বসফোরাসকে পাশ কাটাতে এরদোগানের ইস্তানবুল ক্যানাল প্রজেক্ট: তুরস্কের জন্য হতে পারে “গেম চেঞ্জার”

সাইফুল্লা লস্কর : ইউরোপ ও এশিয়া দুই মহাদেশকে বিভাজিত করা তুরস্কের পূর্ববর্তী রাজধানী ইস্তানবুলের বুক চিরে চলে গিয়েছে বিশ্বে সামুদ্রিক যাতায়াতের জন্য অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পথ বসফরাস প্রণালী বা ইস্তানবুল প্রণালী। প্রতি বছর ৫০,০০০ এরও বেশি জাহাজ যাতায়াত করলেও তুরস্ক অর্থনৈতিকভাবে আদৌ উপকৃত হয় না তা থেকে। পানামা ক্যানালের মতো তুরস্কও এই প্রণালী থেকে যাতায়াত করা জাহাজগুলো থেকে কর সংগ্রহ করতে পারলে তাদের অর্থনীতিতে প্রতি বছর যুক্ত হতো অন্তত ৪ থেকে ৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। তুরস্কের অর্থনীতির অগ্রগতির জন্য এই পরিমাণ অতিরিক্ত অর্থ ব্যাপকভাবে সহায়ক হতো তা বলাই বাহুল্য। কিন্তু অতীত চুক্তিগুলোর জন্য সে অর্থ তুরস্কের হাতে আসেনা।
এমতাবস্থায় অতীত চুক্তি গুলো মান্য করে এবং আন্তর্জাতিক বিশ্বে নিজেদের ভাবমূর্তি স্বচ্ছ রেখে তুরস্ক নিজস্বার্থে বসফোরাসের সমান্তরালে নির্মাণ করতে যাচ্ছে ইস্তানবুল ক্যানাল। অনেকের মতে ভবিষ্যৎ বিশ্বে ইস্তানবুল ক্যানাল ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপট নির্ধারণে অতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে এবং এটি বিশ্বের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ সামুদ্রিক রাস্তা হয়ে উঠবে।

গত এক দশকে পরিকাঠামোগত উন্নয়নের দিক থেকে বিশ্বে তুরস্কের মোকাবিলায় চীন ছাড়া আর কেউ নেই। হাই স্পীড রেল করিডোর থেকে সুবিশাল ইস্তানবুল বিমানবন্দর, ইস্তানবুল টানেল থেকে তুরস্কের সুদীর্ঘ গ্যাস পাইপলাইন, এরদোগানের হাত ধরে গত এক দশকে বহু মেগা প্রজেক্ট হাতে নিয়েছে তুরস্ক। তাতে নব সংযোজন ভিশন ২০২৩ এর অধীন শুরু হতে যাওয়া তাদের এ যাবৎ কালের সর্ববৃহৎ প্রজেক্ট ক্যানাল ইস্তানবুল।

প্রেজেক্ট ক্যানাল ইস্তানবুল  :

ব্ল্যাক সী বা কৃষ্ণ সাগরের উপকূলবর্তী দেশগুলোর জন্য সারা বিশ্বের বাকি অংশের সঙ্গে সামুদ্রিক যোগাযোগ রক্ষার্থে বসফরাস একমাত্র এবং অতি গুরুত্বপূর্ণ পথ। তাই সেই ওসমানী শাসনকাল থেকেই এর বিকল্প একটি পথ অনুসন্ধান করা হচ্ছে।অতীতে বহুবার অনেক পরিকল্পনা করা হলেও তা কখনোই বাস্তবতার মুখ দর্শন করেনি। তবে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বর্তমান তুরস্কে প্রকৃত গনতন্ত্রের প্রতিষ্ঠাতা এবং ইসলামের পতাকাবাহী বহু সংস্কারের রূপকার এবং তুর্কি অর্থনীতির পুনরুজ্জীবনের কান্ডারী রিসেপ তাইয়্যেপ এরদোগান প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর এই প্রকল্পের বাস্তবায়নের করার ঘোষণা করেন ২০১১ সালে। এটিকে তখন তিনি আখ্যা দেন “উন্মাদ প্রকল্প” বা “ক্রেজি প্রজেক্ট” বলে।  তুরস্কের বিরোধী দলগুলোর বেশিরভাগ এই প্রকল্পের বিরোধিতা করায় প্রকল্প রূপায়ণে অনেক বাধা বিপত্তির সম্মুখীন হতে হয় সরকারকে। সংবাদ সংস্থা অনাদোলু এজেন্সি জানিয়েছে সরকার এই প্রকল্প ২০২৩ এর মধ্যে সম্পন্ন করার পরিকল্পনা করছে।

বসফোরাসের সমস্যা এবং ইস্তানবুল ক্যানালের প্রয়োজন :

রাশিয়া, ইউক্রেন, রোমানিয়া, জর্জিয়া সহ কৃষ্ণ সাগরের উপকূলবর্তী দেশগুলোর জন্য ভূমধ্যসাগরে পৌঁছানোর জন্য বসফোরাস একমাত্র সামুদ্রিক পথ হওয়ায় এখানে জাহাজের আনাগোনা বিপদজনক ভাবে বেশি। উইকিপিডিয়া এবং TRT এর তথ্যমতে গড়ে প্রতিদিন ১৫০ টি সামুদ্রিক জাহাজ এই প্রণালী অতিক্রম করে। বিশ্বের মোট খাদ্যশস্য আমদানি ও রপ্তানির ২৫ শতাংশ এই প্রণালী থেকেই হয়। এই প্রণালীর ওপর থেকে প্রতিদিন যাতায়াত করে প্রায় ৩ মিলিয়ন ব্যারেল অপরিশোধিত খনিজ তেল। রাশিয়ার বেশিরভাগ খনিজ তেল রপ্তানির প্রধান পথ এটাই। বিশ্বের অন্যতম ব্যস্ততম এই প্রণালিটি অতিক্রম করতে অনেক জাহাজকে দিনের পর দিন অপেক্ষা করতে হয় যার ফলে প্রতি বছর আনুমানিক ১.৭ বিলিয়ন ডলার বানিজ্যিক ক্ষতি হয় সংশ্লিষ্ঠ দেশ বা সংস্থা গুলোর।

আবার ৩০ কিমি দীর্ঘ প্রণালীতে আছে অন্তত ১২ টি বাঁক, আছে উত্তর থেকে দক্ষিণ মুখী তীব্র জলস্রোত। এটি কোথাও কোথাও এত সংকীর্ণ যে তা মাত্র ৭৫০ মিটার চওড়া যা বৃহদাকার তেলবাহী ট্যাংকার গুলোর যাতায়াতের জন্য খুবই বিপদজনক। ইস্তানবুলের ভ্রমণার্থী দের জন্য বসফরাস একটা বড়ো আকর্ষণ এবং মৎস্য আহরণের জন্যও অতীব গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র হিসেবে বিখ্যাত এটি। অন্যদিকে এর ওপর দিয়ে তৈরি হয়েছে তিনটি সাসপেনশন ব্রিজ। এর নিচে থেকে গিয়েছে দুটি টানেল। প্রণালীটির দুই পাশে আছে অসংখ্য ঐতিহাসিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ ভবন এবং অন্যান্য স্থাপত্য। যার ফলে অতি ব্যাস্ত প্রণালীতে দুর্ঘটনা খুব স্বাভাবিক বিষয় এবং ব্যাপক ক্ষতির আশঙ্কা সর্বদা বর্তমান থাকে।
২০১৮ সালের এপ্রিলে একটি বৃহৎ জাহাজ নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ধাক্কা মারে অষ্টাদশ শতকে নির্মিত একটি ভবনে যার কারণে দূষণ ছড়িয়ে পড়ে বহু দুর পর্যন্ত এবং অনেক দিন বন্ধ রাখতে হয় বসফরাস।

আগে যে ইস্তানবুল শহরের জনসংখ্যা ছিল ৩০ লাখ তা এখন ১.৫ কোটি পার হয়ে গিয়েছে।তাই এমন জনবহুল একটি শহরে একটি অলাভজনক প্রণালী এতটা সক্রিয় থাকলে তা যেকোনো দেশের কাছেই চিন্তার বিষয়। তবে সরকারের হাতে করার মতো তেমন কিছুই নেই এক্ষেত্রে কারণ এই প্রণালীর ওপর চাপানো আছে তিনটি আন্তর্জাতিক চুক্তি। ১৯২০ এর সোবার্স চুক্তি ও ১৯২৩ এর লুযান চুক্তি যাদের দ্বারা বসফরাসের নিয়ন্ত্রণ তুরস্কের হাত থেকে ছিনিয়ে নেওয়া হয়। অবশেষে ১৯৩৬ এর মন্ট্রি চুক্তি। এই চুক্তিতে তুরস্ককে বসফরাসের মালিকানার অধিকার দেওয়া হলেও তারা এই প্রণালী অতিক্রমকারী কোনো জাহাজের কাছে থেকে কোনো শুল্ক সংগ্রহ করতে পারবে না এবং যুদ্ধকালীন সময় ছাড়া কোনো দেশের বাণিজ্যিক জাহাজকে অতিক্রম বাধাও দিতে পারবেনা।যদিও যুদ্ধের সময় তুরস্ক তা করতে পারবে এবং সামরিক জাহাজ চলাচলের জন্য শুধু মাত্র কৃষ্ণসাগর উপকূলবর্তী দেশগুলোর অধিকার থাকবে তুরস্ক ছাড়া। তবে অন্য কোনো দেশের নৌবাহিনী এই প্রণালী তুরস্কের অনুমতি ব্যাতিত ব্যাবহার করতে পারবেনা। এই চুক্তির ফলে রাশিয়া যেমন তুরস্কের অনুগত হয়ে থাকে তেমনই আমেরিকা কৃষ্ণসাগরে রাশিয়ার বিরুদ্ধে কোনো কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারেনা ফলে তারা বহুদিন থেকে তুরস্ককে এমন একটি বিকল্প রাস্তা খোলার জন্য অনুরোধ করেছিল।

তুরস্কের জন্য এত গুরুত্বপূর্ণ একটি সামুদ্রিক রাস্তার তেমন কোনো আর্থিক মূল্য না থাকায় উপরন্তু দুর্ঘটনা জনিত ক্ষতির সম্ভাবনা থাকায় তারা ক্যানাল ইস্তানবুল প্রজেক্ট হাতে নেয়।

কি এই ক্যানাল ইস্তানবুল প্রজেক্ট :

তুরস্ক সরকার বসফরাসের ওপর চাপ কমানোর লক্ষ্যে একটি বিকল্প নৌপথ হিসেবে বসফরাসের পশ্চিমে একটি ৪৫ কিমি দীর্ঘ ক্যানাল বা খাল খনন করতে চলেছে যা উত্তরের কৃষ্ণ সাগর এবং দক্ষিণে মার্মারা সাগরকে যুক্ত করবে। এর গভীরতা নুন্যতম ২৫ মিটার হবে বলে জানানো হয়েছে। এটি ৩৬০ মিটার থেকে ১ কিমি পর্যন্ত স্থানভেদে চওড়া হবে। আনুমানিক ব্যয় ধরা হয়েছে ১৫ বিলিয়ন ডলার। এটি প্রতিদিন প্রায় ১৬০ টি সামুদ্রিক জাহাজ চলাচলের উপযুক্ত হবে এবং তুরস্কের সরকার বছরে এই ক্যানাল থেকে ৮ বিলিয়ন ডলার রাজস্ব আয় করবে বলে আশা করা হচ্ছে।

এই বৃহৎ প্রকল্পের খরচ প্রাথমিকভাবে সরকার এবং ইস্তানবুল মিউনিসিপ্যালিটির যৌথভাবে করার কথা হলেও এখন তা বেসরকারি সংস্থার হাতে দেওয়া হবে বলে জানা যাচ্ছে। কারণ ইস্তানবুলের বর্তমান মিউনিসিপ্যালিটি একেপি পার্টির হাতে নেই। নির্মাণকারি সংস্থা এটি খনন করার পর নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত পরিচালনা করে সরকারের হাতে হস্তান্তর করবে অর্থাৎ এটি তৈরি হবে বিল্ড- অপারেট- ট্রান্সফার মডেলে।

খুব সাম্প্রতিক সময়ে তুরস্কের পরিবেশ মন্ত্রক প্রকল্পটিকে ছাড়পত্র দিয়েছে। প্রকল্পের প্রাথমিক পর্যবেক্ষণ এবং ভূতত্ত্ব বিষয়ক সার্ভে সম্পন্ন হয়েছে। ভবিষ্যতে সুনামি, ভূমিকম্প সহ প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের বিষয় গুলো খতিয়ে দেখা হয়েছে। ভূমি অধিগ্রহণের কাজ প্রায় শেষ। খুব শীগ্রই এটার খনন কার্য শুরু হবে বলে জানা গিয়েছে। এটি তুরস্কের প্রজাতন্ত্রের ১০০ তম বছর পূর্তিতে অর্থাৎ ২০২৩ সালে চালু হবে বলে আশা প্রকাশ করা হয়েছে সরকারি দলের তরফে।

বিরোধীদের সমালোচনা :

বিরোধীদের অনেকে বলছেন এই প্রকল্প ইস্তানবুলের বাস্তুতন্ত্রের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলবে, সবুজের অবরণ ধ্বংস করবে এবং পানির যোগানে সংকট দেখা দেবে। তাদের মতে কোনো বিদেশি জাহাজ বিনা খরচের বসফরাস বাদ দিয়ে এই ক্যানাল ব্যাবহার করবে না। অন্য দিকে সরকারি পক্ষের যুক্তি আমরা পরিবেশগত দিকটি ইতিমধ্যে বিবেচনা করেছি এবং সম্ভাব্য সব রকম ব্যাবস্থা নেওয়া হবে পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখতে। তাদের আরো দাবি, এই প্রকল্প অপেক্ষাকৃত স্বল্পোন্নত ইস্তানবুলের উত্তরপশ্চিম অংশের উন্নয়নে ব্যাপক ভূমিকা পালন করবে এবং বসফরাসে যে দুর্ঘটনার আশঙ্কা থাকে তার থেকে আমাদের শহর নিরাপদ থাকবে।

তুরস্কের বিরোধী দলগুলোর অনেকে এই প্রকল্প কে উচ্চাভিলাষী এবং অপ্রয়োজনীয় বলে মন্তব্য করছেন। কিন্তু অনেকে মনে করছেন তুরস্কের আর্থিক লাভের সঙ্গে সঙ্গে আন্তর্জাতিক  বিশ্বে প্রভাব বৃদ্ধিতে এই ক্যানাল ব্যাপকভাবে সাহায্য করবে যা প্রেসিডেন্ট এরদোগানের তুরস্ককে মুসলিম বিশ্বের পরিচালকশক্তি রূপে প্রতিষ্ঠিত করতে সাহায্য করবে।

কেন বিদেশি জাহাজগুলো বসফরাস বাদ দিয়ে এই ক্যানাল ব্যাবহার করবে?

তুরস্কের পরিবহন মন্ত্রী মেহমেত হালাক সলুক কয়েক সপ্তাহ আগে দা হিন্দু পত্রিকাকে বলেন, এই ক্যানাল প্রস্তুত হয়ে গেলে(২০২৩ এর পর) বসফরাস অতিক্রম করা জাহাজের থেকেও আমরা কর নেওয়া শুরু করবো। তবে এই প্রকল্প রূপায়িত হলে রাশিয়ার মতো দেশগুলো আবার কোনো চুক্তির জন্য তুরস্ককে চাপ দিতে পারে তবে সেক্ষেত্রে নিজের স্বার্থে আমেরিকা এবং ন্যাটো রাষ্ট্রগুলো তুরস্ককে সমর্থন করবে বলে মনে হয়। তখন তুরস্ক হবে রাশিয়া এবং আমেরিকার মধ্যমণি।

Back To Top