস করা হয়েছে বিরাট বনভূমি ও প্রাকৃতিক সম্পদকে। ফলে কেড়ে নেওয়া হয়েছে আদিবাসীদের অরন্যের অধিকার, বনজ সম্পদের উপর নির্ভরশীল জীবন-জীবিকা, রুটিরুজির অধিকার। এই বনভূমির উপর নির্ভরশীল ছিলেন কয়েক হাজার আদিবাসী ভূমিপুত্ররা। এখন সেখানে বনভূমির পরিবর্তে গড়ে উঠেছে বিলাসবহুল “তাঁবুর শহর”। এইসব আরো অনেক কারন রয়েছে যার কারনে সমগ্র নর্মদা জেলা জুড়ে বনধ-অবরোধের ডাক দিয়েছিলেন ভূমিপুত্ররা, প্রতিবাদ-প্রতিরোধে রাস্তায় নেমেছেন। এই সুসংগঠিত আন্দোলনে নেতৃত্ব দিচ্ছেন একাধিক আদিবাসী সংগঠনের শিক্ষিত যুবক যুবতীরা। এই সংগ্রাম তাঁদের জীবন মরনের সংগ্রাম, রুটিরুজির সংগ্রাম। এখন এই আন্দোলন শুধু নর্মদা জেলায় সীমাবদ্ধ নেই, গুজরাট সহ মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান, উত্তরপ্রদেশ ইত্যাদি যেখানে যত আদিবাসী গ্রাম রয়েছে সেখানেও ছড়িয়ে গিয়েছে। সঙ্গে যোগ দিয়েছেন S.C. -রা, কোথাও কোথাও O.B.C-রাও।

বাবা সাহেব ডঃ বি. আর. আম্বেদকর সংবিধানের ” পঞ্চম তফসিলে”র 2-এর (ক) (খ) (গ) নং ধারায় পরিস্কার ভাবে লিপিবদ্ধ করে গিয়েছেন যে –“আদিবাসীদের ভূমি কেউ হস্তান্তর (ক্রয়-বিক্রয়) করতে পারবে না, শিল্প-কলকারখানা, পার্ক, উদ্দ্যানের নামেও অধিগ্রহণ করা যাবে না। এমন কি রাষ্ট্রের উন্নয়নশীল কাজের নাম করে আদিবাসীদের জমি কেড়ে নেওয়া যাবে না”(পঞ্চম তফসিল, 2-এর (খ) নং ধারা)। 2-এর (ক) নং ধারায় বলা হয়েছে –“অরন্য ও অরন্যজাত প্রাকৃতিক সম্পদের অধিকার আদিবাসীদের মৌলিক অধিকার। এই অধিকার থেকে তাঁদের কোনো রূপ বঞ্চিত করা যাবে না। কেউ বঞ্চিত করতে চাইলে রাষ্ট্র তাঁদের এই অধিকারকে সুরক্ষা করবে।” অথচ অদ্ভুত ব্যাপার হলো, রাষ্ট্র তাঁদের সুরক্ষা দেওয়ার পরিবর্তে নিজেই কেড়ে নিচ্ছে সংবিধানকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে। এটা শুধুমাত্র গুজরাটের ঘটনা নয়, সারা ভারতবর্ষ জুড়ে আদিবাসীদের জমি জোর করে কেড়ে নেওয়া হচ্ছে, অরন্যের অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। ডঃ আম্বেদকর তাঁর দূরদৃষ্টিতে দেখতে পেয়েছিলেন যে, ভবিষ্যতে আদিবাসীদের ঠেকিয়ে জমি কেড়ে নেওয়া হবে, তাই তিনি সংবিধানে এই অধিকার লিপিবদ্ধ করে গিয়েছিলেন। কিন্ত দুঃখের বিষয় যে তারপরও আদিবাসীদের প্রতি এই বঞ্চনা বন্ধ করা যাচ্ছে না।

সবচেয়ে দুঃখ ও যন্ত্রনার কথা হলো, গুজরাটে আদিবাসী ভূমিপুত্রদের উপর রাষ্ট্রীয় শোষণ, বঞ্চনা ও সন্ত্রাস নামিয়ে আনা হলো, অথচ তথাকথিত ভদ্রসমাজ ও বুদ্ধিজীবি শ্রেনী একেবারেই নীরব। এতবড় অন্যায়ের বিরুদ্ধে এরা কেউই এতোটুকু প্রতিবাদ করেনি, পথে নামেনি। বর্ণবাদী মিডিয়া গুলোও একটা শব্দ উচ্চারণ করেনি। নরেন্দ্র মোদির মাথার একটা চুলও যদি বাতাসে নড়ে তাহলেও রাহুল গান্ধী প্রতিবাদে দেশকে উত্তাল করে দেন, অথচ তিনি এব্যাপারে একটা শব্দও ব্যয় করেননি। কৃষকদরদি বামফ্রন্ট কৃষকদের জন্য কথায় কথায় রাজপথে নামে, এব্যাপারে তারাও নীরব। আর সিঙ্গুর, নন্দীগ্রামের কৃষিজমি রক্ষা আন্দোলন করে যিনি বাংলার রাজক্ষমতা দখল করেছেন , সেই মমতা ব্যানার্জীকেও সামান্যতম প্রতিবাদ করতে দেখলাম না। কারন কী ? এরা আদিবাসী বলে ? তাহলে আদিবাসীদের প্রতি অন্যায়, অবিচার, অত্যাচার, শোষণ, বঞ্চনায় এই সকল উচ্চবর্ণীয় দলগুলি ও নেতানেতৃর কিছু যায় আসে না ? হে মহান ভারত, আজও জাতপাত, বর্ণবৈষম্যের ভেদাভেদ ? ভারতের আদিবাসী, দলিত, বহুজনদের অধিকার নিজেরা যদি রক্ষা ও দখল করতে না পারে তাহলে কেউ তাঁদের বাঁচাতে এগিয়ে আসবে না — এই চরম সত্য কথাটি তাঁরা যতদিন না বুঝতে পারবে, ততোদিন তাদের মুক্তি নেই। তবে খুবই আশার সংবাদ, সারা ভারতের দলিত, বহুজন, আদিবাসী-ভূমিপুত্ররা একজোট হয়ে প্রতিবাদ শুরু করেছেন — যা আগামীদিনে গণসংগ্রামে পরিনত হবে বলে বিশ্বাস।।

Back To Top