স্যার সৈয়দ আমীর আলিঃ এশিয়ার পণ্ডিত ব্যক্তিত্ব

স্যার সৈয়দ আমীর আলি

~মোহম্মদ সাদউদ্দিন~

কলকাতা শহরের পার্কসার্কাস এলাকায় এক বিখ্যাত রাস্তার নাম  ‘সৈয়দ আমির আলী এভিনিউ’। পার্কসার্কাস সাতমাথা মোড়ের দক্ষিণ থেকে রাস্তার শুরু বালিগঞ্জ ফাঁড়ি পর্যন্ত রাস্তাটি প্রায় ২ কিমি দীর্ঘ। পার্কসার্কাস এলাকা দিয়ে যাওয়ার সময় রাস্তার নামের সুবাদে সৈয়দ আমির আলী নামের সঙ্গে পথচারীরা পরিচিত হন ঠিকই। কিন্তু কে এই আমির আলী, কী বা তার ইতিহাস এগুলি কি নতুন প্রজন্ম জানে? এশিয়া, ইউরোপ মহাদেশ জুড়ে আমির আলী একজন পণ্ডিত ব্যক্তি হিসাবে এক সময় খুবই জনপ্রিয় ছিলেন। অথচ তার সম্পর্কে আমরা অনেক কিছুই জানি না। আসুন আমরা তার সম্পর্কে জানার চেস্টা করি।

        ১৮৪৯ সালের ৬ এপ্রিল হুগলীর চুঁচুড়াতে (বর্তমানে এটি হুগলীর সদর শহর) সৈয়দ আমির আলী জন্ম গ্রহণ করেন। বাবার নাম সৈয়দ সাদাত আলী, উড়িশার কারজের একজন বিখ্যাত হেকিম চিকিৎসক ছিলেন। প্রকৃত পক্ষে সাদাত আলী ছিলেন উত্তর প্রদেশের অযোধ্যা উন্নাও অঞ্চলের বাসিন্দা, তাদের আর্থিক অবস্থা খুব ভালো ছিল না। তাই আর্থিক দৈন্যতার মধ্য দিয়েই আমির আলীকে লেখাপড়া শিখতে হয়। হুগলী জেলা স্কুল থেকে ১৮৬৫ সালে এন্ট্রান্স পাস করেন। প্রথম ১০জনের মধ্যে আমির আলির স্থান প্রথম হয়েছিলেন। সাহিত্যিক অক্ষয় কুমার সরকার অক্ষয় বাবু ছিলেন একজন আমির প্রিয় সহপাঠী। প্রথম শ্রেণির বৃত্তি লাভ করে ভর্তি হন হুগলী কলেজে। ১৮৫৭ সালে এই কলেজে ইতিহাসে বি.এ পাস করেন। ১৮৬৮ সালে ইতিহাসে কৃতিত্বের সঙ্গে এম.এ পাস করেন। এক্ষেত্রে তিনিই প্রথম বাঙালি মুসলমান। ১৮৬৯ বি.এল পাস করে স্টেট স্কলারশিপ নিয়ে বিলেতে যান। ৪ বছর পর ১৮৭৩ সালে বিলাত থেকে ব্যারিস্টার হয়ে দেশে ফিরেন এবং ঐ বছরই কলকাতা হাইকোর্টের আইনজীবী হিসাবে প্রবেশ করেন। ১৮৭৪ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ‘ফেলো’ এবং ১৮৮৪ সালে ‘টেগোর আইন’ অধ্যাপক হন। ১৮৭৫-৭৯ সাল পর্যন্ত প্রেসিডেন্সী কলেজের ‘মুসলিম  আইনের অধ্যাপক হন। ১৮৬৪ এবং ১৮৭৩-৮৩ সাল পর্যন্ত বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক সভার সদস্য ছিলেন। ১৮৯০-১৯০৪ সাল পর্যন্ত কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি পদে ছিলেন। এক্ষেত্রেও তিনি প্রথম মুসলিম। ১৯০৪ বিচারপতি থেকে অবসর গ্রহণ করে সস্ত্রীক বিলাতে যান এবং সেখানে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। ১৯০৯ সালে তিনি লন্ডনে প্রিভি কাউন্সিলের সদস্য হন।এক্ষেত্রে তিনি প্রথম ভারতীয়। এখানে আরও উল্লেখ্য, বিলাত যাওয়ার আগে ১৮৬৪ সালে তিনি ‘খান বাহাদুর’ হন। ১৮৭৫ সালে ‘নবাব’ ও ১৮৮৭ সালে ‘সি আই ই’ উপাধি পান।

        সৈয়দ আমির আলী বিভিন্ন সামাজিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। আবার কিছু কিছু প্রতিষ্ঠানের, তিনিই ছিলেন প্রতিষ্ঠাতা। ১৮৭৮ সালেই তিনি গড়ে তোলেন ‘সেন্ট্রাল ন্যাশনাল মহামেডান অ্যাসোসিয়েশান’। সমাজ, শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক প্রসারতার জন্যই তিনি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেন। বিশেষ করে মুসলিম তরুণ সমাজের মধ্যে সামাজিক কাজকর্ম, শিক্ষার প্রসার ও পাশাপাশি সাংস্কৃতিক চেতনা বিকাশের জন্য এই অ্যাসোসিয়েশান স্থাপন করেন.১৮৭৪ সালে কলকাতার এশিয়াটিক সোসাইটির সদস্য হন। হুগলীর ইমামবাড়ার সভাপতি হন ১৮৬৪ সালে মাত্র ১৫ বছর বয়সে। ১৯০৪ সাল পর্যন্ত ওই পদে ছিলেন। মহসিন ফান্ডের প্রথম বৃত্তি প্রাপক ছিলেন সৈয়দ আমির আলী। মুসলিম সমাজই শুধু নয় সার্বিক বিস্তারের ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন দানবীর হাজী মহম্মদ মহসিনের অনুসারী। তাই সেন্ট্রাল মহামেডান অ্যাসোসিয়েশান প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক হিসাবে (১৮৭৮-৯০) সৈয়দ আমির আলী সামাজিক ও রাজনৈতিক কার্যকলাপ ছিল বিশাল। এই বিশাল কার্যকলাপ ছিল ঐতিহাসিক ভাবে গুরুত্বপূর্ণ। ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে তিনি সেই সময় অ্যাসোসিয়েশানের শাখাও স্থাপন করেন। অপর সম্প্রদায়ের প্রতি ঈর্ষাকাতর না হয়ে পোড়খাওয়া মুসলিম সমাজকে শিক্ষায় উন্নতি ঘটাতে সৈয়দ আমির আলী আজীবন সংগ্রাম করেছেন। আবার সরকারের সঙ্গে রাজনৈতিক দ্বন্দ্বে উত্তীর্ণ না হয়ে সব সমাজেরই  আর্থিক বিষয়ও মানবিক উন্নতির জন্য ইংরেজি শিক্ষা বিস্তারে আমির আলী বিশেষভাবে সচেষ্ট হন । আবার পিছিয়ে পড়া মুসলিম সমাজের সরকারী চাকুরিতে প্রতিনিধিত্ব বাড়াতেও বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। ব্রিটিশ সরকারের কাছে এব্যপারে ১৮৮৪ সালের ১০ই মার্চ স্মারকপত্রও দেন। আসলে আমির আলী ছিলেন আপোস-প্রবক্তা। সারা ভারতে স্যার সৈয়দ আহমেদ খানের নেতৃত্বে আলিগড় আন্দোলন , পরবর্তীতে নবাব আব্দুল লতিফের নেতৃত্বে বাংলায় মুসলিম সমাজের মধ্যে সেই আন্দোলনের প্রভাব বিস্তার করে। সৈয়দ আমির আলী ওদের পথকে অবলম্বন করেছিলেন ঠিকই, কিন্তু তিনি চেয়েছিলেন শিক্ষার পাশাপাশি রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সচেতন হোক সচেতন মুসলিম সমাজ।

        সৈয়দ আমির আলী সংকীর্ণ দৃষ্টি ভঙ্গির ঊদ্ধে ছিলেন। কংগ্রেসে যোগদান না করতে ১৮৮৫ সালে কলকাতায় জাতীয় কংগ্রেসের প্রথম অধিবেশনকে সফল করতে উমেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়কে পূর্ণ সহযোগিতা করেন। ঘরে তিনি কংগ্রেসের হিন্দু নেতৃত্বের সংকীর্ণ মনোভাবকে মেনে নিতে পারেননি বলেই ১৯০৬ সালে মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠিত হলে তিনি লীগের রাজনৈতিক ও মতাদর্শ সমর্থন করেন। লন্ডনে লীগের শাখাও তৈরি করেন।       

        একজন পণ্ডিত, যুক্তিবাদী ও তথ্যভিত্তিক লেখক হিসাবে তার সুনাম ছিল যথেষ্ট। ঊনবিংশ শতাব্দীতে যখন শ্রেণি হিন্দু লেখক সাহিত্য ও ইতিহাসের পাতায় হিন্দু জাতিয়তাবাদকে প্রতিষ্ঠা করার নিরলস চেষ্টায় মগ্ন ঠিক তখন সেমিটিক জাতি গোষ্ঠীর ধর্ম হিসাবে ইসলামকে তিনি বৈজ্ঞানিক, ঐতিহাসিক ও যুক্তিবাদী দর্শন হিসাবে তুলে ধরেন। তাই ইসলামের বীরত্বপূর্ণ ইতিহাস , সাধারণ ও অনাড়ম্বর জীবন ব্যবস্থা, দর্শন, সাম্যনীতিকে ব্যাখ্যা করে বেশ কয়েকটি গ্রন্থ রচনা করে তিনি উনবিংশ শতকেই ভারত ও ভারতের বাইরে বিশাল আলড়ন সৃষ্টি করেন। তথ্যপূর্ণ ও যুক্তিশীল রচনার দ্বারা ইসলাম নিয়ে হিন্দু ও খ্রিস্টান জগতের অনেকের বিভ্রান্তিকে তিনি দূর করেন। তার উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ গুলি হল, ‘এ ক্রিটিকেল একজামিনেসন অব লাইফ অ্যান্ড টিচিং অফ মহম্মদ’, (এডেনবারগ), (১৮৭৩), ‘পার্সোনাল ল’ অব দি মহামেডান’ ( লন্ডন ১৮৮০), ‘মহামেডান ল’ ( টেগোর লেকচারস) কলকাতা, (১৮৮৪), ‘স্পিরিট অব ইসলাম’ ( লন্ডন ১৮৮১), ,লিগ্যাল স্ট্যাটাস অব উইমেন ইন ইসলাম,( লন্দন,১৮৯৯), ‘এ সর্ট স্টোরি অব সারাসিনস’ (লন্ডন,১৮৯৮), ‘ক্রিস্টিয়ানিটি ফ্রম দি ইসলাম স্টান্ড পয়েন্ট, (লন্ডন, ১৯০৬), ‘ইসলাম’(লন্ডন, ১৯০৬)। এই গ্রন্থ গুলি সবই ইংরেজিতে লেখা। ইংরেজিতে লেখা সময়কালীন সমস্যা ভিত্তিক কিছু আইন গ্রন্থও আছে। সেগুলি হল, কমেন্টারী অব দি ইন্ডিয়ান এভিডেন্স অয়াক্ট’(১৮৯৮), ‘কমেন্টারি অব দি বেঙ্গল ( টনান্সি অ্যাক্ট’ ১৯০৪), কমেন্টারি অব সিভিল প্রসিডিয়র কড,(১৯০৪), প্রভৃতি। ‘আইন উল হিদায়া’ নামে হানফি আইনের একটি উর্দু গ্রন্থও লেখে যান। আত্মজীবনমূলক গ্রন্থ হিসাবে ‘মেময়ার্স’ (১৯৩১-৩২), খুবই উল্লেখযোগ্য। আরও একটি উল্লেখ্য গ্রন্থ ‘জিহাদ’ জিহাদ কেন? জিহাদ কি? এই হল জিহাদ গ্রন্থের মর্ম কথা,  তবে সৈয়দ আমির আলীর শ্রেষ্ঠ রচনা “ স্পিরিট অব ইসলাম” ইসলামের ঐতিহাসিক অবদান, ইসলামী দর্শন, বিধিবিধান কেন মানুষের জীবনের প্রয়োজন, কীভাবে ইসলাম মানুষের গ্রহণযোগ্য হল, মুলত তার যুক্তিনিষ্ঠ ঐতিহাসিক ব্যাখ্যা হল গ্রন্থের প্রধান উপজীব্য বিষয়! ১৯২৮ সালে সৈয়দ আমির আলীর জীবনাবসান হয়।

Back To Top